ঢাকা, বুধবার, ২৮ কার্তিক ১৪৩১, ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ১১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

২ দিনে পুড়েছে ঢাকার ৩ বস্তি, ৪ বছরে ১২৩ বার

শেখ জাহাঙ্গীর আলম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩৫২ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০২০
২ দিনে পুড়েছে ঢাকার ৩ বস্তি, ৪ বছরে ১২৩ বার অগ্নিকাণ্ডে নগদ টাকা-স্বর্ণালংকার হারিয়ে দোলন চন্দ্র। ছবি: বাংলানিউজ

ঢাকা: দু’দিনে রাজধানীর তিনটি বস্তিতে অগ্নিকাণ্ড ঘটেছে। আগুনে পুড়ে গেছে স্বল্প আয়ের মানুষের কষ্টে গড়া শেষ সম্বলটুকুও।

তাদের সাজানো সংসার আগুনে ভস্মীভূত। তিনটি বস্তির চার শতাধিক বসতঘর ও দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেছে।  

সহায় সম্বল হারিয়ে তিনটি বস্তির তিন শতাধিক পরিবারের দেড় হাজার সদস্য এখন খোলা আকাশের নীচে দিন-রাত্রী যাপন করছেন।

গত ২৮ ঘণ্টার ব্যবধানে রাজধানীর সাততলা বস্তি, মোহাম্মদপুরের বিহারি ক্যাম্প বস্তি ও কালশী বস্তিতে আগুন লাগে। এসব ঘটনায় কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি। তিনটি বস্তিতেই বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয়েছে বলে ধারণা করছে ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর।  

তবে বস্তির বাসিন্দাদের অভিযোগ, কেউ পরিকল্পিতভাবেই বস্তিতে আগুন দিয়েছে।

ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের জানুয়ারি থেকে ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত গত চার বছরে রাজধানীর বিভিন্ন বস্তিতে ১২৩টি অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এসব ঘটনায় ১০ জন আহত এবং তিনজন নিহত হন। বস্তিগুলোতে ১২৩টি আগুনের ঘটনায় ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে ১১ কোটি ৮১ লাখ ৯৮ হাজার ৫৮৩ টাকার এবং টাকার অংকে উদ্ধারের পরিমাণ ১৯ কোটি ৫৭ লাখ ৪৫ হাজার টাকা।  

পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ২০১৭ সালে ঢাকার বস্তিতে ৩২টি, ২০১৮ সালে ৩৩টি, ২০১৯ সালে ৩১টি এবং ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ২৭টি আগুনের ঘটনা ঘটে।

নানা কারণে বস্তিতে আগুন লাগতে পারে বলে জানিয়েছেন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের ঢাকা বিভাগের উপ-পরিচালক (অপারেশন) দেবাশীষ বর্ধন। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, রাজধানীর প্রায় বস্তিতে অবৈধ বিদ্যুৎ-গ্যাস সংযোগ থাকে। বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিট, গ্যাস লাইন লিকেজ বা সিলিন্ডার লিকেজ, সিগারেটের আগুন বা মশার কয়েল থেকে, আবার অজ্ঞাত কারণেও আগুনের সূত্রপাত ঘটতে পারে।

একেক বস্তিতে একেক কারণে আগুন লাগে। তদন্ত করেই বস্তিতে আগুনের প্রকৃত কারণ সম্পর্কে বলা যাবে বলে জানান তিনি।

সোমবার (২৪ নভেম্বর) দিনগত রাত পৌনে ১টায় রাজধানীর সাততলা বস্তির স্টাফ কোয়ার্টারের মসজিদ মার্কেটে লাগা আগুনে বস্তির শতাধিক বসতঘর ও ২৮/৩০টি দোকান পুড়ে ছাই হয়।  

মো. ফারুক হোসেন থাকতেন এ বস্তিতে। বস্তির মসজিদ মার্কেটে একটি চায়ের দোকান রয়েছে তার। আগুনে তার চায়ের দোকাটি ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও মার্কেটের পেছনে থাকা তার বসত ঘরটি পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। কোনো কিছুই বের করতে পারেননি তিনি।

প্রত্যক্ষদশী ফারুক বাংলানিউজকে বলেন, রাতে দোকান বন্ধ করে ফেরার সময় মার্কেটের উজ্জ্বল স্টোর থেকে ধোয়া বের হতে দেখি। পরে ধপ করে আগুন ধরে যায়। আশপাশের কয়েকজন মিলে ওই দোকানের আগুন নেভানোর চেষ্টা করি। মুহূর্তেই আগুন মার্কেটে ছড়িয়ে যায়। ওই দোকানের কারেন্টের লাইন থেকে আগুন লাগতে পারে। কারণ আগুনের ধোয়ায় তার পোড়া গন্ধ ছিল।

