ঢাকা, মঙ্গলবার, ২২ আশ্বিন ১৪৩১, ০৮ অক্টোবর ২০২৪, ০৪ রবিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

৯ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয় আড়াইহাজার

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০২৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৯, ২০২০
৯ ডিসেম্বর শত্রুমুক্ত হয় আড়াইহাজার ছবি: সংগৃহীত

নারায়ণগঞ্জ: নারায়ণগঞ্জ জেলায় বাংলাদেশের স্বাধীন পতাকা প্রথম ওড়ে আড়াইহাজারে। নারায়ণগঞ্জ জেলায় সর্বপ্রথম শত্রুমুক্ত হয়েছিল আড়াইহাজার থানা।

সেদিন ছিল ৯ ডিসেম্বর। প্রতিবছর বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে দিনটিতে উপজেলার মুক্তিযোদ্ধাদের শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ কর হয়।

১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর আড়াইহাজার শত্রুমুক্ত দিবস। দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধের পর পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে সংগ্রামী জনতা এদেশ স্বাধীন করেছে। জীবন বাজি রেখে পানিতে ডুব সাঁতার দিয়ে পিলারের নিচে ডিনামাইট ফিট করে পাঁচরুখী ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমেই আড়াইহাজার উপজেলায় বিজয়ের সূচনা হয়।

উপজেলার পাঁচরুখী ব্রিজ, ডহরগাঁও এবং মেঘনা নদী দিয়ে বিভিন্ন শত্রুমুক্ত করতে অপারেশন চালানো হয়। প্রবল প্রতিরোধের মুখে পাকিস্তানি বাহিনী সেসময় আড়াইহাজার থানা এলাকা ছেড়ে ভুলতা দিয়ে পালিয়ে যায়।  মুক্তিযোদ্ধারা থানা সদরের ডাকবাংলোয় অবস্থিত পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প দখল করে নেন। সেই সঙ্গে স্বাধীন দেশের পতাকা উড়িয়ে আনন্দ উল্লাস করন।

আড়াইহাজার থানা কমান্ডার স্থল ও জলপথ দু’দিক দিয়েই ডিসেম্বরের প্রথমে সদরের পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্পে হামলার পরিকল্পনা নেন। রাজাকার মারফত খবর পেয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর চোখের ঘুম হারাম হয়ে যায়। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে ছিল ভরা বর্ষাকাল। কিন্তু নভেম্বর ও ডিসেম্বরে চারদিকে শুকনো মাঠ-ঘাট। অবশেষে মুক্তিযোদ্ধাদের ভয়ে পাকিস্তানি বাহিনী রাতের আঁধারে পালিয়ে যায়। ৯ ডিসেম্বর সকালে আক্রমণ চালাতে এসে মুক্তিযোদ্ধারা দেখেন কেউ নেই। কিছু হাড়ি-পাতিল, চাল, ডাল ও আটার বস্তা পড়ে আছে। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার এমএ সামাদ স্বাধীন দেশের পতাকা উড়িয়ে আড়াইহাজারে বিজয় ঘোষণা করেন।

‘সেই দিনটি যেকোনো উৎসবের দিনের চেয়ে বেশি আনন্দের ছিল। আনন্দে কেঁদে ফেলেছিলাম। আমার দেশের মাটি স্বাধীন করতে পেরেছি। দীর্ঘ ৪০ বছরের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন বীর সেনা আড়াইহাজার উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ডেপুটি কমান্ডার কাজী ওয়াজ উদ্দিন। ’

বীর মুক্তিযোদ্ধা কাজী ওয়াজউদ্দিন বলেন, ‘মফস্বল এলাকা বলে আড়াইহাজার থানা এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনী আসে ৭১ সালের মে মাসের শেষের দিকে। প্রথমেই আতংক সৃষ্টির জন্য তারা কয়েকটি গ্রাম থেকে হিন্দু-মুসলমান মিলিয়ে ১৭ জন লোক ধরে নিয়ে যায়। কালীবাড়ী ব্রিজের পাশে (ঋষিপাড়ায়) খালপাড়ে সেই নিরীহ ১৭ জনকে গুলি করে হত্যা করে। এখানে (ঋষিপাড়ায়) একটি গণকবর রয়েছে। মে মাসে পাঁচরুখী গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী আরও একটি গণহত্যা চালায়। ১৬ জন গ্রামবাসীকে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। পাঁচরুখীতেও একটি গণকবর রয়েছে। দু’টি গণহত্যা চালিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ফিরে যায়। তারা প্রথমবার আড়াইহাজারের ভেতর প্রবেশ করেনি। এরই মধ্যে মুক্তিকামী যুবকরা ভারতে চলে যান ট্রেনিং নিতে। ’

