ঢাকা, সোমবার, ২৪ আষাঢ় ১৪৩১, ০৮ জুলাই ২০২৪, ০০ মহররম ১৪৪৬

জাতীয়

পাকায় বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম

এ.কে.এস রোকন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০২০
পাকায় বিভিন্ন প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম

চাঁপাইনবাবগঞ্জ: চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার ১২ নম্বর পাকা ইউনিয়নের একটি প্রকল্পে অনিয়মের অভিযোগ প্রমাণের পর অন্য প্রকল্পগুলোতেও ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। সংশ্লিষ্ট বিভাগে এসব অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার আবেদন জানিয়েও নেওয়া হচ্ছেনা কোনো পদক্ষেপ।

এদিকে অতিদরিদ্র কর্মসংস্থান কর্মসূচির আওতাধীন প্রকল্পের অনিয়ম প্রমাণিত হওয়ার পরও অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে এখনো নেওয়া হয়নি কোনো শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। অনিয়মের মাধ্যমে সুবিধাভোগীরা গত ৪ বছর ধরে সুবিধা নিয়ে আসলেও এসব সরকারি সুবিধা বন্ধ বা অভিযুক্তদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার চিঠি চালাচালির মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। এছাড়াও মাতৃত্বকালীন ভাতা ও ভিজিডি প্রকল্পের অনিয়মের একাধিক অভিযোগ থাকলেও তা এখনও তদন্তই করেনি সংশ্লিষ্ট বিভাগ।

অনুসন্ধানে জানা যায়, পাকা ইউনিয়নের ৮ জন ওয়ার্ড সদস্য এবং ৩ জন সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ড সদস্যের মধ্যে শুধুমাত্র ৭ নম্বর ওয়ার্ড সদস্যের বিরুদ্ধে কোনো অনিয়মের অভিযোগ পাওয়া যাযনি।

১ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য নজরুল ইসলাম মেহেদীর তৈরিকৃত ভিজিডি তালিকায় এক এবং মাতৃত্বকালীন ভাতার তালিকায় নিজ স্ত্রীসহ এক নিকট আত্মীয়ের নাম রয়েছে।

২ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য আজিজুল ইসলাম রেনুর পাঠানো দরিদ্রদের কর্মসূচি প্রকল্পের তালিকায় নিজ ছেলে হাসান আজিজের (তালিকায় ১৪ নম্বরে) নামসহ ৫ আত্মীয়ের নাম রয়েছে।

৩ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য রমজান আলীর হত দরিদ্রদের কর্মসূচির পাঠানো তালিকায় নিজ ভাইসহ ৭ নিকট আত্মীয়ের নাম, ভিজিডির তালকায় ৪ এবং মাতৃত্বকালীন ভাতাভোগীর তালিকায় ২ নিকট আত্মীয়ের নাম রয়েছে।

তালিকায় দেখা যায়, মাতৃত্বকালীন ভাতা ও ভিজিডির তালিকায় রমজানের ফুফাত বোন সাবিনা বেগম, ফুফাত ভাবী ও ফুফুর নাম রয়েছে। শুধু তাই নয় ১৭-১৮ অর্থ বছরে ও ১৯-২০ অর্থ বছরে মাতৃত্বকালীন ভাতায় এবং ১৯-২০ অর্থ বছরে ভিজিডির তালিকায় এদের নাম রয়েছে।

৪ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য জসিমের তালিকায় অতিদরিদ্র কর্মসূচির তালিকায় ২ ভাই মাহমুদুল্লাহ ও ফাজেলের নামসহ ৭ আত্মীয়ের নাম, ভিজিডির তালিকায় বোন জাহান্নারা খাতুন (তালিকায় ৪৩) ও স্ত্রী সানজিদা বেগম (তালিকায় ৪৪) এবং মাতৃত্বকালীন ভাতাভোগীর তালিকায় রয়েছে অপর এক বোনের নাম।
৫ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য রুহুল আমিনের অতিদরিদ্র কর্মসূচির তালিকায় রয়েছে ছেলে আসাদুজ্জামানের (তালিকায় ৪৯ নম্বরে) নাম।

৬ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য কাইয়ুমের হতদরিদ্র সুবিধাভোগীদের তৈরিকৃত তালিকাতে ভাই মতিনের নামসহ (তালিকায় ৫৫ নম্বরে) ৫ আত্মীয়ের নাম ভিজিডির তালিকায়-৩ মাতৃত্বভাতার তালিকায় এক আত্মীয়ের নাম রয়েছে।

৮ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য তরিকুল ইসলামের ভিজিডি তালিকায় স্ত্রী মোস্তারা খাতুনসহ ২, মাতৃত্ব তালিকায় ছেলের বৌসহ ৪ আত্মীয়ের নাম রয়েছে। এছাড়া ভাস্তের স্ত্রী আইরিনের নামে ভিজিডি, ১০ টাকা কেজির চাল এবং মাতৃত্ব ভাতাভোগের অভিযোগ রয়েছে।

বিভিন্ন সূত্র জানায়, গত ১৯-২০ অর্থবছরের ৪০ দিনের অতিদরিদ্রদের কর্মসংস্থান কর্মসূচি প্রকল্পে ৮ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য তরিকুল ইসলাম চরপাকার মৃত নজরুল ইসলামের ছেলে রবিউল ইসলামের নামে দিনমজুর হিসেবে নিয়োগ দিয়ে তার অনুকূলে শিবগঞ্জ উপজেলা সদরের রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে ৮ হাজার টাকা আত্মসাৎ করেন। এ নিয়ে তদন্ত হলে রবিউল লিখিতভাবে এ বিষয়ে কিছুই জানেনা বলে জানিয়েছে তদন্ত কমিটিকে।

