ঢাকা, শুক্রবার, ৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ২৪ মে ২০২৪, ১৫ জিলকদ ১৪৪৫

জাতীয়

সিনহা হত্যার ২ বছর

রায় উচ্চ আদালতেও বহাল থাকবে প্রত্যাশা সিনহার পরিবারের

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩১৬ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০২২
রায় উচ্চ আদালতেও বহাল থাকবে প্রত্যাশা সিনহার পরিবারের সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান।

কক্সবাজার: টেকনাফের বাহারছড়া চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান নিহতের দুই বছর পূর্ণ হচ্ছে কাল।

 ২০২০ সালের ৩১ জুলাই রাতে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কের টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর চেকপোস্টে পুলিশের গুলিতে নিহত হন সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর
সিনহা।

 

পরের দিন ১ আগস্ট এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে টেকনাফ থানায় দুটি এবং রামু থানায় একটি মামলা দায়ের করে। সরকারি কাজে বাধা প্রদান এবং মাদক আইনে মামলা দুইটি দায়ের হয়। টেকনাফ থানায় দায়ের করা এই দুই মামলায় নিহত সিনহার সঙ্গী সাইদুল ইসলাম সিফাতকে আসামি করা হয়। এছাড়া রামু থানায় মাদক আইনে দায়ের করা মামলাটিতে আসামি করা হয় নিহত সিনহার অপর সঙ্গী শিপ্রা দেবনাথকে।

২০২০ সালের ৫ আগস্ট নিহত সিনহার বড় বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে ৯ পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধে কক্সবাজার আদালতে মামলা দায়ের করেন। এতে প্রধান আসামি করা হয়, টেকনাফের বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে। মামলার অন্য আসামিরা হলো- টেকনাফ থানার তৎকালীন ওসি প্রদীপ কুমার দাশ, বাহারছড়া পুলিশ তদন্তকেন্দ্রের তৎকালীন উপ-পরিদর্শক (এসআই) নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কনস্টেবল কামাল হোসেন, কনস্টেবল আব্দুল্লাহ আল মামুন, সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) লিটন মিয়া, উপ-পরির্দশক (এসআই) টুটুল ও কনস্টেবল মোহাম্মদ মোস্তফা।

মামলাটি টেকনাফ থানায় নথিভুক্ত করার পর তদন্তের জন্য র‌্যাবকে দায়িত্ব দেন আদালত। পরে একই সঙ্গে পুলিশের দায়ের করা মামলা তিনটিও র‌্যাবকে তদন্ত করার আদেশ দেন আদালত।

২০২০ সালের ৬ আগস্ট সকালে মামলাটি টেকনাফ থানায় নথিভুক্ত করে তদন্তের জন্য র‌্যাবকে হস্তান্তর করা হয়। ওইদিন বিকেলে মামলায় অভিযুক্ত ৯ জনের মধ্যে ৭ পুলিশ সদস্য আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। ওইদিন পুলিশের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছিল, এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মোহাম্মদ মোস্তফা নামের কোনো পুলিশ সদস্য জেলা পুলিশে কর্মরত ছিল না। ওইদিনই আত্মসমর্পণকারী আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডের আবেদন করেন মামলার
তদন্ত কর্মকর্তা।

র‌্যাব মামলার তদন্তকালীন ২০২০ সালের ১১ আগস্ট গ্রেফতার করে পুলিশের দায়ের করা মামলার তিন সাক্ষী টেকনাফের মারিশবুনিয়া এলাকার মো. নুরুল আমিন, মোহাম্মদ আয়াজ ও নিজাম উদ্দিনকে আদালতে সোপর্দ করেন। ওইদিনই তাদের ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা।

মামলা তদন্তের একপর্যায়ে ২০২০ সালের ১৮ আগস্ট এপিবিএন এর তিন সদস্য সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) শাহজাহান মিয়া, কনস্টেবল মো. রাজীব ও কনস্টেবল মো. আব্দুল্লাহকে গ্রেফতার করে র‌্যাব আদালতে সোপর্দ করে। ওইদিনই তাদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে রিমান্ড আবেদন করেন।

২০২০ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর র‌্যাব কনস্টেবল রুবেল শর্মাকে গ্রেফতার করে আদালতে সোপর্দ করে। তাকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে ওইদিনই রিমান্ড আবেদন করেন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা।

