কক্সবাজার: কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ঘিঞ্জি রোহিঙ্গা শিবির ছেড়ে দুই দফায় ১ হাজার ৯৪৮ রোহিঙ্গা এখন বসবাস করছেন নোয়াখালীর ভাসানচরে।
সেখানে যাওয়া রোহিঙ্গারা জানান, খোলামেলা পরিবেশ, উন্নতমানের ঘর-বাড়ি এবং ভালো সুযোগ-সুবিধার মধ্যে তাদের দিনকাল ভালোই কাটছে ভাসানচরে।
রোহিঙ্গা যুবক আমির হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, কক্সবাজারে আমরা ছোট্ট একটি জায়গায় বসবাস করতাম। এখানে অনেক খোলামেলা পরিবেশ। ছেলে-মেয়েরা ইচ্ছেমতো খেলাধুলা করতে পারে, ঘুরতে পারে। এখানকার পরিবেশ যে এত সুন্দর তা জানতাম না। এখানে আমাদের দিনকাল আগের চেয়ে ভালো কাটছে।
কক্সবাজারের ক্যাম্পে সবসময় মারামারি-কাটাকাটি লেগে থাকে। কখন কী সমস্যা তৈরি হয়, মাথায় খুব টেনশন থাকতো, এখানে এই ঝামেলা নেই। অনেক ভালো আছি আমরা, বলেন আমির হোসেন।
তিনি আরও বলেন, তিন মেয়ে, চার ছেলে ও স্ত্রীকে নিয়ে ভাসানচরে এসেছি। কক্সবাজারে আরও অনেক আত্মীয়-স্বজন আছে। তাদের এখানকার সবকিছু জানিয়েছি। সবকিছু শুনে তারাও ভাসানচরে চলে আসতে আগ্রহী।
ভাসানচরে না এলে জানতাম না এই চর এত সুন্দর। এখানে আমাদের থাকার জন্য সব ব্যবস্থা করেছে সরকার। আগে যেখানে থাকতাম, আগের থেকে অনেক উন্নত পরিবেশ, পাকা ঘর, সুযোগ-সুবিধা অনেক বেশি। এখানে আমাদের দিনকাল আগের চেয়ে অনেক ভালো যাচ্ছে, এভাবে প্রতিক্রিয়া জানান রোহিঙ্গা নারী জোবাইদা কামাল।
তিনি আরও বলেন, এখানকার সবকিছু দেখে আমরা আসলেই মুগ্ধ। জায়গাটা খুব নির্জন। তবে কক্সবাজারের চেয়ে অনেক খোলামেলা।
মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্টের পর লাখ লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে এসে বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়। নতুন পুরনো মিলে প্রায় ১২ লাখ রোহিঙ্গা এখন বসবাস করছে কক্সবাজারের উখিয়া-টেকনাফের ঘিঞ্জি রোহিঙ্গা শিবিরে। প্রাথমিকভাবে সেখান থেকে এক লাখ রোহিঙ্গাকে নোয়াখালীর ভাসানচরে স্থানান্তরের উদ্যোগ নেয় সরকার।
এরই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের মে মাসে সাগর পথে অবৈধভাবে মালয়েশিয়া যাওয়ার সময় বঙ্গোপসাগরে ভাসমান অবস্থা থেকে উদ্ধার করে ৩০৬ জন রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে আশ্রয় দেয় সরকার। এর পর দ্বিতীয় দফায় গত ৪ ডিসেম্বর আরও এক হাজার ৬৪২ রোহিঙ্গাকে ভাসানচরে নিয়ে যাওয়া হয়।
ভাসানচরে রোহিঙ্গা স্থানান্তরের জন্য নিজস্ব তহবিল থেকে ৩ হাজার ৯৫ কোটি টাকা ব্যয়ে ভাসানচর আশ্রয়ণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে সরকার। সেখানে এক লাখ রোহিঙ্গা বসবাসের উপযোগী ১২০টি গুচ্ছগ্রামের অবকাঠামো তৈরি করা হয়েছে। যেখানে রয়েছে— শিশুদের খেলার মাঠ, স্কুল, চিকিৎসা কেন্দ্র, দ্বীপে কর্মরত দেশি-বিদেশি সংস্থার লোকজনের জন্য থাকার আলাদা ভবনসহ সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা।
