ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

নিউইয়র্ক

কেমন আছেন দেশ ও প্রবাসের প্রবীণেরা

নিনি ওয়াহেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৪৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৪
কেমন আছেন দেশ ও প্রবাসের প্রবীণেরা

গত ১ অক্টোবর ছিল বিশ্ব প্রবীণ দিবস। এই প্রবীণদের নিয়েই প্রবাসে আমার বর্তমান চাকরি জীবন।

খুব কাছ থেকে তাদের দেখার ও জানার যেমন সুযোগ ও সৌভাগ্য হয়েছে তেমনি তাদের সমস্যা, সংকট, চাওয়া-পাওয়া, হাসি-আনন্দ, আশা-আকাঙ্ক্ষা ও জীবনাচরণের খুঁটিনাটিসহ অনেক কিছুই দৃশ্যমান আমার সামনে। জীবনের দীর্ঘপথ তারা কেমন করে পাড়ি দিয়েছেন, কি স্বপ্ন তাদের সঙ্গী ছিল, স্বপ্নে সফলতা-বিফলতা আর কেমন করেই বা বাকি জীবনের পথে হাঁটতে চান তারা- এমন সব কাহিনী দেখে-শুনে জেনে কেবলি বাঁধনহারা মন ছেঁটে গেছে হাজার হাজার মাইল দূরে ফেলে আসা শত মমতায় জড়ানো বাংলা মায়ের প্রবীণদের কাছে।

জানতে ইচ্ছে হয়েছে, কেমন আছেন তারা? জীবনের কাছে তাদের প্রত্যাশা কি ছিল? অথবা জীবনের শেষ দিনগুলো তারা কিভাবে কাটাতে চান? তা কি কেবলি মৃত্যুর দিনক্ষণ গুনে গুনে। কবে আসবে সেই দিনটি যেদিন এই পৃথিবীর সব কিছু পেছনে ফেলে চলে যাবেন, না ফেরার দেশে। জানি না, জানতে পারিনি তাদের উত্তর।

তবে এমনও মনে হয়েছে যে, আমরা কখনও কি প্রবীণদের অর্থাৎ পিতা-মাতা, দাদা-দাদি বা নানা-নানির ভালো লাগা না লাগা, চাওয়া-পাওয়া, আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা কখনও ভেবে দেখেছি, মনে হয় উত্তর হবে না সূচক। তদের অন্তর-মনের আনন্দ-বেদনার সাথী হওয়ার কোনো প্রয়াস আমাদের পক্ষ থেকে পরিলক্ষিত হয়েছে বলে স্মরণে আসে না।

এ প্রসঙ্গে যেকথাটি বলা যায় তা হলো, আমাদের মতো জনবহুল উন্নয়নশীল বা অনুন্নত দেশের মানুষের কাছে যেমন খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান ও চিকিৎসার মতো ন্যূনতম মৌলিক অধিকারের স্বীকৃতি অর্জনই একটি দুরূহ ও কঠিন সমস্যা সেখানে মন ও মননে চিন্তা নিয়ে ভাবনার অবকাশ কোথায়? শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিতকরণ, পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা ও নিরাপত্তা বিধান করতেই পরিবারের যখন নাভিশ্বাস তখন মানসিক প্রয়োজেনের বিষয়টি গৌণ হয়ে যায়, তা হয়ে ওঠে বিলাসিতা মাত্র।

কোনো কোনো দেশে প্রবীণের সংখ্যা বেশি আবার কোনো কোনো দেশে নবীনের সংখ্যা বেশি। বাংলাদেশে নবীনের সংখ্যা ঢের বেশি। প্রবীণেরা কেমন আছেন আমাদের দেশে, কেমন আছেন প্রবাসের প্রবীণেরা, কেমন আছেন বিশ্বজুড়ে প্রবীণেরা? এবারের বিশ্ব প্রবীণদিবসের স্লোগান হচ্ছে ‘থাকবো নাকো পেছনে, গড়বো সমাজ একসঙ্গে’।

প্রথমেই বলতে হয় প্রবীণের সংজ্ঞা কি? সাধারণভাবে যদি বলি তাহলে উত্তর এমনও হতে পারে যে, যারা নবীন নয় তারাই প্রবীণ। কিন্তু জাতিসংঘের বিধান অনুযায়ী এবং বাংলাদেশের জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা অনুযায়ী প্রবীণের বয়স ৬০ বছর এবং তার ঊর্ধ্বে। যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের অধিকাংশ দেশে প্রবীণের বয়স শুরু ৬৫ থেকে।

বাংলাদেশে বার্ধক্য ও প্রবীণদের নিয়ে কোনো আলোচনা নেই বললেই চলে। বার্ধক্য যে জীবনের একটি অলঙ্ঘ্যনীয় অংশ এবং তার জন্য যে করণীয় কিছু আছে এ-বিষয়ে বাংলাদেশে তেমন কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। দেখা যায় না এক্ষেত্রে সচেতনতা। ১৯৯১ সাল থেকে প্রতি বছর জাতিসংঘ বার্ধক্যকে মানবজীবরেন প্রধানতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে উল্লেখ করে এ সমস্যা সম্পর্কে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টির আহ্বান জানিয়ে আসছে।

