ঢাকা, রবিবার, ১৩ আশ্বিন ১৪৩১, ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৫ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

আড়াই কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা!

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট   | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৪৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৬, ২০২২
আড়াই কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা! বাঁ দিকে অভিযুক্ত বিপ্লব সরকার

বাগেরহাট: বাগেরহাট সদর উপজেলার সিঅ্যান্ডবি বাজার এলাকায় সাধারণ গ্রাহকদের আড়াই কোটি টাকা নিয়ে পালিয়ে গেছেন মানব উন্নয়ন সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতির সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব সরকার।  

গত এক সপ্তাহ ধরে বিপ্লবের কোনো খোঁজ পাচ্ছেন না স্থানীয়রা।

স্থানীয়দের ধারণা, স্ত্রী ও একমাত্র মেয়েকে নিয়ে ভারত চলে গেছেন বিপ্লব। এ অবস্থায় সিঅ্যান্ডবি বাজারে ওই সমবায় সমিতির অফিস ও এর অঙ্গ প্রতিষ্ঠান শ্রুতি এন্টারপ্রাইজ ও দারুচিনি শপিং সেন্টারে তালা লাগিয়ে দিয়েছেন ক্ষুব্ধ গ্রাহক ও জন প্রতিনিধিরা। এদিকে সাধারণ সম্পাদককে খুঁজে না পেয়ে সমিতির সভাপতি উন্নয়নকর্মী মানিক দাসকে টাকার জন্য চাপ দিচ্ছেন গ্রাহকরা।

জানা গেছে, ২০১৫ সালে সিঅ্যান্ডবি বাজার এলাকায় স্থানীয় কিছু লোকজনকে সঙ্গে নিয়ে মানব উন্নয়ন সঞ্চয় ও ঋণদান সমবায় সমিতি নামে একটি প্রতিষ্ঠান খোলেন মানিক দাস ও বিপ্লব সরকার। বাজারটিতে পরিতোষ দাসের ভবনে অফিস নিয়ে ব্যবসা শুরু করেন তারা। পরে স্থানীয় সহজ সরল মানুষদের গ্রাহক বানিয়ে দৈনিক, মাসিক ও এক কালীন বিনিয়োগ নেওয়া শুরু করে প্রতিষ্ঠানটি। মানিক দাস বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা রূপান্তরে চাকরিরত থাকায় সমিতির অর্থসহ সব ধরনের দেখভাল করতেন বিপ্লব সরকার। এভাবে বিপ্লব স্থানীয়দের কাছ থেকে প্রায় আড়াই কোটি টাকা বিনিয়োগ নেন। এর মধ্যে ৭০ লাখ টাকা গ্রাহকদের ঋণ দেওয়া আছে, শ্রুতি এন্টারপ্রাইজ ও দারুচিনি শপিং সেন্টারেও কিছু টাকার মালামাল রয়েছে। তবে দুই প্রতিষ্ঠানের কাছে ওয়াল্টনসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান বেশ কিছু টাকা পাবে। এ অবস্থায় গত ১৯ এপ্রিল থেকে সমিতির প্রধান নির্বাহী সাধারণ সম্পাদক  বিপ্লব সরকার পলাতক রয়েছেন।  

এদিকে, সভাপতি মানিক দাসের কাছ থেকে জোরপূর্বক কয়েকটি চেকে স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছেন স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি।

ভবন মালিক পরিতোষ দাস বাংলানিউজকে বলেন, মানব উন্নয়ন সমবায় সমিতিতে আমার নিজের ১০ লাখ টাকা এবং আমার দুই বন্ধুর আট লাখ টাকা রয়েছে। আমার নয় মাসের ভাড়াও বাকি তাদের কাছে। এ অবস্থায় সমিতি চালানোসহ যিনি টাকা-পয়সা পরিচালনা করতেন সেই বিপ্লব সরকার পালিয়ে গেছেন। তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তার বৃদ্ধ বাবা-মাও ছেলের কোনো খোঁজ দিতে পারছেন না। বিপ্লবের স্ত্রী আর একমাত্র মেয়েরও কোনো খোঁজ নেই। আমাদের ধারণা, গ্রাহকদের টাকা-পয়সা নিয়ে বিপ্লব ভারত পালিয়ে গেছেন।

কাজী তারেক নামে এক গ্রাহক বাংলানিউজকে বলেন, এক লাখ ৪২ হাজার টাকা ছিল আমার সমিতিতে। অনেক কষ্ট করে টাকাগুলো রেখেছিলাম।  কিন্তু সব শেষ হয়ে গেল মনে হয়।

জাহিদ হোসেন, সুবর্না দাস, বিমল সাহা, মিতা ঘোষ, হাসান আলীসহ কয়েকশ’ গ্রহাকের মাথায় হাত। দিশেহারা প্রায় সবাই।  

