ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

নিউইয়র্ক

‘জয় পাকিস্তান’ বললে মিডিয়া লুফে নিতো’

শিহাবউদ্দিন কিসলু, স্পেশাল করেসপনডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১২৯ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৪
‘জয় পাকিস্তান’ বললে মিডিয়া লুফে নিতো’ ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ভাষণ

নিউইয়র্ক: বঙ্গবন্ধু ‘জয় পাকিস্তান’ বললে তা সে সময়ের পাকিস্তানপন্থি  মিডিয়াগুলো লুফে নিতো। কিন্তু তেমনটা হয়নি।

৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া ভাষণ তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে শুনেছি। তখন সাংবাদিক ছিলাম না, ছিলাম রাজনৈতিক কর্মী। কিন্তু পরের সাংবাদিকতার দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আর জ্ঞান দিয়ে বুঝতে পারি বঙ্গবন্ধু ‘জয় পাকিস্তান’ বলে শেষ করলে তা হতো অধিকাংশ খবরের কাগজেরই শিরোনাম।

বাংলানিউজের কথা হচ্ছিলো নিউইয়র্ক প্রবাসী সাংবাদিক নিনি ওয়াহেদের সঙ্গে। দৈনিক সংবাদে দীর্ঘ সময় গুরুত্বপূর্ন পদে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি।

নিনি বলেন, বঙ্গবন্ধুর বক্তৃতা ঐদিনই রেডিওতে  শোনা যায় নি। বক্তৃতাটি একদিন পরে সম্প্রচার হয়। যদি বঙ্গবন্ধু ‘জয় পাকিস্তান’  বলতেন তাহলে তা লুফে নিয়ে পাকিস্তান সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন রেডিওতে সম্প্রচার করা হতো। এমনকি রেডিওতে পরের দিনও  প্রচারিত হতো। কিন্তু তা হয়নি।

নিউইয়র্কের অ্যাস্টোরিয়ায় নিজ বাড়িতে বসে বাংলানিউজের সঙ্গে দীর্ঘ আলাপচারিতায় নিনি ওয়াহেদ দেশের রাজনীতির এই হালচালে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধের উপ-সেনাপতির পক্ষ থেকে মুক্তিযুদ্ধেরই চেতনাবিরোধী এমন একটি বক্তব্য কেমন করে এলো- সে প্রশ্নের উত্তরই খুঁজছেন এই প্রবাসী সাংবাদিক নিজেও।

বাংলাদেশে বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে একে খন্দকারের এমন একটি বই প্রকাশকে উদ্দেশ্যমুলক উল্লেখ করে নিনি ওয়াহেদ প্রশ্ন তুলেছেন পঞ্চম সংশোধনীর সময়ে একজন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি হিসেবে একে খন্দকার প্রশ্ন তোলেননি কেন?

৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের সময়ই বা তিনি কোথায় ছিলেন? তিনি তো ময়দানে ছিলেন না! তাহলে কিভাবে শুনলেন সে বক্তৃতার বাণী? প্রশ্ন নিনির।  

এ কে খন্দকারের বইটির প্রকাশক প্রথমা প্রকাশনীর দিকেও অঙ্গুলি নির্দেশ করে তিনি বলেন, এ প্রতিষ্ঠানটিও সচেতন সমাজে প্রশ্নবিদ্ধ।
Nini_wahed_1
পারিবারিকভাবে রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে বড় হয়ে ওঠা একাত্তরের উত্তাল সেই দিনগুলোতে ইডেন কলেজের ছাত্রী ছিলেন নিনি ওয়াহেদ। তিনি জানান,  ৭ই মার্চে রেসকোর্সে ঠিক মঞ্চের সামনেই বসেছিলেন।

ছাত্র ইউনিয়েনের সদস্য হিসেবে মার্চেই ইউনিভার্সিটি জিমনেসিয়াম মাঠে বন্দুক হাতে মেয়েদের মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণে অংশ নেয়া ছাত্রীদের অন্যতম ছিলেন এই নিনি ওয়াহেদ। তারুণ্যের সেই দিনগুলোতে রেসকোর্সে ছুটে গিয়েছিলেন বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রামের যাদুময়ী স্বপ্নের টানে।

বঙ্গবন্ধু, নিনির ভাষায় ‘কবিতার মত’ ঐতিহাসিক সেই ভাষণ শেষ করেছিলেন। জয়বাংলা স্লোগানে মুখরিত ছিল বিশাল সেই জনসমুদ্র।

