ঢাকা, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ০৯ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

গার্ডার দুর্ঘটনা: যার যা অবহেলা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫২২ ঘণ্টা, আগস্ট ১৮, ২০২২
গার্ডার দুর্ঘটনা: যার যা অবহেলা

ঢাকা: রাজধানীর উত্তরায় নির্মাণাধীন বাস র‍্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) প্রকল্পে ক্রেন থেকে গার্ডার পড়ে প্রাইভেটকারকে চাপা দিলে ঘটনাস্থলেই একই পরিবারের ৫ জনের মৃত্যু হয়। ঘটনা তদন্তে নেমে সংশ্লিষ্টদের দায়িত্বে অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেছে।

যার ধারাবাহিকতায় ক্রেন চালক-হেলপার ও নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকাসহ ১০ জনকে গ্রেফতার করেছে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।

বুধবার (১৭ আগস্ট) রাজধানীর জুরাইন, যাত্রাবাড়ী, কালসী, সাভার এবং গাজীপুর, সিরাজগঞ্জ ও বাগেরহাটের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে র‌্যাব-১, ৩, ৪, ৬ ও ১২-এর যৌথ দল তাদের গ্রেফতার করে।

গ্রেফতাররা হলেন- ক্রেন চালক আল আমিন হোসেন ওরফে হৃদয় (২৫), হেলপার রাকিব হোসেন (২৩), দুর্ঘটনাস্থলে নিরপাত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ফোর ব্রাদার্স গার্ড সার্ভিসের ট্রাফিক ম্যান মো. রুবেল (২৮), মো. আফরোজ মিয়া (৫০), ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের সেফটি ইঞ্জিনিয়ার মো. জুলফিকার আলী শাহ (৩৯), হেভি ইকুইপমেন্ট সরবরাহের দায়িত্বে নিয়োজিত ইফসকন বাংলাদেশ লিমিটেডের সত্বাধিকারী মো. ইফতেখার হোসেন (৩৯), হেড অব অপারেশন মো. আজহারুল ইসলাম মিঠু (৪৫), ক্রেন সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান বিল্ড ট্রেড কোম্পানীর মার্কেটিং ম্যানেজার তোফাজ্জল হোসেন ওরফে তুষার (৪২), প্রশাসনিক কর্মকর্তা রুহুল আমিন মৃধা (৩৩), মঞ্জুরুল ইসলাম (২৯)।

র‌্যাব জানায়, প্রকল্পে দুর্ঘটনা কবলিত ক্রেনটির ওজন সরানোর সক্ষমতা ছিল ৪৫-৫০ টন। কিন্তু ক্রেনটি যে গার্ডার সরাচ্ছিলো সেটির ওজন ছিল ৬০-৭০ টন। এছাড়া, ক্রেনটির ফিটনেস সার্টিফিকেটও ছিল মেয়াদোত্তীর্ণ।

আনুমানিক ৯৬-৯৭ সালে ক্রয় করা এ ত্রুটিপূর্ণ ক্রেন দিয়ে কাউন্টার লোড দিয়ে গার্ডার স্থাপনের কাজ চালানো হচ্ছিলো। এমনকি ক্রেনটি চালাচ্ছিলেন মূল চালকের সহকারী, আর মূল চালক নিচে থেকে নির্দেশনা দিচ্ছিলেন।

বৃহস্পতিবার (১৮ আগস্ট) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‍্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

গ্রেফতারদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে তিনি বলেন, গত ১৫ আগস্ট বিআরটি প্রকল্পের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না গেজুবা গ্রুপ কোম্পানীর (সিজিজিসি) তত্ত্বাবধানে ক্রেন দিয়ে গার্ডার উত্তোলনের সময় দুর্ঘটনা হয়। দুর্ঘটনায় ঘাতক ক্রেনের চালক আল আমিন ও হেলপার রাকিব হোসেনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিজিজিসি থেকে ভারী যন্ত্রপাতি সরবরাহের ওয়ার্ক অর্ডার পায় ইফসকন নামে প্রতিষ্ঠান। ইফসকনের বড় ক্রেন না থাকায় তারা থার্ড পার্টি প্রতিষ্ঠান বিল্ড ট্রেড কোম্পানীর কাছ থেকে ক্রেনটি ভাড়া নেয়। এছাড়া, প্রকল্প এলাকার নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল ফোর ব্রাদার্স গার্ড সার্ভিসের ট্রাফিক ম্যানরা।