একই দিনে মঙ্গলবার (২৪ নভেম্বর) বিকেল সোয়া ৪টায় রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বাবর রোডে জহুরি মহল্লায় বিহারি ক্যাম্প বস্তিতে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ফায়ার সার্ভিসের ১০টি ইউনিট চেষ্টা চালিয়ে বিকেল ৫টায় আগুন নিয়ন্ত্রণে আনে। আগুনে ওই বস্তির শতাধিক ঘর পুড়ে গেছে।

বস্তির ক্ষতিগ্রস্তদের অভিযোগ, একটি খালি ঘর থেকে আগুন পুরো বস্তিতে ছড়িয়ে পড়ে। এটা পরিকল্পিতভাবে কেউ করেছে। কারণ এত দ্রুত বস্তিতে আগুন ছড়িয়ে পড়ার বিষয়টি স্বাভাবিক নয়।

মোহাম্মদপুরের বিহারি ক্যাম্পের বস্তিতে আগুনের রেশ কাটতে না কাটতেই মঙ্গলবার (২৫ নভেম্বর) দিনগত রাত সোয়া ২টায় রাজধানীর মিরপুর কালশী বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন বাউনিয়া বাঁধের সি ব্লকের একটি বস্তিতে আগুন লাগে। এতে কালশী বস্তির অর্ধশত ঘর পুড়ে ছাই হয়ে যায়।  

কালশী বস্তিতে অবৈধভাবে গড়ে ওঠা ব্যাটারি চালিত অটোরিকশার গ্যারেজ থেকে আগুনের সূত্রপাত ঘটেছে বলে দাবি করছেন স্থানীয়রা। তারা বলছেন, রাতে ওই গ্যারেজে অটোরিকশার ব্যাটারি চার্জ দিয়ে রাখা হয়। সেখান থেকে বৈদ্যুতিক শর্ট সার্কিটের মাধ্যমে আগুনের সূত্রপাত হয়ে চারপাশে ছড়িয়ে পড়ে।  

কালশীর বাউনিয়া বাঁধের বস্তিতে গভীর রাতে লাগা আগুনে সবাই নিজেদের সহায় সম্বল ফেলে প্রাণ বাঁচাতে ছুটোছুটি শুরু করেন। নিম্ন আয়ের এসব মানুষ ভয়াবহ আগুনের লেলিহান শিখা থেকে শেষ সম্বলটুকু রক্ষা করতে পারেননি।

বাউনিয়া বাঁধের পুকুরপাড়ের বাসিন্দা শুক্কুর আলীর ঘরে থাকা টিভি, ফ্রিজ, দু’টি আলমারি, দু’টি খাট, চেয়ার-টেবিলসহ সংসারের সব জিনিসপত্র পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। মাইক্রোবাস চালিয়ে সংসার চালান। বেশ কিছুদিন আগে কিস্তিতে ফ্রিজটি কিনেছিলেন। এখন ফ্রিজ নেই, তবুও তাকে ওই ফ্রিজের কিস্তির বোঝা টানতে হবে।

ছেলের কলেজের পরীক্ষার জন্য ১০ হাজার টাকা জমা করেছিলেন বস্তির বাসিন্দা মমতাজ বেগম। আগুন আগুন চিৎকার শুনে রাতে তার ঘুম ভাঙে। ছোট বাচ্চাকে কোলে নিয়ে দৌড়ে ঘর থেকে বেরিয়ে যান মমতাজ। আগুনে ঘরের চাল, ডাল ও ছেলের পরীক্ষার টাকা- সব পুড়ে ছাই হয়ে যায়।

ঢাকা-১৬ আসনের সংসদ সদস্য ইলিয়াস উদ্দিন মোল্লাহ আগুনের ঘটনাস্থল পরিদর্শন শেষে বলেন, এ কালশী বস্তিতে গত দেড় বছর আগেও আগুন লেগেছিল। এবারও একই জায়গায় আবার আগুন লাগলো। আমরা তথ্য পেয়েছি, অটোরিকশার গ্যারেজে আগুন লেগে বস্তিতে ছড়িয়ে যায়।

এর আগে, ২০১৫ সালের ১৫ মে ভোর সোয়া ৫টার দিকে, ২০১৬ সালের ১১ ডিসেম্বর দিনগত রাত ১টার দিকে এবং ২০১৯ সালের ২৬ ডিসেম্বর দিনগত রাত পৌনে ১টার দিকে সাততলা বস্তিতে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। ২০১৯ সালের আগুন নেভাতে ফায়ার সার্ভিসের ১১টি ইউনিটের সময় লাগে এক ঘণ্টা। ওই আগুনেও বস্তির শতাধিক ঘর ভস্মীভূত হয়েছিল। বস্তির পাশে একটি ভাঙারির দোকান থেকে আগুনের সুত্রপাত হয়েছিল সেদিন। তখনও বস্তির বাসিন্দাদের অভিযোগ ছিল, ষড়যন্ত্রমূলকভাবে বস্তিতে আগুন লাগানো হয়েছিল।

বাংলাদেশ সময়: ১৩৪৪ ঘণ্টা, নভেম্বর ২৬, ২০২০
এসজেএ/এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।