ঢাকা, রবিবার, ২৯ বৈশাখ ১৪৩১, ১২ মে ২০২৪, ০৩ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

নিজের চিকিৎসা করাতে গিয়ে গড়ে তোলেন কিডনি কেনাবেচার চক্র

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭২৭ ঘণ্টা, জুলাই ২০, ২০২২
নিজের চিকিৎসা করাতে গিয়ে গড়ে তোলেন কিডনি কেনাবেচার চক্র র‌্যাবের কবজায় গ্রেফতার আসামিরা।

ঢাকা:  ২০১৬ সালে নিজের চিকিৎসার জন্য ভারতে যান মো. শহিদুল ইসলাম মিঠু (৪৯)। সেখানে কিডনি প্রতিস্থাপনের রোগীদের ব্যাপক চাহিদা দেখেন তিনি।

এরপর তিনি নিজেই কিডনি প্রতিস্থাপনের অবৈধ ব্যবসা শুরু করেন। সেখানে অর্গান হারভেস্ট বা কিডনি কেনাবেচা চক্রের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করেন। নিজেই একটি দালাল চক্র তৈরি করে এবং অনলাইনের মাধ্যমে আগ্রহী বিত্তশালী কিডনি রোগী এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে স্থানীয় দালালদের মাধ্যমে ডোনার সংগ্রহসহ যাবতীয় কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিলেন। এ পর্যন্ত মিঠু ৫০টির বেশি কিডনি বিক্রি করেছেন বলে জানিয়েছে র‌্যাব।

বুধবার (২০ জুলাই) দুপুরে কারওয়ানবাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অবৈধভাবে কিডনি কেনাবেচার সংঘবদ্ধ চক্রের অন্যতম হোতা মিঠুসহ চক্রের ৫ সদস্যকে ভাটারা, বনশ্রী, মিরপুর এলাকা থেকে গ্রেফতার করে র‌্যাব-১।

র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক বলেন, প্রতারণার মাধ্যমে মানবদেহের কিডনিসহ নানাবিধ অঙ্গের অবৈধ ট্রান্সপ্লান্টেশনের সঙ্গে সক্রিয় রয়েছে কয়েকটি চক্র। এসব চক্রের ফাঁদে প্রলুব্ধ হয়ে অসহায় নিম্নআয়ের মানুষ ক্ষেত্র বিশেষে গ্রাহকরাও প্রতারিত হচ্ছে।

সাম্প্রতিক সময়ে র‌্যাব সাইবার মনিটরিং সেল ভার্চ্যুয়াল জগত তথা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে অবৈধভাবে কিডনিসহ অন্যান্য মানব অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ কেনাবেচা সিন্ডিকেটের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে আসছিলেন। গোয়েন্দা নজরদারির ভিত্তিতে ১৯ জুলাই রাত থেকে ভোর পর্যন্ত ভাটারা, বনশ্রী ও মিরপুর এলাকায় কিডনি কেনাবেচা সিন্ডিকেটের অন্যতম হোতা মিঠুসহ ৫ সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়।

গ্রেফতার হওয়া বাকিরা হলেন- মিজানুর রহমান (৪৪), আল মামুন ওরফে মেহেদী (২৭), সাইমন (২৮) ও রাসেল হোসেন (২৪)। অভিযানে চক্রের সদস্যদের কাছ থেকে বিভিন্ন ভুক্তভোগীর সঙ্গে করা চুক্তির এফিডেভিট কপি, ভুক্তভোগীদের পাসপোর্টসহ মোট ১৪টি পাসপোর্ট, কিডনি ক্রসম্যাচিংয়ের বিভিন্ন দলিল, দেশি-বিদেশি মুদ্রা, বিভিন্ন ব্যক্তির জাতীয়পরিচয়পত্র, চেকবই ও এটিএম কার্ড, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি দপ্তরের জাল সিলমোহর, খালি স্ট্যাম্প, সিপিইউ, মোবাইল ও সিমকার্ড জব্দ করা হয়। কথা বলছেন র‌্যাব-১ এর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল আব্দুল্লাহ আল মোমেন। আব্দুল্লাহ আল মোমেন বলেন, আসামিরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানায়, ফেসবুকে কিডনি কেনাবেচা এই চক্রের মোট সদস্য সংখ্যা ১৫-২০ জন। তারা মূলত তিনটি ভাগে বিভক্ত হয়ে এই অবৈধ কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকেন। এই চক্রের সদস্যরা পার্শ্ববর্তী দেশে থাকা কিডনি কেনাবেচা চক্রের সদস্যদের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে প্রায় শতাধিক মানুষকে পাশের দেশে পাচার করেছে বলে জানা যায়।

চক্রের প্রথম গ্রুপ ঢাকায় অবস্থান করে ফেসবুকে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন প্রয়োজন এমন বিত্তশালী রোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ স্থাপন করে।