বর্তমান সরকার ২০১৩ সালে জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা প্রণয়ন ও এই প্রথমবারের মতো পিতা-মাতার ভরণপোষণ ২০১৩ সালে সংযুক্ত করেছেন। এই আইনে সন্তানের জন্য তার পিতা-মাতার ভরণপোষণ বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। এই আইনে শাস্তির বিধানও রাখা হয়েছে। এটি একটি ইতিবাচক দিক। এ কারণে যে, একজন মানুষ বৃদ্ধ বয়সে যেন নিজেকে অসহায়, পরনির্ভরশীল ও বোঝা মানে না করেন; বরং এটি তার সন্তানের ওপর অধিকার তা ভাবতে পারেন। এটি একজন প্রবীণের জন্য সুরক্ষার ব্যবস্থা। আবার অনেকে এমনও অভিমত ব্যক্ত করেছেন যে, আইন করে বাধ্যতামূলক করার মতো বিষয় এটি নয়। কিন্তু মানুষের মৌলিক অধিকারসহ সকল অধিকারই নিশ্চিত করা হয় আইনের মাধ্যমে। আইন সেখানে মানুষটির জন্য সুরক্ষাপ্রাচীর হিসেবে কাজ করে।

রাষ্ট্রপতি চালিত হয় সংবিধানের মাধ্যমে। রাষ্ট্রক্ষমতায় আসে বিভিন্ন মত ও পথের অনুসারীরা; কিন্তু তারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেন সংবিধান মোতাবেক। পিতা-মাতা বা প্রবীণদের দেখভালের বিষয়টি যেহেতু অত্যন্ত সংবেদনশীল ও মানবিক একটি ইস্যু, সেহেতু সন্তানের দায়িত্বশীলতা, কর্তব্যপরায়ণতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধা, ভালোবাসা ও আস্থার বিষয়টিও খুবই গুরুত্বপূর্ণ ও অর্থবহ নিঃসন্দেহে।

একসময়ে বাংলাদেশে ঐতিহ্যবাহী একান্নবর্তী পরিবারব্যবস্থা বিদ্যমান ছিল। সেখানে প্রবীণরাই মূলত পরিবার পরিচালনায় মুখ্য ভূমিকা পালন করতেন, ফলে তারা নিরাপদ ও সম্মানজনকভাবে জীবনযাপন করতেন, আজও দেশের প্রায় শতকরা ৮০ ভাগ প্রবীণের বসবাস গ্রামে, পারিবারিক ও সামাজিক আদর্শ ও মূল্যবোধের পরিবর্তন, গ্রাম থেকে শহরে স্থানান্তর, দারিদ্র্য, ভূমিহীনতা, শিল্পায়ন, নগরায়ন, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ ইত্যাদি নানা কারণে শহর এবং গ্রামে এখন একান্নবর্তী পরিবার ভেঙে একক পরিবারে রূপান্তরিত হয়েছে। ফলে এসব দরিদ্র পরিবারভুক্ত প্রবীণদের ভরণপোষণের জন্য নিরূপায় হয়ে বিভিন্ন কঠিন ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হচ্ছে, তাদের অনেকেই ভিক্ষাবৃত্তির মতো মানবেতর কাজও করছেন। ফলে অধিকাংশ প্রবীণ পারিবারিক ও সামাজিকভাবে প্রচণ্ড অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছেন।

অন্যদিকে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন এবং নিজেদের পরিবার সমাজ ও দেশের বোঝা হিসেবে বিবেচনা করছেন।

অথচ বার্ধক্য যে জীবনের একটি বড় স্পর্শকাতর অধ্যায় তা আমরা মনে করি না; তাকে মেনে নিয়ে বেঁচে থাকাটাই যে কতো কঠিন চ্যালেঞ্জ। আর যদি সাথী হয় দারিদ্র্য, অবহেলা, উপেক্ষা আর বঞ্চনা তাহলে তো কথাই নেই। দুঃখজনক হলেও এটি বড় সত্য যে, বাংলাদেশে দারিদ্র্য ও পরনির্ভরশীলতার মূর্ত প্রতীক হচ্ছেন আমাদের প্রবীণরা।

বাংলাদেশে ১৯৭৪ সালে প্রথম লোক গণনায় প্রবীণদের সংখ্যা ছিল ৪০,৫৬,৯৫৮ জন, ১৯৯১ সালের গণনায় সেই সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৬০,৪৫,০২৩ জন। ২০১১ সালের লোক গণনায় প্রবীণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা দাঁড়ায়  ১ কোটিতে যা মোট জনসংখ্যার ৭ শতাংশ। আর বর্তমানে প্রবীণের সংখ্যা ১ কোটি ২০ লাখ। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কোনো দেশের মোট জনসংখ্যার শতকরা ১০ থেকে ১২ ভাগ প্রবীণ হলে সেই দেশকে বার্ধক্যপীড়িত জনসংখ্যার দেশ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সে মতে, বাংলাদেশে অতি শিগগিরই সেই দিকে ধাবিত হবে বলে মনে করা হচ্ছে।