কারাগারে থাকা এই ১৪ আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্তকারী কর্মকর্তা। এদের মধ্যে ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও কনস্টেবল রুবেল শর্মা ছাড়া অন্য ১২ আসামি আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

২০২০ সালের ১৩ ডিসেম্বর র‌্যাব-১৩ কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের জ্যেষ্ঠ সহকারী পুলিশ সুপার (এএসপি) খাইরুল ইসলাম ১৫ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশীট) দাখিল করেন। অভিযুক্তদের মধ্যে ১৪ জন কারাগারে থাকলেও টেকনাফ থানার কনস্টেবল সাগর দেব পলাতক ছিল। অভিযোগপত্রে সাক্ষী করা হয় ৮৩ জনকে। একই দিন পুলিশের দায়ের করা মামলা তিনটির চূড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।

২০২০ সালের ৩১ ডিসেম্বর আদালত অভিযোগপত্রটি গ্রহণ করে পলাতক আসামি কনস্টেবল সাগর দেবের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন। সেই সঙ্গে পুলিশের দায়ের করা তিনটি মামলার চূড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে মামলা থেকে সাইদুল ইসলাম সিফাত ও শিপ্রা দেবনাথকে অব্যাহতি প্রদান করেন আদালত। এরপর মামলাটি জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম তামান্না ফারাহ এর আদালত থেকে মামলাটির কার্যক্রম জেলা ও দায়রা জজ মোহাম্মদ ইসমাইল হোসেনের আদালতে বদলি করা হয়।

এরপর ২০২১ সালের ২৪ জুন পলাতক আসামি কনস্টেবল সাগর দেব আদালতে আত্মসমর্পণ করেন। এতে আদালত ওইদিনই তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন। ২০২১ সালের ২৭ জুন আদালত ১৫ আসামির বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরুর আদেশ দেন। সেই সঙ্গে সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ২৬ থেকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত দিন ধার্য করেন। কিন্তু করোনা মহামারির কারণে আদালতের বিচার কার্যক্রম স্থগিত থাকায় ধার্য দিনগুলোতে সাক্ষ্যগ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। পরবর্তীকালে ২০২১ সালের ২৩ আগস্ট থেকে ১ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৮ দফায় ৮৩ জনের মধ্যে ৬৫ জন সাক্ষ্য দেন। এরপর ৬ ও ৭ ডিসেম্বর আসামিরা ফৌজদারী কার্যবিধি ৩৪২ ধারায় আদালতে জবানবন্দি দেন। সবশেষে ৯ থেকে ১২ জানুয়ারি পর্যন্ত মামলায় উভয়পক্ষের আইনজীবীরা যুক্তি-তর্ক উপস্থাপন করেন। যুক্তি-তর্ক উপস্থাপনের শেষ দিনে আদালত ৩১ জানুয়ারি মামলার রায় ঘোষণার
দিন ধার্য করেন।

৩১ জানুয়ারি ২০২১ সালে বিকেলে জেলা ও দায়রা জজ আদালতের বিচারক মোহাম্মদ ইসমাইল এ মামলার রায় ঘোষণা করেন। মামলার মোট ১৫ আসামির দুইজনকে মৃত্যুদণ্ড, ছয়জনকে যাবজ্জীবন ও সাতজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুজন হলেন- টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া ইউনিয়নের শামলাপুর পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের বরখাস্ত হওয়া পরিদর্শক লিয়াকত আলী। তাদের ফাঁসিতে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত ঝুলিয়ে রাখতে বলেছেন বিচারক।

যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন- এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাগর দেব, রুবেল শর্মা, পুলিশের সোর্স নুরুল আমিন, নিজাম উদ্দিন ও আয়াজ উদ্দীন।

মামলা থেকে খালাস পাওয়া সাতজন হলেন- এপিবিএনের এসআই শাহজাহান আলী, কনস্টেবল মো. রাজীব, মো. আব্দুল্লাহ, পুলিশের কনস্টেবল সাফানুল করিম, কামাল হোসেন, লিটন মিয়া ও আব্দুল্লাহ আল মামুন।