এছাড়া জোয়ার-জলোচ্ছ্বাস থেকে সেখানকার ৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকা রক্ষা করতে ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ ১৯ ফুট উঁচু বাঁধ এবং জাতিসংঘের প্রতিনিধিদের জন্য ভবন ও জেটি নির্মাণ করা হয়েছে ভাসানচরে।
ভাসানচরে মানবিক সহায়তা দিচ্ছে ২২ সংগঠন
ভাসানচরে স্থানান্তর হওয়া রোহিঙ্গাদের মধ্যে খাবার সামগ্রী সরবরাহ, চিকিৎসা এবং অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে ২২টি এনজিও। প্রতিটি এনজিওর একাধিক প্রতিনিধি ভাসানচরে অবস্থান করছেন। এ সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।
দ্বীপে কর্মরত সোশ্যালএইড-এর চেয়ারম্যান প্রসূন বড়ুয়া বাংলানিউজকে বলেন, ভাসানচরে না গেলে বোঝা যাবে না এখানকার পরিবেশ কতটা সুন্দর। দ্বীপে পা দিলেই মনটা ভালো হয়ে যায়। একটা মানুষ বসবাসের জন্য যা যা দরকার হয়, শিশুদের খেলার মাঠ, বিশুদ্ধ পানির জন্য টিউবওয়েল, স্কুল, মসজিদ সব ধরনের সুবিধা সেখানে রাখা হয়েছে।
তিনি বলেন, কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবিরে তারা মাটিতে ঘুমাতো, এখানে খাটের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। সাথে লেপ-তোষক, বালিশ সবকিছু দেওয়া হয়েছে। একটা নিম্ম মধ্যবিত্ত পরিবারে যেসব সুযোগ-সুবিধা থাকে অনেকটা সেরকমই।
সোশ্যালএইডের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন সহায়তা দেওয়া হচ্ছে জানিয়ে প্রসূন বড়ুয়া বলেন, শুরুর দিকে বেশকিছু পরিবারকে লেপ-তোষক ও বালিশ দেওয়া হয়েছে। আগামী জানুয়ারি থেকে জুন পর্যন্ত ছয়মাস ২০০ পরিবারকে স্যোশালএইডের পক্ষ থেকে খাবার দেওয়া হবে।
শুরুর দিকে ভাসানচরে রান্না করা খাবার, বর্তমানে শীতবস্ত্র বিতরণ করছে বেসরকারি সংস্থা আলহাজ শামসুল আলম ফাউন্ডেশন। সংগঠনটির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নাসির উদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, শুরুর দিকে প্রায় দুই হাজার মানুষকে রান্না করে তিন বেলা খাবার সরবরাহ করেছি। এখন নারী, শিশু ও পুরুষ সবার জন্য শীতবস্ত্র পাঠানো হয়েছে। গতকাল আমাদের প্রতিনিধি উপজেলা নির্বাহী অফিসারের হাতে এসব শীতবস্ত্র হস্তান্তর করেছেন। আজ-কালের মধ্যে রোহিঙ্গাদের মাঝে বিতরণ করা হবে।
সেখানে রোহিঙ্গাদের চিকিৎসাসেবা দিতে নিয়োজিত রয়েছে আল্লামা ফজলুল্লাহ ফাউন্ডেশন। অ্যাম্বুলেন্স ও অন্যান্য চিকিৎসা সেবা দিতে সেখানে একটি চিকিৎসা কেন্দ্র তৈরি করেছে সংগঠনটি।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার শামসু দ্দৌজা নয়ন বাংলানিউজকে বলেন, মানুষের বসবাস উপযোগী এবং দ্বীপকে নিরাপদ করতে যা যা দরকার সবকিছুই সরকার সেখানে করেছে। স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা, মসজিদ, হাসপাতাল সবকিছু সেখানে রাখা হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১২২৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৫, ২০২০
এসবি/এমজেএফ