অন্যদিকে, আন্তর্জাতিক সংস্থা হেলপএজ ইন্টারন্যাশনাল ৯০টি দেশের প্রবীণদের ওপর একটি সমীক্ষায় বলেছে ভারতের তুলনায় বাংলাদেশের প্রবীণরা ভালো আছেন। ভালো আছেন পাকিস্তানের তুলনায়ও। তবে শারীরিক সুস্থতার দিক থেকে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় পিছিয়ে আছেন বাংলাদেশের প্রবীণরা। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় তাদের আয় এবং রোজগারও অনেক কম।

বাংলাদেশে বার্ধক্য ও প্রবীণদের বিষয়ে যেহেতু কখনোই গুরুত্ব দেয়া হয়নি এবং তেমনভাবে আলোচনায় আসেনি তাদের সমস্যা সংকট সেহেতু এ ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগও তেমন ছিল না দীর্ঘকাল। বাংলাদেশে ওল্ডহোম, রিটায়ারমেন্ট হোম বা বয়স্ক পুনর্বাসনকেন্দ্র তেমনভাবে গড়ে ওঠেনি। তবে বর্তমান অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের বাস্তবতায় বিষয়টি নিয়ে সকল মহলেই চিন্তাভাবনা শুরু হয়েছে।

বর্তমান সরকার ১৯৯৮ সালে বয়স্কভাতা চালু করেন। সাড়ে ৩ লাখ মানুষের জন্য, বরাদ্দ করা হয় ১২ কোটি টাকা। এখন সেই অর্থ বরাদ্দের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১ হাজার কোটি টাকা এবং ভাতা পাচ্ছেন ৩০ লাখ প্রবীণরা। দরিদ্র, অসুস্থ এবং অসহায়দের মধ্যেই এই ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। পাশাপাশি বেসরকারি খাতে গড়ে উঠছে ওল্ডহোম। অবশ্য যা ব্যয় সাপেক্ষ। সে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ে একটি কোর্সও চালু করা হয়েছে।

যা হোক ফিরে আসি মূল কথায় যে, যাদের বৃদ্ধ বয়সে সন্তানের ওপর নির্ভর করতে হয় না, নিজেরাই নিজেদের ব্যয়ভার বহনে সক্ষম তাদের ক্ষেত্রে দেখা যায় বার্ধক্য ও প্রবীণরা মানসিক এক যন্ত্রণায় দিন অতিবাহিত করেন। একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতা তখন তাদের সাথী হয়। ফলে তারা কেবল দিন গুনতে শুরু করেন কখন চলে যাবেন। অথচ বার্ধক্য শুরুর বয়স যেখানে ৬০ বছর সেখান থেকে দীর্ঘসময় পর্যন্ত প্রতিটি মানুষ থাকে কর্মক্ষম, উদ্যোমী এবং প্রচুর সম্ভাবনাময়। কিন্তু তা সত্ত্বেও এই প্রবীণরা দেশ, রাষ্ট্র, সমাজ এমনকি নিজের পরিবারে পর্যন্ত হয়ে থাকেন উপেক্ষিত, অবহেলিত এবং ক্ষেত্র বিশেষ বোঝা হয়ে।

বার্ধক্যকে আলিঙ্গন করা জীবনেরই ধর্ম। বার্ধক্যের জীবনকে আনন্দময়, প্রাণময়, অর্থবহ ও গুরুত্ববহ করে তোলার দায়িত্ব ও কর্তব্য যেমন সন্তানের তেমনি দেশ, জাতি, রাষ্ট্র ও সমাজেরও। কেবল ভরণপোষণের মৌলিক দাবি পূরণই নয়, তাদের মনের খবর জানার বিষয়টিও কোনো অংশে কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। ওল্ডহোম, রিটায়ারমেন্ট হোম বা বয়স্ক পুনর্বাসনকেন্দ্র যে নামেই ডাকুন না কেন তাদের জন্য প্রয়োজন এমনই আশ্রয়স্থল, ভরসাস্থল, যেখানে থাকবে বিভিন্ন সামাজিক আচার অনুষ্ঠানের ব্যবস্থাদি। ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে তারা মেতে থাকার উৎসবযোগে। যোগ দেবেন নানা কর্মযজ্ঞে অংশীদার হবেন সমাজ বিবর্তনের ধারায়। ঘুচে যাবে প্রবীণদের একাকিত্ব ও নিঃসঙ্গতার গাঢ় আঁধার। বাংলাদেশের প্রবীণদের জন্য এমন জীবনই আমাদের প্রত্যাশা।

** ভালবাসার শব্দহীন অনুভূতি


বাংলাদেশ সময়: ০৭৪৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

নিউইয়র্ক এর সর্বশেষ