এছাড়া মেজর সিনহা নিহত হওয়ার পর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ৫ সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। গঠিত কমিটি তদন্ত শেষে একটি প্রতিবেদন মন্ত্রণালয়ে জমা দেয়। তবে ওই তদন্ত প্রতিবেদনে কি ধরনের বিষয়বস্তু উল্লেখিত ছিল তা প্রকাশ পায়নি। একই ইস্যুতে কক্সবাজারের পুলিশ সুপারসহ একযোগে দেড় সহস্রাধিক পুলিশ সদস্যকে অন্যত্র বদলি করে তদস্থলে নতুন পুলিশ সদস্যদের পদায়ন করা হয়েছিল।

দুই বছরে এসে মামলার বাদীপক্ষের আইনজীবী মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর জানান, এ মামলার রায় হওয়ার পর আদালতের সকল প্রকার কাগজ-পত্র উচ্চ আদালতে পাঠানো হয়েছে। একই সঙ্গে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের পক্ষে হাইকোর্টে দুই আপীলও করা হয়েছে। একই সঙ্গে যারা খালাস পেয়েছে এ ব্যাপারে রাষ্ট্রপক্ষ আপীলের কথা ছিল। তা হয়েছে কিনা জানা নেই। তবে আপীলের শেষ সময় ৩১ জুলাই।

রাষ্ট্রপক্ষ এই আপীল করেছেন কিনা নিশ্চিত করা বলা যাচ্ছে না। স্বাভাবিকভাবে এ ধরনের আপীলের শুনানি করতে সময় লাগে। এখন আদালত কখন শুনানি করে তা দেখার অপেক্ষায়। তবে এই গুরুত্বপূর্ণ মামলাটি দ্রুত শুনানি করা জরুরি।

তিনি আশা করছেন, নিম্ন আদালতের রায় উচ্চ আদালতেও বহাল থাকবে। একটি আলোচিত হত্যাকাণ্ডের বিচার জাতি দেখবে।

মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস জানান, উচ্চ আদালতে মামলাটি আপীলে রয়েছে। এ পর্যন্ত মামলা যতটুকু এগিয়েছে তাতে সন্তোষ তারা। এখন উচ্চ আদালতে দ্রুত শুনানি করে বিচার নিশ্চিত করা জরুরি। আর যারা খালাস পেয়েছেন এ ব্যাপারে আপীলের প্রস্তুতিও নিচ্ছেন তিনি।

তিনি দ্রুত শুনানি করে ভাইয়ের হত্যার ন্যায় বিচার প্রত্যাশা করেছেন উচ্চ আদালতের কাছে।

মামলার রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী কক্সবাজার জেলা ও দায়রা জজ আদালতের পাবলিক প্রসিকিউটর ফরিদুল আলম জানান, খালাস প্রাপ্তদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপীলের সময় ৩১ জুলাই শেষ হচ্ছে। এই আপীলের বিষয়টি এখনো নিশ্চিত নন তিনি। তবে উচ্চ আদালতের কাছে আবেদন মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের আপীলের শুনানি দ্রুত করে এর বিচার নিশ্চিত করা।

তিনি প্রত্যাশা করেছেন উচ্চ আদালত নিম্ন আদালতের রায় বহাল রাখবেন।

সিনহার মা নাসিমা আক্তার বলেন, "আমার ছেলে ছিল আমাদের জন্য প্রাণের উৎস। সে যখনি সুযোগ পেয়েছে শুধুমাত্র মানুষের কল্যাণে এগিয়ে গিয়েছে। যেসব নরপিশাচরা আমার ছেলেকে হত্যা করে আমার বুক খালি করেছে তাদের আমি কোনোদিন ক্ষমা করবো না, পরম করুণাময় আল্লাহর কাছে তো বিচার দিয়েই রেখেছি। আমার একমাত্র প্রত্যাশা যারা আমার ছেলেকে হত্যা করে আমার বুক খালি করেছে, সেইসব হত্যাকারী মানুষ নামধারী নরকের কীটদের যেন দ্রুত ফাঁসির রায় কার্যকর হয়। আমি আশায় বুক বেঁধে আছি সেই দিনের জন্য যেদিন এদের ফাঁসি হবে, আমার মনটা কিছুটা হলেও শান্তি পাবে।  দেশের বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা রয়েছে, আশা করছি খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে এই বিচারের রায় কার্যকর হবে এবং এটি একটি দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে মানুষের জন্য। আর কেউ এভাবে কোনো মায়ের বুক খালি করার মতো দুঃসাহস দেখাবে না। "

বাংলাদেশ সময়: ০৩১০ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০২২
এসবি/আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।