এদিকে ১ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য নজরুল ইসলাম মেহেদী তার ভাই আশরাফুল হককে তদবীর করে ১০ টাকা কেজি চালের ডিলারশিপ নিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি তার নামে অতি দরিদ্রদের কর্মসংস্থান কর্মসূচি প্রকল্পে নাম তালিকাভুক্তির পাশাপাশি ৬ নিকট আত্মীয়ের নাম তালিকাভুক্ত করেন।
অপরদিকে ৯ নম্বর ওয়ার্ড সদস্য গোলাম মোস্তফার তদবীরে অতিদরিদ্র কর্মসূচির তালিকায় ছেলে লালবর আলী, ভগ্নিপতি খলিলুর রহমান, ভাগ্নে শহিদুলসহ ১০ আত্মীয়ের, ভিজিডির তালিকায় ৩ আত্মীয় এবং মাতৃত্বকালীন ভাতার তালিকায় ২ নিকট আত্মীয়ের নাম রয়েছে।

অনিয়মে পিছিয়ে নেই মহিলা ওয়ার্ড সদস্যরাও। ৩ জন মহিলা ওয়ার্ড সদস্যদের সবার ওই তিনটি প্রকল্পে রয়েছে নিকট আত্মীয় ও অবিবাহিত মহিলার নাম।

তালিকা যাচাই করে দেখা যায় ১,২ ও ৩ নম্বর সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ড সদস্য মেরিনা খাতুনের ভিজিডি ভাতা ভোগীর তালিকায় ২ এবং মাতৃত্বকালীন ভাতার তালিকায় ৪ জন নিকট আত্মীয়ের নাম রয়েছে। শুধু তাই নয় তিনি তার মেয়ের বিয়ে সদর উপজেলার নারায়নপুর ইউনিয়নে বিয়ে দেওয়ার পরও নিজ ইউনিয়নে ১৭-১৮ অর্থ বছরে মেয়ের নামে মাতৃত্বকালীন ভাতায় ভাতা তুলেছেন। পাশাপাশি অবিবাহিত শ্রী মতি সন্ধ্যা রানীর (২৯), নাম মাতৃত্বকালীন ভাতা ভোগীর তালিকায় দিয়ে ভাতা ভোগ করেছেন। নিজ ছেলের বৌ ২ (৩১,৩২) জনের, নিজ ভাগ্নে বৌ এর নাম (৩০) ৪,৫ ও ৬ নম্বর সংরক্ষিত মহিলা ওয়ার্ড সদস্য সুফিয়া বেগম ৩ জনের নাম ভিজিডির এবং ৩ জনের নাম মাতৃত্বকালীন ভাতাভোগীর তালিকায় তুলেছেন। এছাড়াও অতি দরিদ্র পকল্পের তালিতায় স্বামী হোসেন আলী, ৩ মেয়ে মেয়ে আমেনা মৌসুমি সালমা ও ছেলে রাকিবুলের নামে ভাতা ভোগ করেছেন।

এছাড়াও ৭, ৮ ও ৯ সংরক্ষিত ওয়ার্ড সদস্য শাহনাজ বেগম হত দরিদ্র তালিকায় তার স্বামী লালবর, নারায়নপুর আদর্শ কলেজের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ আবুল কালামসহ ৬ নিকট আত্মীয়ের নাম সংযুক্ত করলেও ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ তদন্ত কমিটির কাছে ভাতা প্রাপ্তির বিষয়ে কিছুই জানেনা বলে লিখিতভাবে অস্বীকার করেন।

অনিয়মের ব্যাপারে নজরুল ইসলাম জানান, রাজনীতি করতে গেলে একটু অনিয়ম হয়। তদন্তে তার ভাইয়ের ১০ টাকা কেজি চালের ডিলারশিপ বাতিল হয়েছে। তবে অন্য প্রকল্পে তিনি কোনো অনিয়ম করেননি। আর রমজান আলী কোন ধরনের অনিয়মের সঙ্গে জড়িত নয় বলে দাবী করেন তিনি।

এছাড়াও তরিকুল ইসলামকে ফোনে না পাওয়া যাওয়ায় এবং অন্য অভিযুক্তদের মোবাইল ফোন নম্বর বন্ধ থাকায় তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) সাকিব আল রাব্বি বাংলানিউজকে জানান, ২০১৯-২০ অর্থ বছরের হতদরিদ্র প্রকল্পের বিভিন্ন অনিয়ম নিয়ে প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তাকে নিয়ে তদন্ত হয়েছে তার কার্যালয়ে। তদন্ত প্রতিবেদন জেলা প্রশাসকের কাছে পাঠানো হলে তিনি স্থানীয় সরকার পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছেন। পরিপ্রেক্ষিতে ২৯ নভেম্বর উপসচিব ইফতেখার আহম্মেদ চৌধুরি স্বাক্ষরিত এক পত্রে কি পরিমাণ অর্থ আত্মসাৎ হয়েছে এবং এর সঙ্গে কারা জড়িত তার পুর্ণাঙ্গ বিবরণ চেয়ে জেলা প্রশাসককে চিঠি দেওয়া হয়। সে মোতাবেক সকল তথ্যাদি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ২০১৬ সালের ৭ মে নির্বাচন পাকা ইউনিয়নের নির্বাচন হওয়ার পর নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা এসব প্রকল্পে ব্যাপক অনিয়ম আরম্ভ করে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬১৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৪, ২০২০
এনটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।