চক্রের দ্বিতীয় গ্রুপটি ১ম দলের চাহিদা মোতাবেক দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের অভাবী মানুষদের চিহ্নিত করে এবং তাদের অর্থনৈতিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে অর্থের বিনিময়ে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের জন্য ডোনার থেকে প্রলুব্ধ করে ঢাকায় নিয়ে আসে।

আরেকটি গ্রুপ প্রলোভনের শিকার ভুক্তভোগী কিডনি ডোনারদের ঢাকায় বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশন প্রত্যাশী রোগীর সঙ্গে ব্লাড ম্যাচিং এবং অন্যান্য পরীক্ষা-নিরীক্ষা সম্পন্ন করে। ব্লাড ম্যাচিং এবং অন্যান্য ডায়াগনস্টিক টেস্টে কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের উপযুক্ততা নিশ্চিত হলে, তার পাসপোর্ট, ভিসা প্রসেসিং এবং ভূয়া কাগজপত্র তৈরির মাধ্যমে ভুক্তভোগী ডোনারকে পাশের দেশে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করে।

এই চক্রের সঙ্গে পার্শ্ববর্তী দেশে অবস্থানকারী আরেকটি চক্র পারস্পরিক যোগসাজশে ভুক্তভোগী কিডনি ডোনারকে বিদেশের এয়ারপোর্ট অথবা স্থলবন্দরে রিসিভ করা থেকে শুরু করে হাসপাতালের ডকুমেন্টেশন, অস্ত্রোপচারসহ যাবতীয় কার্যক্রম শেষে ভিকটিমদের বৈধ/অবৈধ উপায়ে বিমান বা উত্তর পূর্বাঞ্চলের সীমান্ত এলাকার মাধ্যমে দেশে ফেরত পাঠায়।

র‌্যাবের ওই কর্মকর্তা বলেন, আসামিরা এই চক্রের মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ অর্থ অবৈধ উপায়ে হাতিয়ে নিয়েছেন বলে প্রাথমিকভাবে স্বীকার করে জবানবন্দি দিয়েছেন। প্রতিটি কিডনি প্রতিস্থাপনের জন্য তারা রোগী প্রতি ২০-২৫ লাখ টাকা নিতেন।

এদিকে কিডনি ডোনারকে তারা ৪ থেকে সাড়ে ৪ লাখ টাকা দেওয়ার কথা বলে আশ্বস্ত করলেও দিতেন না। তবে চক্রটি ডোনারদের অগ্রিম ২ লাখ টাকা দিতেন। কিডনি ট্রান্সপ্লান্টেশনের পর প্রলোভনের শিকার কিডনিদাতাদের বাকি টাকা চাইলে তাকে বিভিন্ন ভয়ভীতি দেখাতো চক্রটি।

জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেফতার আসামি মিজানুর জানায়, তিনি কিডনি ডোনারদের পার্শ্ববর্তী দেশে যাওয়ার জন্য প্রয়োজনীয় পাসপোর্ট, ব্যাংক এনডোর্সমেন্ট, মেডিক্যাল ডকুমেন্টস, ভিসা এবং অন্যান্য কাগজপত্র তৈরি করে থাকে। যেসব ব্যক্তিদের কাগজপত্র সঠিক থাকে না কিংবা প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টের ঘাটতি থাকে, তাদের কাগজপত্র জাল-জালিয়াতির মাধ্যমে প্রস্তুত করে থাকে এবং তিনি ১০ বছরের অধিক সময় ধরে এ কাজ করে আসছিলেন।

গ্রেফতার সাইমন গত এক বছর আগে এবং অপর সদস্য আল মামুন ওরফে মেহেদী ৬ মাস আগে চক্রটির মাধ্যমে জনপ্রতি ৪ লাখ টাকায় কিডনি বিক্রি করে। পরে দ্রুততম সময়ে অধিক পয়সা উপার্জনের লোভে তারা এ চক্রটির সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে এবং কিডনি ডোনার সংগ্রহে লিপ্ত হয়। তারা নিজেদের সুস্থতার প্রমাণ দেখিয়ে অন্যান্য ডোনারদের কিডনি বেচতে আগ্রহী করতেন। তারা এ পর্যন্ত ১০ জনের কিডনি বেচেছে বলে জানা যায়।

এছাড়া গ্রেফতার রাসেল ও তারা দুইজন মিলে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে টাকার প্রলোভন দেখিয়ে সম্ভাব্য ডোনারদের সংগ্রহ করতেন।

গ্রেফতার আসামিদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও জানান তিনি।


বাংলাদেশ সময়: ১৭২৪ ঘণ্টা, জুলাই ২০, ২০২২
এসজেএ/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।