ঢাকা, বুধবার, ১৮ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ মে ২০২৪, ২১ শাওয়াল ১৪৪৫

জাতীয়

ঠিকানা ভুলে সুস্থ হয়েও যেন তারা অসুস্থ

মুস্তাফিজুর রহমান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০২২
ঠিকানা ভুলে সুস্থ হয়েও যেন তারা অসুস্থ

পাবনা: পাবনা মানসিক হাসপাতালের ৯ নম্বর কক্ষে থাকেন রোগী সাঈদ হোসেন (৬২)। প্রাথমিক চিকিৎসায় তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেও দীর্ঘ সময় ধরে হাসপাতালের একটি কক্ষেই অপেক্ষার প্রহর গুনছেন বাড়ি ফেরার।

বয়সের ভারে এখন ঠিকমত কথাও বলতে পারেন না সাঈদ। জীবনের দীর্ঘ সময় হাসপাতালের নিদৃষ্ট একটি কক্ষে তার সময় কাটে। সুস্থ হয়েও অসুস্থ জীবনযাপন করছেন তিনি। পরিবারের কাছে ফেরার আকুতি থাকলেও কেউ কখনও তার খোঁজ করেননি। নিজে যেতে চাইলেও পরিবার তাদের গ্রহণ করছেন না। এদিকে রোগী ভর্তির সময়ে তথ্য গোপন করায় বিপাকে পড়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

১৯৯৬ সালের কোনো এক সময়ে সাঈদ হোসেনকে হাসপাতালে ভর্তি করে রেখে যান তার পরিবারের সদস্যরা। তখন সাঈদের বয়স ছিল ৩৬ বছর। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পরে তিনি সুস্থ হলেও বর্তমানে বয়সের ভারে নূয়ে পড়েছেন। কিন্তু কে যানতো তথ্য গোপন করে তাকে রেখা যাওয়া হবে এই হাসপাতালে!

সাইদের পরিবারের সঙ্গে অনেক যোগাযোগ করেও কোনো লাভ হয়নি কর্তৃপক্ষের। ভর্তির সময় তার পরিবারের ঠিকানা ভুল দেওয়া হয়েছিল। সাঈদের মতো আরও বেশ কিছু মানসিক রোগী সুস্থ হয়েও ফিরতে পারছেন না নিজ পরিবারের কাছে। দীর্ঘ সময় পরিবারের সদস্যদের থেকে দূরে থাকায় মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছেন তারা। পরবর্তীতে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে অনেক কষ্ট করতে হবে তাদের।

৫০০ শয্যার এই হাসপাতালে সিট খালি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার। কিন্তু তারপরেও সাইদের মতো আরও বেশ কিছু মানসিক রোগী দীর্ঘ সময় ধরে রয়েছেন পাবনা মানসিক হাসপাতালে। তাদের মধ্যে কেউবা রয়েছেন তিনদশক ধরে, আবার কেউবা রয়েছেন এক যুগেরও বেশি সময় ধরে। সুস্থ হওয়ার পরেও তাদের নিতে আসেনি পরিবারের সদস্যরা। পরিবারের অবহেলায় বুকে কষ্ট নিয়ে ধুকে ধুকে সময় কাটছে তাদের। আপনালয়ে ফিরে যেতে চাইলেও পরিবারের সদস্যরা আর তাদের গ্রহণ করছেন না। উপর্যপরি বাড়ির ঠিকানায় পৌঁছে দিতে গেলে হয়রানীর শিকার হতে হচ্ছে হাসপাতাল সংশ্লিষ্ঠদের। তথ্য গোপনসহ রয়েছে রোগীকে গ্রহণ না করে অস্বীকার করার উদাহরণও।

হাসপাতালে কর্তব্যরত স্টাফ মো. আরিফুল ইসলাম বলেন, দীর্ঘ সময় এই হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে রোগী ভালো হয়ে যাওয়ার পরে তাদের বাড়িতে পাঠাতে হয়। কিন্তু আগে যারা রোগী ভর্তি করে গেছেন, তাদের অনেকেই মিথ্যা তথ্য দিয়ে রোগী ভর্তি করেছেন। পরবর্তীতে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও তারা রোগী নিতে অস্বীকার করেন। মানুষ এতো নিষ্ঠুর হয় ভাবতেও কষ্ট লাগে। অনেকে আবার রোগীর খোঁজ না রাখলেও মৃত্যুর খবর পেয়ে লাশ নিয়ে গেছেন। আবার অনেকে লাশটাও না নিয়ে দাফন-কাফনের জন্য শুধু টাকা দিয়ে দিয়েছেন।

সেই কক্ষের দায়িত্বে থাকা জোষ্ঠ্য সেবিকা ফ্লোরা সুসমিতা বলেন, আমার কক্ষে সাঈদ হোসেন নামে একজন প্রায় ২৭ বছর ও জাভেদুল করিম নামে আরেকজন প্রায় ৭ বছর রয়েছেন। তারা দুইজনই বর্তমানে সুস্থ। কিন্তু পরিবারের সদস্যরা আর তাদের গ্রহণ করছেন না। তারা পরিবারে কাছে ফিরতে চায়। যখন তারা তাদের পছন্দের খাবার খেতে চায়, কিন্তু ইচ্ছা থাকলেও আমরা দিতে পারি না তখন খুব কষ্ট লাগে। মিথ্যা পরিচয় দিয়ে আপনজনকে ভর্তি করে রেখে যায় এরা মানুষ না অন্য কিছু!

