ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৬ মে ২০২৪, ০৭ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

এটিএম বুথে ‘কৃত্রিম জ্যাম’ লাগিয়ে ৩ কোটি টাকা লুট

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৪ ঘণ্টা, মার্চ ৬, ২০২২
এটিএম বুথে ‘কৃত্রিম জ্যাম’ লাগিয়ে ৩ কোটি টাকা লুট

ঢাকা: তিন/চার বছর আগে একটি সিকিউরিটিজ কোম্পানিতে চাকরি নেন আব্দুর রহমান (৩২)। মিরপুর, কালশী, বেনারশি, সেনপাড়া, ইব্রাহিমপুর ও কচুক্ষেত এলাকার দায়িত্ব তার ছিল।

এটিএম বুথে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকায় ফন্দি আঁটেন তিনি। আরও সাতজনকে সঙ্গে নিয়ে তৈরি করেন একটি চক্র। প্রতিদিন বিভিন্ন এটিএম বুথে ‘কৃত্রিম জ্যাম’ লাগিয়ে এ পর্যন্ত প্রায় তিন কোটি টাকা টাকা লুটে নেন নিরাপত্তা কর্মী ও লুটেরা চক্রের মূলহোতা আব্দুর রহমান।

সম্প্রতি সুনির্দিষ্ট অভিযোগের ভিত্তিতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে অভিনব কৌশলে জালিয়াতির মাধ্যমে একটি বেসরকারি ব্যাংকের দুই শতাধিক এটিএম বুথ মেশিন থেকে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়ার সঙ্গে জড়িত চক্রের মূলহোতা আব্দুর রহমান ও তার সাত সহযোগীকে গ্রেফতার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)। এটিএম বুথ থেকে টাকা লুটকারী চক্রের গ্রেফতার বাকি সদস্যরা হলেন- মো. তারেক আজিজ (২৫), তাহমিদ উদ্দিন পাঠান ওরফে সোহান (২৮), রবিউল হাসান (২৭), হাবিবুর রহমান ওরফে ইলিয়াস (৩৬), মো. কামরুল হাসান (৪৩), মো. সুজন মিয়া (৩১) ও মো. আব্দুল কাদের (৪৩)।

অভিযানে গ্রেফতারদের কাছ থেকে দুটি চেকবই, একটি এটিএম কার্ড, চারটি আইডি কার্ড, একটি স্বর্ণের নেকলেস, এক জোড়া বালা, এক জোড়া কানের দুল, একটি আংটি ও নগদ নয় লাখ ৪১ হাজার ৫৫৫ টাকা জব্দ করা হয়।

রোববার (৬ মার্চা) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানিয়েছেন র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

তিনি বলেন, শনিবার (৫ মার্চ) দিনগত রাতে র‌্যাব সদর দপ্তর গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-৪ এর একটি দল রাজধানীর মিরপুর, হাজারীবাগ, যাত্রাবাড়ী ও বাড্ডা এলাকায় অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেফতার করে।

খন্দকার আল মঈন বলেন, ডাচ বাংলা ব্যাংকের বুথের টাকা লোড-আনলোডসহ মেইন্টেন্যান্সের দায়িত্ব পালন করে গার্ডা শিল্ড নামে একটি কোম্পানি। আর লুটেরা চক্রের মূলহোতা আব্দুর রহমান ওই কোম্পানিতে চাকরি করতেন। সেখানে কাজ করতে করতে তিনি শুরু করে প্রতারণার মাধ্যমে বুথের টাকা লুটপাট। তার সঙ্গে এ চক্রের অন্তত ২০ জন সহযোগী রয়েছে। গত এক বছরে প্রায় তিন কোটি টাকা বিভিন্ন বুথে ‘কৃত্রিম জ্যাম’ লাগিয়ে কৌশলে হাতিয়ে নিয়েছেন আব্দুর রহমান ও তার সহযোগীরা।  

তিনি আরও বলেন, ব্যাংকের গ্রাহক যখন বুথ থেকে টাকা তুলতে যেতেন তখন সাময়িক কোনো ভোগান্তির শিকার বা বুথে আটকে যাওয়া টাকা ফেরত পেয়ে অভিযোগের ভিত্তিতে গার্ডা শিল্ড থেকে আব্দুর রহমান যেতেন। এছাড়া বুথে টাকা লোড-আনলোড করার সময় তারা সেখান থেকে টাকা হাতিয়ে নিতেন। এতে কোনো গ্রাহক ক্ষতির সম্মুখীন না হলেও ডাচ বাংলা ব্যাংক ক্ষতির সম্মুখীন হতো। পরে ব্যাংকের অডিটে উঠে আসে বুথের টাকার নয় ছয়ের বিষয়টি। অভিযোগ উঠতো সিকিউরিটি এজেন্সির বিরুদ্ধে। ব্যাংকের মামলার পরিপ্রেক্ষিতে তদন্ত শুরু করে র‌্যাব। তদন্ত ও বিভিন্ন বুথের সিটিটিসি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে চক্রের মূলহোতা আব্দুর রহমানসহ তার সাত সহযোগীকে গ্রেফতার করা হয়।