নিলয় দাস নামে এক ব্যবসায়ী বাংলানিউজকে বলেন, প্রতি মাসে এক লাখ টাকায় ১৪০০ টাকা লাভ দেওয়ার শর্তে সমিতিতে ১৫ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছিলাম। এখন কী হবে জানি না। যে কোনো মূল্যে আমরা টাকা ফেরত পেতে চাই।

সমিতির ম্যানেজোর কাম হিসাবরক্ষক পলাতক বিপ্লবের চাচাতো ভাই অনিক সরকার বাংলানিউজকে বলেন, গ্রাহকদের প্রায় আড়াই কোটি টাকা রয়েছে আমাদের কাছে। ঋণ গ্রহাকদের কাছে আমাদের ৭০ লাখ টাকার মতো রয়েছে। সমিতি ভালোই চলছিল, এ অবস্থায় কেন সাধারণ সম্পাদক পালিয়ে গেলেন জানি না। এখন তো আমরা খুব বিপদে পড়ে গেলাম।

সমিতির মাঠ কর্মকর্তা সবুজ দাস বাংলানিউজকে বলেন, দৈনিক, সাপ্তাহিক, মাসিক ও এককালীন বিনিয়োগ নিতাম আমরা। সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব যেভাবে বলতেন সেভাবেই আমাদের সমিতি চলতো। সভাপতি তেমন আসতেন না। সাধারণ সম্পাদক পালিয়ে যাওয়ার পরে এলাকার লোকজন আমাদের প্রতিষ্ঠানে তালা দিয়েছে।

সমিতির ইলেক্ট্রনিকস বিভাগের পাইকারি সেকশনের দায়িত্বে থাকা কয়রা এলাকার কার্তিক সরকার বাংলানিউজকে বলেন, ওয়াল্টনসহ তিন-চারটি কোম্পানির ফ্রিজ, রাইস কুকার, ফ্যানসহ নানা নিত্য প্রয়োজনীয় ইলেক্ট্রনিকস পণ্য আমরা পাইকারি বিক্রি করতাম। শতাধিক খুচরা ব্যবসায়ীদের আমরা পাইকারি পণ্য দিতাম। সমিতির সাধারণ সম্পাদক বিপ্লব সরকার এসব দেখভাল করতেন। কিন্তু ১৯ এপ্রিল থেকে তিনি (বিপ্লব) পলাতক রয়েছেন। যারা সমিতির কাছে টাকা পাবেন, তারা স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে এসে আমাদের শো-রুমে তালা দিয়ে গেছেন। এখন আমরা খুচরা বিক্রেতাদের কাছে যে ৪৬ লাখ টাকা পাবো, তা কীভাবে তুলবো? আবার কোম্পানির লোকরা আমাদের কাছে প্রায় ৩২ লাখ টাকা পাবে, এই টাকা কোথা থেকে দেব। সভাপতি মানিক দাস তো এসব লেনদেনের বিষয়ে কিছুই জানেন না। আমার বেতন বন্ধ দুই মাস। এখন কী করব সেটাও ভেবে পাচ্ছি না।

অন্যদিকে, সমিতির কর্মকর্তা জাকিয়া সুলতানা ও সঞ্জয় সরকারের সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাদের পাওয়া যায়নি।

বিপ্লবের সঙ্গে যোগাযোগের জন্য তার মোবাইল নম্বরে বারবার কল করে এবং সিঅ্যান্ডবি বাজারের অদূরে বিপ্লবের বাড়িতে গিয়ে কাউকে পাওয়া যায়নি। তালাবদ্ধ ঘরে বিপ্লবের বাবা-মাও নেই। সপ্তাহখানেক আগে কোথায় যেন চলে গেছেন বলে জানান বিপ্লবের প্রতিবেশীরা।

সমিতির সভাপতি মানিক দাস বাংলানিউজকে বলেন, আমি একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থায় চাকরি করতাম। যার কারণে সমিতির কোনো বিষয় আমি দেখভাল করতাম না। বিভিন্ন সময় কোনো কাগজপত্রে আমি স্বাক্ষর করতাম মাত্র। সব টাকা-পয়সা ও ম্যানেজমেন্ট দেখাশোনা করতেন বিপ্লব সরকার। গ্রাহকদের কোনো টাকা আমি নেইনি, কোন গ্রাহক আমার কাছে টাকাও দেয়নি। মূলত বিপ্লব সরকার গ্রাহকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে পালিয়েছেন। সুষ্ঠু তদন্ত করে দেখলে বুঝতে পারবেন এই টাকা তছরুপের ঘটনায় আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। বিপ্লবই সব টাকা নিয়ে পালিয়েছেন। বিপ্লবকে ফিরিয়ে এনে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেন তিনি।

বাগেরহাট সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মোহাম্মাদ মুছাব্বেরুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। আপনাদের মাধ্যমেই জানলাম। খোঁজ নিয়ে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২৬, ২০২২
এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।