পাবনা মানসিক হাসপাতালের দায়িত্বরত সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. জাকির হোসেন বলেন, সরকারের সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে আমরা চেষ্টা করছি সুস্থ রোগীকে তাদের পরিবারের কাছে ফেরত পাঠাতে। কিন্তু এতে অনেক সমস্যা রয়েছে। ঠিকানা ভুল আবার তাদের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা মিথ্যা বলেন। আবার নিয়ে যাওয়ার কথা শুনে অনেকে দায়িত্বশীলদের সঙ্গে বাজে আচরণ করেন। এসব সমস্যা সমাধানের জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে।

হাসপাতালের পরিচালক ডা. সাফকাত ওয়াহিদ বাংলানিউজকে বলেন, সুস্থ রোগীকে পরিবারিকভাবে গ্রহণ না করার উদাহরণ অনেক রয়েছে। অনেক পরিবারই চান না যে সুস্থ রোগীরা তাদের কাছে ফিরে যাক। ঝামেলা মনে করে সুস্থ রোগীদেরও দায়িত্ব নিতে চান না অনেকেই। এদিকে দীর্ঘ সময় হাসপাতালে থাকার কারণে মানসিকভাবে আবারও অসুস্থ হয়ে পরছেন অনেকেই। এছাড়া হাসপাতালের সিট বুকড থাকার কারণে নতুন রোগী ভর্তি করতেও সমস্যায় পড়তে হচ্ছে। তাই সবার আগে সামাজিকভাবে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। এটি কোনো স্থায়ী সমস্যা সমাধানের জায়গা নয়।

তিনি আরও বলেন, জেলার প্রতিটি বড় বড় মেডিকেল কলেজে হাসপাতালে এখন মানসিক রোগীর চিকিৎসার জন্য ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে চিকিৎসা না করে পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে পাবনায়। কিছু সময়ের জন্য চিকিৎসা নিয়ে সব রোগীকে পরিবারের সঙ্গে রেখে সেবা দিয়েই ভালো করা সম্ভব। দীর্ঘ সময় হাসপাতালে থাকলে কেউ ভালো থাকতে পারে না। তাই প্রতিটি পরিবারের সদস্যদের কাছে আমাদের আবেদন, আপনজনকে ভুলে না গিয়ে কাছে নিয়ে সেবা দিন। আমরা আছি আপনাদের সঙ্গে।

মানসিক রোগীদের সু-চিকিৎসার জন্য দেশের ভিভিন্ন প্রান্ত থেকে জেলা শহর পাবনাতে আসেন রোগী ও তার পরিবারের সদস্যরা। দেশের একমাত্র বিশেষায়িত হাসপাতাল হওয়ায় এর গুরুত্ব অনেক বেশি। কিন্তু শয্যা সংখ্যা সীমিত হওয়ার কারণে আগত বেশিরভাগ রোগীকে বহির বিভাগ থেকে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে বাড়ি ফিরতে হয়। তবে একজন মানসিক রোগীর হাসপাতালের চিকিৎসার পাশাপাশি অত্যন্ত জরুরি হচ্ছে পারিবারিক সেবা। সাঈদের মতো অন্তত আরও আটজন মানসিক রোগী এখন আপনালয়ে ফেরার অপেক্ষায় রয়েছেন।

বর্তমানে এ হাসপাতালে রোগী ভর্তি রয়েছেন ৪৮৬ জন। এ মধ্যে সাধারণ ওয়ার্ডে ৩৫০ জন ও কেবিন শোয্যায় রয়েছেন ১৫০ জন। পাবনা শহরতলীর হিমায়েতপুর ইউনিয়নে মনরম পরিবেশে বিশাল জায়গা নিয়ে স্থাপিত হয় দেশের একমাত্র সরকারি এই মানসিক হাসপাতাল।

হাসপাতাল সংশ্লিষ্ঠদের দেওয়া তথ্য মতে, মানসিক রোগীদের নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সংবাদ প্রকাশ হয়। সুস্থ হওয়ার পরেও পরিবারের দেওয়া তথ্য ভুল হওয়ায় তারা আর ঘরে ফিরতে পারেন না। এ কারণে ২০১৪ সালে অদালতে রিটপিটিশন দায়ের করা হয়। আদালতের আদেশ অনুযায়ী বিস্তারিত প্রতিবেদন যথাসময়ে কর্তৃপক্ষ মারফত আদালতে দাখিল করা হয়।

সর্বশেষ গত ২০১৯ সালে আদালতের নির্দেশে ১৫ জন রোগীর মানসিক হালনাগাদ অবস্থা নিরুপণের জন্য দুইজন বিশেষজ্ঞ সম্মিলিত তিন সদস্যের মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হয়। সেখানে দেখা যায় যে ১৫ জন রোগীর মধ্যে নয়জনকে তাদের পরিবার থেকে দেওয়া ঠিকানায় ফেরত পাঠানো হয়। কিন্তু সেই ঠিকানায় তাদের অভিভাবকরা না থাকায় ও তথ্য ভুল দেওয়ায় রোগীদের পূনরায় হাসপাতালে আনা হয়।

এর পরে দুইজন হাসপাতালেই মারা যান, পাঁচজনকে ফেরত পাঠানো হয় এবং আরও আটজন এখনও হাসপাতালেই রয়েছেন। পরিবারের সহযোগিতা পেলে তারাও সমাজ বা পরিবারে সেবায় নিজেদের অবদান রাখতে পারবে বলে মনে করছেন হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪২ ঘণ্টা, অক্টোবর ১৩, ২০২২
এফআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।