ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

পোনা-পানি সংকটে বিপর্যস্ত বাগেরহাটের চিংড়ি চাষিরা

এস এস শোহান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০৩ ঘণ্টা, মে ১, ২০২১
পোনা-পানি সংকটে বিপর্যস্ত বাগেরহাটের চিংড়ি চাষিরা হাটে অপ্রতুল চিংড়ি পোনা ও পানি শুকিয়ে চৌচির ঘের। ছবি: বাংলানিউজ

বাগেরহাট: পোনা-পানি সংকটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন বাগেরহাটের গলদা চিংড়ি চাষিরা। একদিকে ঘেরে পানি নেই, অন্যদিকে অতিরিক্ত টাকা দিয়েও চাহিদা অনুযায়ী পোনা পাচ্ছেন না তারা।

এ অবস্থায় এক ধরনের অনিশ্চিয়তার মধ্যে পড়েছেন জেলার গলদা চাষিরা।  

তারা বলছেন, এ অবস্থা চলতে থাকলে এ বছর চিংড়ির উৎপাদনে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।  

মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দেশের মধ্যে সব থেকে বেশি চিংড়ি উৎপাদন হয় বাগেরহাট জেলায়। বর্তমানে সরকারি হিসেবে বাগেরহাট জেলায় ৬৬ হাজার ৭১৩ হেক্টর জমিতে ৭৮ হাজার ৬৮৫টি বাগদা ও গলদা চিংড়ির ঘের রয়েছে। এসব ঘেরে ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১৭ হাজার ৪২৭ মেট্রিক টন বাগদা ও ১৮ হাজার ৮৪২ মেট্রিক টন গলদা উৎপাদন হয়েছে। তবে বেসরকারি হিসেবে এর পরিমাণ আরও বেশি। এই উৎপাদনের ধারা বজায় রাখতে ২ কোটি গলদা চিংড়ির রেনুর চাহিদা রয়েছে। কিন্তু বর্তমান এই পরিস্থিতিতে সময় মত ৫০ শতাংশ গলদা পোনাও ছাড়তে পারবেন না বলে জানিয়েছেন স্থানীয় চাষিরা।  

বাগেরহাট সদর, মোংলা, রামপাল, কচুয়াসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার চিংড়ি চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী সাধারণত চৈত্র মাসের মাঝামাঝি সময়ে বাগেরহাট অঞ্চলে নদী থেকে নতুন পানি আসে। আবার বৃষ্টিও হয়। কিন্তু এবার বৈশাখের ১৮ দিন হলেও এখনও কোনো বৃষ্টির দেখা নেই। ঘের প্রস্তুত করেও পানির অভাবে পোনা ছাড়তে পারছেন না। ঘেরের মাটি ফেটে চৌচির হয়ে গেছে। ইচ্ছে থাকলেও পোনা ছাড়তে পারছেন না তারা।  

অন্যদিকে পুকুর বা ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে মৌসুমের শুরুতে পোনা ছাড়ার চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন অনেক চাষি। কারণ লকডাউনের ফলে জেলার বাইরে থেকে সহজে পোনা আসতে পারছে না। আবার নদী থেকে আহরিত পোনা চাষিদের হাতে পৌঁছানোর আগে প্রশাসনের হস্তক্ষেপে আবারও নদীতে ফেলে দেওয়া হচ্ছে। বিভিন্ন হাটে ঘুরেও পোনার ব্যবস্থা করতে পারছেন না চাষিরা। বাগেরহাটের সব থেকে বড় গলদা চিংড়ি পোনার হাট ফকিরহাটের ফলতিতা।  

ভোর বেলা ফলতিতা হাটে গিয়ে দেখা যায়, বিভিন্ন এলাকা থেকে চাষিরা আসছেন পোনা কিনতে। কিন্তু বিক্রির জন্য পোনা এসেছে চাহিদার তুলনায় খুবই কম।  

ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিদিন ভোর থেকে বাগেরহাট জেলার বিভিন্ন এলাকার চিংড়ি চাষিরা এই হাটে গলদা চিংড়ি পোনা ক্রয় করতে আসেন। কক্সবাজার, নোয়াখালী, ভোলা, বরগুনা, কুয়াকাটাসহ বিভিন্ন স্থানের হ্যাচারি ও নদীর পোনা বিক্রি হয় এই হাটে। লকডাউনের কারণে পোনাবাহী পরিবহনগুলো জেলার বাইরের পুলিশ ও প্রশাসনের বাধার সম্মুখিন হওয়ায় সময় মত আসতে পারছে না। সব ধরনের বাঁধা উপেক্ষা করে যা আসছে তারও দাম অনেক বেশি। গেল বছর যেখানে নদীর পোনা ১৬শ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। সেই পোনাই এখন ২৫শ থেকে ৩৫শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর কুয়াকাটা থেকে আসা হ্যাচারির পোনা বিক্রি হচ্ছে ১৫ থেকে ২২শ টাকা পর্যন্ত। যে পোনা গেল বছর বিক্রি হয়েছিল মাত্র ৬ থেকে ৮শ টাকা হাজারে। তবে চাষিদের কাছে নদীর পোনার চাহিদা বেশি।  

ফলতিতা বাজারে প্রায় ৫০টির মত গলদা চিংড়ি পোনার আড়ত রয়েছে। যেখানে প্রতিবছর প্রায় ৫০ থেকে ৬০ কোটি পোনা বিক্রি হয়। যার আনুমানিক মূল্য প্রায় ১২৫ কোটি টাকা।  

পোনা ক্রয় করতে আসা কচুয়া উপজেলার চিংড়ি চাষি সাইদ হোসেন বলেন, একে তো ঘেরে পানি নেই। তারপর মোটর দিয়ে অনেক দূর থেকে পাইপের সাহায্যে ঘেরে ছোট জায়গা করে কিছু পানি দিয়েছি। সেই জায়গার জন্য পোনা কিনতে আসছিলাম। কিন্তু যে পোনা গেল বছর এক হাজার থেকে ১৫শ টাকায় বিক্রি হয়েছে সেই পোনাই এবার ২ হাজার ৭শ টাকা চাচ্ছেন। কি করব পোনা কিনব নাকি বাড়িতে ফিরে যাব বলতে পারি না। এত দাম দিয়ে পোনা কিনে কম পানিতে বাঁচাতে পারবেন কিনা এই নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেন তিনি।  

মোরেলগঞ্জ উপজেলার তেলিগাতি এলাকার মৎস্য চাষি মুকুল বিশ্বাস, সেরাজ খা, খালেক মোড়লসহ কয়েকজন বলেন, গেল বছর বন্যা, খরা, করোনার প্রভাবে দাম কমে যাওয়াসহ নানা কারণে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। আর এবছর বৈশাখ মাসেও ঘেরে পানি নেই। কবে পানি আসবে, কবে মাছ ছাড়ব বলে হতাশা প্রকাশ করেন তারা।  

বাগেরহাট জেলা চিংড়ি ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি ফকির মহিতুল ইসলাম সুমন বলেন, দেশের সব থেকে বেশি গলদা চিংড়ি উৎপাদিত হয় বাগেরহাটে। বাগেরহাটে ১৭টি বাণিজ্যিক হ্যাচারি ছিল, সেই হ্যাচারিগুলো এখন বন্ধ। যতদিন এসব হ্যাচারি চালু না করা যায়, বা অন্য এলাকার হ্যাচারিগুলো পর্যাপ্ত পরিমাণ গলদা চিংড়ির পোনা উৎপাদন করতে না পারবে, ততদিন পর্যন্ত প্রাকৃতিক উৎস্য থেকে গলদার পোনা আহরণের অনুমতি দেওয়ার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানান মৎস্যচাষিদের এই নেতা।  

বাগেরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা এস এম রাসেল বলেন, চিংড়ি চাষের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান সুষ্ঠু-সবল পোনা। কিন্তু বাগেরহাট জেলার বাণিজ্যিক হ্যচারিগুলো নানা কারণে বন্ধ হয়ে গেছে। আমরা চেষ্টা করছি কারিগরি পরামর্শ ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতার মাধ্যমে কিছু হ্যাচারিকে আবারও সচল করতে। সেই অনুযায়ী আমাদের কাজও চলছে। এছাড়া পোনা সংকট সমাধানে সরকারি মৎস্য খামারে কিছু গলদার পোনা উৎপাদন করা হচ্ছে। নদী থেকে আহরিত পোনা যাতে চাষিদের হাতে পৌঁছাতে পারে সে জন্য বিভিন্ন স্টেক হোল্ডারের সঙ্গে আমরা আলোচনা করছি। আশাকরি এ বিষয়েও একটি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত আমরা নিতে পারব। যাতে চাষিরা উপকৃত হয়।  

বাংলাদেশ সময়: ১১৫৮ ঘণ্টা, মে ০১, ২০২১ 
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।