বীর মুক্তিযোদ্ধা মো. লাল মিয়া বলেন, ‘মে মাসে ট্রেনিং নিতে ভারতে যাই। ভারতের মেলাঘর এলাকায় ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশারফ আমাদের ট্রেনিং দেন। টুআইসি ছিলেন মেজর হায়দার। আমরা ২২ জন যুবক ট্রেনিং শেষ করে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ নিয়ে আগস্টের প্রথমে দেশে ফিরে আসি। এরই মধ্যে জুলাইয়ের প্রথম দিকে

আড়াইহাজার থানা সদর ও ডাকবাংলোতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্থায়ী ক্যাম্প স্থাপন করেছে। বিভিন্ন গ্রামে শান্তিবাহিনীও গঠিত হয়েছে। রাজাকার আলবদরদের অপকর্ম চলছে।

পাকিস্তানি বাহিনীর স্থায়ী ক্যাম্প করার কারণও জানা গেল। জুনের শেষের দিকে গিয়াস উদ্দিনের (বীর প্রতীক) নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জের একদল মুক্তিযোদ্ধা আড়াইহাজার থানায় দুঃসাহসিক অপারেশন চালিয়েছিল। নারায়ণগঞ্জের সেই গ্রুপের সঙ্গে ঝাউগড়ার মুক্তিযোদ্ধা সিরাজও ছিল। এ অপারেশনের পর আড়াইহাজার থানা সদরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী স্থায়ী ক্যাম্প করে। মুক্তিযোদ্ধাদের ধ্বংস করার জন্যই তাদের কার্যক্রম চলতে থাকে। কিন্তু আগস্টে ভারত থেকে ফিরে মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়।

অপারেশন পাঁচরুখী ব্রিজ
মুক্তিযোদ্ধাদের মতে, আড়াইহাজারের পশ্চিম অঞ্চলে প্রথম অপারেশনটি ছিল সবচেয়ে ভয়াবহ ও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ। আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বুধবার গভীর রাতে এ অপারেশনটি পরিচালিত হয়। থানা কমান্ডার এমএ সামাদ ও কাজী ওয়াজ উদ্দিন জীবন বাজি রেখে অপারেশনটি পরিচালনা করেন। অপারেশনটি ছিল পাঁচরুখী লোহার ব্রিজ উড়িয়ে দেওয়া। পাকিস্তানি বাহিনী ঢাকা-সিলেট মহাসড়কের এ ব্রিজ দিয়েই গোলাবারুদ নিয়ে দেশের পূর্বাঞ্চলে যাতায়াত করতো।

মুক্তিযোদ্ধরা পরিকল্পনা নেন, ব্রিজটি উড়িয়ে দিলে পাকিস্তানি বাহিনীর স্থলপথে চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যাবে। দেশের মানুষ অত্যাচার থেকে রক্ষা পাবে। পাঁচরুখী ব্রিজটি ছিল ব্রিটিশ আমলের। লোহার এ ব্রিজটি ছিল খুবই মজবুত। ১৪০ পাউন্ড (পিকে) এক্সপ্লোসিভ ব্যবহার করা হয়েছে এ অপারেশনে, যা দিয়ে একটি ১০ তলা ভবন সহজেই গুড়িয়ে ফেলা সম্ভব।