তিনি বলেন, বেশ কয়েকটি এটিএম বুথ থেকে টাকা লুটের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তথ্য দিয়েছে তারা। জিজ্ঞাসাবাদে জানা যায়, চক্রের সদস্যরা দুই/তিন বছর একসঙ্গে চাকরি করার কারণে তাদের সখ্যতা গড়ে ওঠে। এক পর্যায়ে তারা সিন্ডিকেট তৈরি করে। আব্দুর রহমান তার এক সাবেক সহকর্মীর কাছ থেকে লুটের কৌশল শিখে নেন।

গ্রেফতার হওয়া অন্য সহযোগীরা কোম্পানির কন্ট্রোল রুম, লোডিং, কলিং ও মেইন্টেন্যান্সের দায়িত্ব পালন করতেন।

তারা ঢাকার ২৩১টি এটিএম বুথ মেশিনে টাকা লোড-আনলোডের কাজও করতেন। এ কাজের জন্য ১৯ জন লোডার নিযুক্ত রয়েছে কোম্পানিতে।

চক্রের প্রতারণার কৌশল সম্পর্কে র‌্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, বুথের লোডিং ট্রেতে টাকা রাখার সময় ১৯টি ১০০০ টাকার নোটের পরপর অথবা অন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা ইচ্ছাকৃতভাবে জ্যাম করে রাখতেন। কোনো ক্লায়েন্ট এটিএম বুথে টাকা উত্তোলনের জন্য এটিএম কার্ড প্রবেশ করিয়ে গোপন পিন নম্বর দিয়ে কমান্ড করলে ওই পরিমাণ টাকা ডেলিভারি না হয়ে পার্সবিনে জমা হতো। পরে সেই টাকা সরিয়ে নিতেন চক্রের সদস্যরা। এক্ষেত্রে মেশিনের একটি কৌশল অবলম্বন করে তারা টাকাগুলো লুট করতেন।

জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা গেছে, গ্রেফতার আব্দুর রহমান, সোহাগ পাঠান, হাবিব ও কামরুল এটিএম বুথে লোডিং, কলিং ও মেইন্টেন্যান্সের কাজ করেন। গ্রেফতার কাদের, সুজন, রবিউল ও তারেক আজিজ এটিএম বুথে শুধু লোডিংয়ের কাজ করেন বলে জানা গেছে।

চক্রের মূলহোতা আব্দুর রহমান জিজ্ঞাসাবাদে জানান, তিনি গত তিন/চার বছর আগে জি-৪ সিকিউরিটিতে চাকরি করতেন। আর্থিক অনিয়ম ও টাকা উধাওয়ের কারণে জি-৪ সিকিউরিটি এজেন্সির সঙ্গে ডাচ বাংলার চুক্তি বাতিল হয়। পরে আব্দুর রহমান পুরো চক্রটি নিয়ে নতুন চুক্তিবদ্ধ গার্ডা শিল্ড সিকিউরিটিজ এজেন্সিতে চাকরি নেন। তার দায়িত্বপূর্ণ এলাকা মিরপুর, কালশী, বেনারশি, সেনপাড়া, ইব্রাহিমপুর ও কচুক্ষেত এলাকা। তিনি প্রতিদিন বিভিন্ন এটিএম বুথে ‘কৃত্রিম জ্যাম’ লাগিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা লুট করে আসছেন।

সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে খন্দকার আল মঈন বলেন, চক্রের সবাই শিক্ষিত। তবে বেতন পেতেন ১৪-২০ হাজার টাকা। লুটে নেওয়া অর্থে তারা বিলাসী জীবন-যাপন করতেন।

গার্ডা শিল্ড কোম্পানি এ অপরাধের দায়ে এড়াতে পারে কিনা? জানতে চাইলে খন্দকার আল মঈন বলেন, থার্ড পার্টি হিসেবে গার্ডা শিল্ডের দায় ছিল। কারণ তারা লোকবল নিয়োগে অতীতের তথ্য ঘাটেনি। শুধুমাত্র অভিজ্ঞতা ও দক্ষতার ভিত্তিতে নিয়োগ দিয়েছে। আর সংশ্লিষ্ট ব্যাংক টাকা লোড-আনলোডের ক্ষেত্রে নজরদারি রাখেনি। ব্যাংকের ও সিকিউরিটি এজেন্সির কারো সংশ্লিষ্টতা পেলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চক্রে জড়িত পলাতক অন্যদের আটকের চেষ্টা চলছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫২ ঘণ্টা, মার্চ ০৬, ২০২২, আপডেট: ১৬৪৭ ঘণ্টা
এসজেএ/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।