র‌্যাবের এ কর্মকর্তা বলেন, ক্রেনের মূল অপারেটর আল আমিনের হালকা গাড়ি চালানোর অনুমোদন থাকলেও ভারী গাড়ি চালানোর লাইসেন্স নেই। ২০১৬ সালে ক্রেন চালনার প্রশিক্ষণ গ্রহণের পর ২-৩টি নির্মাণ প্রকল্পে কাজ করার পর ২০২২ সালের মে মাসে বিআরটি প্রকল্পে ক্রেন অপারেটর হিসেবে কাজ শুরু করেন তিনি।

গ্রেফতার রাকিব ৩ মাস আগে প্রকল্পের ক্রেন হেলপার হিসেবে কাজ শুরু করে। তার ক্রেন চালনোর কোনো ধরণের প্রশিক্ষণ ছিল না। দুর্ঘটনার দিনে আল আমিন ও রাকিব দুপুর ২টা থেকে ক্রেন চালানো শুরু করেন। একটি গার্ডার স্থাপন শেষে ২য় গার্ডার স্থাপনের সময় হেলপার রাকিবের হাতে ক্রেন দিয়ে নিচে দাড়িয়ে নির্দেশনা দেন। দুর্ঘটনার পর আল আমিন ও হেলপার রাকিব ঘটনাস্থল থেকে পালিয়ে যান।

তিনি বলেন, ইফসকন কোম্পানী ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সিজিজিসি থেকে যন্ত্রপাতি সরবরাহের জন্য ওয়ার্ক পারমিট পায়। গার্ডার বহনের ক্রেন না থাকায় বিল্ড ট্রেডার্স প্রতিষ্ঠান থেকে অপারেটর ও হেলপারসহ ক্রেনটি মাসিক চুক্তিতে ভাড়া নেয় ইফসকন।

ইফসকনের সত্ত্বাধিকারী গ্রেফতার ইফতেখার ও হেড অব অপারেশন গ্রেফতার মিঠু অপারেটরদের দক্ষতা ও যোগ্যতা এবং ক্রেনের ফিটনেস যাচাই না করেই গার্ডার স্থাপনের কাজে নিয়োজিত করছিলেন। এছাড়া, গার্ডার স্থাপনের সময় অতিরিক্ত ক্রেন উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তা ছিল না।

বিল্ড ট্রেড ইঞ্জিনিয়ারের প্রশাসনিক কর্মকর্তা গ্রেফতার রুহুল আমিন এবং মার্কেটিং ম্যানেজার গ্রেফতার তুষার ক্রেনের ভাড়া দেওয়া, চুক্তি, ড্রাইভার নিয়োগ, ক্রেনের ফিটনেস যাচাইসহ অন্যান্য দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তারা জানায়, ক্রেনের সর্বশেষ ফিটনেস যাচাই করা হয়েছিল সর্বশেষ ২০২১ সালে। কিন্তু ২০২২ সালে ক্রেনের কোনো ধরণের ফিটনেস যাচাই করা হয়নি।  

গ্রেফতার জুলফিকার সিজিজিসিয়ের বিআরটি প্রকল্পের সেফটি ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ২০২১ সালে যোগদান করেন। সে প্রকল্পের বিমানবন্দর থেকে উত্তরার আজমপুর পর্যন্ত নিরাপত্তার দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন তিনি। গার্ডার স্থাপনের সময় নিরাপত্তা নিশ্চিতের কোনো ধরণের নিরাপত্তা বেষ্টনী স্থাপন, পর্যাপ্ত ট্রাফিক নিয়োগ দেননি তিনি।

গ্রেফতার রুবেল ৩ মাস আগে এবং গ্রেফতার আফরোজ গত মাসে ফোর ব্রাদার্স গার্ডস সার্ভিস ট্রাফিক ম্যান হিসেবে যোগদান করেন। নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা বিষয়ক তাদের কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না। দুর্ঘটনার সময় তারা দুর্ঘটনাস্থলে প্রকল্পের ট্রাফিকম্যান হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।

এক প্রশ্নের জবাবে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। মামলর তদন্ত কর্মকর্তারা তদন্ত করছে। তাদের তদন্তে বেরিয়ে আসবে এ ঘটনায় আর দায়ী কারা। প্রাথমিকভাবে এ ঘটনায় যাদের দায় রয়েছে বা জড়িত রয়েছে তাদের গ্রেফতার করা হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫২২ ঘণ্টা, আগস্ট ১৮, ২০২২
পিএম/জেডএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।