ঝুঁকিপূর্ণ এ অপারেশন সম্পর্কে কাজীওয়াজ উদ্দিন বলেন, ‘ব্রিজের ওপর খানসেনাদের পাহারা ছিল। দেখতে পেলেই গুলি করবে। অপরদিকে, হাতে ছিল ডেটোনেটর এক্সপ্লোসিভ। হিসাবে এক চুল পরিমাণ ভুল হলেই বিস্ফোরণে দেহ ছিন্নভিন্ন হয়ে যাবে। সামাদ ভাইয়ের নেতৃত্বে রাত ১২টায় অপারেশন শুরু হলো। পানিতে ডুব দিয়ে ব্রিজের গোল খাম্বাগুলোতে এক্সপ্লোসিভ পেঁচিয়ে ওপরে এক্সপ্লোসিভ লাগাতে পৌনে এক ঘণ্টা সময় লাগে। এক্সপ্লোসিভ লাগানোর পর ৫০ গজ দূরে এসে আমরা ডেটোনেটর চার্জ করি। রাত ১টায় বিকট শব্দে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পাঁচরুখী ব্রিজ উড়িয়ে দিতে সক্ষম হই। ব্রিজ উড়ে গেলেও খাম্বাগুলোর কিছুই হয়নি।

এ অপারেশনের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি বাহিনীর মনে আতংক ধরিয়ে দেয়। আড়াইহাজারের এ সফল অপারেশনে জেলার অন্য এলাকার মুক্তিযোদ্ধারা অনুপ্রাণিত হন। চরমপত্রেও এ কৃতিত্বের কথা প্রচারিত হয়েছে। ’

অপারেশন ডহরগাঁও
সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম ভাগে মুক্তিযোদ্ধারা তিতাস গ্যাসের জাতীয় গ্রিড লাইন উড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। মুক্তিযোদ্ধারা দুপ্তারা ও গোলাকান্দাইলের বর্ডারে ডহরগাঁও গ্রামে ভেতরের পাইপলাইন (জাতীয় গ্রিড লাইন) ধ্বংসের ছক তৈরি করেন। ৭ ফুট গভীর সুরঙ্গপথ তৈরি করতেই ২ রাত লেগে যায়। পাইপলাইনের চারপাশের মাটি সরিয়ে এক্সপ্লোসিভ পেঁচানো হয়। তারপর নিরাপদ দূরত্বে এসে ঘটানো হয় বিস্ফোরণ। প্রচণ্ড শব্দে বিস্ফোরণ ঘটলে রাতের আকাশে কিছু সময়ের জন্য তৈরি হয় আলোর ফোয়ারা। যেন আতশবাজি ফুটছে। আশপাশের গ্রামবাসী প্রথম ভয় পেলেও পরে বুঝতে পারে মুক্তিবাহিনীর কাজ। এ অপারেশনটিও ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। তবে কমান্ডার এমএ সামাদ ব্যাকআপ দেওয়ার জন্য এক গ্রুপ মুক্তিযোদ্ধা রেখেছিলেন পেছনে, যাতে সামনের গ্রুপ নিরাপদে ফিরে আসতে পারে।

মুক্ত হলো ভুলতা ক্যাম্প
জাতীয় গ্রিডলাইন (তিতাস গ্যাসের) উড়িয়ে দেওয়ার পরদিন মুক্তিযোদ্ধারা বেশ সতর্ক ছিলেন। ডহরগাঁও ও বাজবিতে মুক্তিবাহিনী বাংকার বানিয়ে পজিশন নেয়। তারা অ্যামবুশ করা অবস্থায় ছিল। তিতাসের গ্যাস লাইন উড়িয়ে দেওয়ার ঘটনায় পাকিস্তানি বাহিনী বিপদ আঁচ করতে পেরেছিল ঠিকই। গ্রামে ঢোকার মুখেই মুক্তিযোদ্ধাদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে।

পাকিস্তানি বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের হামলায় বিপর্যস্ত হয়ে শেষমেষ লেজ গুটিয়ে পালাতে বাধ্য হয়। ওই দিনই মৃত্যুভয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ভুলতা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে যায়।

মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাম্পটি দখল করে নেন। এ বিজয়ের খবরে আড়াইহাজারের মুক্তিযোদ্ধারা আরও উজ্জীবিত হয়ে ওঠে। অক্টোবর মাসে প্রভাকরদীতে মুক্তিযোদ্ধাদের একটি গ্রুপ অ্যামবুশ অবস্থায় ছিল। ফলে এদিকে আর পাকিস্তানি বাহিনী ধাবিত হয়নি।

বাংলাদেশ সময়: ০০২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৯, ২০২০
এমআরপি/এফএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।