নিনি ওয়াহেদ বলেন, সেদিনের ভাষণের প্রতিটি উচ্চারণ স্মরণ করে রেখেছি। কোথাও ‘জয় পাকিস্তান’ শব্দ শুনিনি।

নিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু নির্ধারিত সময়ের প্রায় ৩০ মিনিট  দেরীতে মঞ্চে আসেন। আমার মতো উপস্থিত সকলেই  সেদিন শুধু বঙ্গবন্ধুর জন্যই অপেক্ষা করছিলেন।

রেস কোর্সের লাখো মানুষ কেন, সমগ্র জাতিই প্রতীক্ষা করছিল তার মুখ থেকে স্বাধীতার ঘোষণা শোনার জন্য, বলেন স্বাধীনতার চেতনায় উদ্বীপ্ত এই নারী সাংবাদিক।

তিনি বলেন, “তোমাদের যার যা কিছু আছে তা নিয়ে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো... এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম” এমন কথার পর স্বাধীনতার সংগ্রামের ডাক নিয়ে কোনো দ্বিধা থাকতে পারে না।

আর সেদিন মঞ্চে ওই ঘোষণা দিয়ে বঙ্গবন্ধু জনগণের প্রত্যাশাই পূরণ করেছিলেন, বলেন নিনি ওয়াহেদ।

তিনি বলেন, একে খন্দকারের জানা উচিত এ বক্তৃতাটিকে বিশ্বের ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ ৪১টি রাজনৈতিক ভাষণের একটি। এই ভাষণ নিয়ে তিনিই কথা বলবেন যিনি উপস্থিত ছিলেন। যারা শুনে বলছেন, তারা ভুল বলছেন। একে খন্দকার তাদের অন্যতম।

বঙ্গবন্ধুর মুখে ‘জয় পাকিস্তান!’ এমন উচ্চারণ তো ঐ মুহুর্তে ঐ পরিবেশেরই বিরুদ্ধে, যা কোন সুস্থ মানুষ ভাবতেও পারেনা, বলেন নিনি ওয়াহেদ।

মঞ্চের ঠিক সামনে বসে যারা বক্তৃতা শুনেছেন, তারা কেউই যা শুনলেন না, এ কে খন্দকার উপস্থিত না থেকে লোকমুখে তা শুনলেন! বিষ্ময়মাখা জিজ্ঞাসা নিনির।

এতটা নীচে মানুষ নামে কোন স্বার্থ-চিন্তায়?, প্রশ্ন রাখেন তিনি।

এ কে খন্দকারের বইয়ে ‘আগে থেকে প্রস্তুতি নেওয়া গেলে অনেক জীবন রক্ষা পেতো’  এমন বক্তব্যের অর্থই বা কি? একে খন্দকার পর্যায়ের একজন সামরিক কর্মকর্তার কাছ থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামের রাজনৈতিক নেতৃত্ব কি উপদেশ নেবে! ফের বিষ্ময় ঝরে নিনি ওয়াহেদের কণ্ঠে।

তিনি বলেন, এ কে খন্দকারের এ বক্তব্য রীতিমত স্পর্ধা দেখানো আর ষড়যন্ত্র ছাড়া কিছু না।

নিনি বলেন, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একটি জনযুদ্ধ, কোন পরিকল্পিত সামরিক যুদ্ধ নয়।

তিনি আরো বলেন, এ কে খন্দকার মাত্র তিন দিনের মাথায় বইয়ের দ্বিতীয় সংস্করণে সংশোধন করে আবার বলেছেন বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা এবং জয় পাকিস্তান’ দুটোই বলে শেষ করেছেন! কিন্তু কোন সংস্করণেই তিনি কোন সুত্র উল্লেখ করেন নি।  

মুক্তিযুদ্ধের মত স্পর্শকাতর এবং বাঙালির শ্রেষ্ঠ অর্জন সস্পর্কে ইতিহাস লিখতে গেলে আরো সতর্ক  সচেতন ও নিশ্চিত হয়ে এবং  এতিহাসিক ঘটনাবলী সম্পর্কে তথ্য উপাত্ত যাচাই করে  উপস্থাপন করা উচিত। অন্যথায় মুক্তিযুদ্ধ বিরোধীদের হাতকেই শক্তিশালী করা হবে এবং জাতিকে বিভ্রান্ত করা হবে।

একে খন্দকার এখন কি সেটাই চাইছেন, প্রশ্ন তোলেন প্রবাসী সাংবাদিক নিনি ওয়াহেদ।

বাংলাদেশ সময় ২১২৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

নিউইয়র্ক এর সর্বশেষ