৮.
ঢাকার শেরে বাংলা নগরের জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য হাসপাতালকে হঠাৎ দেখায় পাগলা গারদ বলে ভ্রম হতে পারে। ঢুকার মুখেই দেখতে পেলাম, কয়েকজন বিকারগ্রস্ত রোগী সামলাতে স্বজনেরা আপ্রাণ চেষ্টা করছে।
হাসপাতালের পরিবেশের মতোই রোগীদের চেহারা ও পোশাক অতিশয় মলিন। তাদের ত্রিসীমানায় অবজ্ঞা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট নেই। কে যে কতদিন স্নান করে নি, কে জানে! এদের দেখে ইউরোপের মানুষদের কথা মনে পড়ে। যদিও তারা সভ্যজন, তবু স্নানের ব্যাপারে বাংলাদেশের পাগলদের সমগোত্রীয়। কিছুদিন আগেও শীত প্রধান ইউরোপের বাড়িগুলোতে স্নানের ঘরে জল গরম করতে হলে অনেক আগে থেকেই যন্ত্রে পয়সা ঢোকাতে হত। মাঝে মাঝে ধারাস্নান নেওয়ার মাঝখানে পয়সা ফুরিয়ে গেলে হঠাৎ কনকনে ঠাণ্ডা জল পড়তে শুরু করে। তখন দিগম্বর হয়ে লাফ দিয়ে স্নানঘর থেকে বেরুনো ছাড়া উপায় থাকত না। কেননা, আবার পয়সা দিয়ে জল গরম করতে ঘণ্টাখানেক সময় লাগবে। লন্ডনের মতো প্যারিসেও স্নানের ব্যবস্থা খুবই অপ্রতুল ছিল। মানুষ কয়েক সপ্তাহ পর পর একদিন বাইরে গিয়ে কোনো গণস্নানাগারে পয়সা দিয়ে স্নান করে আসত।
বিশেষজ্ঞ শ্রেণীর অনেকে বলেন, পশ্চিম ইউরোপের মানুষজন ভালো করে স্নান করার ব্যাপারটা শিখে সাম্রাজ্য বিস্তারের সময় তাদের উপনিবেশগুলোর মানুষজনের কাছ থেকে। অষ্টাদশ বা ঊনবিংশ শতাব্দীতে স্নানের ব্যবস্থার আওতায় ইউরোপের সাধারণ মানুষ আসতে পারে নি। অনেকদিন পর একদিন পরিবারের সকলেই একটি স্নানের টবে একই জলে একজনের পর আরেক জন স্নান সেরে নিত। এ-ও শোনা গেছে, ফরাসি সম্রাট চতুদর্শ লুইয়ের অত ঐশ্বর্য ও জাঁকজমকময় ভার্সাই দরবারেও মনুষ্য সমাগমের ঘামে বিকট গন্ধ ছড়াত। সেই দুর্গন্ধ কাটাতে অভিজাত লোকেরা প্রচুর পরিমাণে সুগন্ধী পারফিউম নিজেদের গায়ে ও জামাকাপড়ে ছিটিয়ে রাখত। ফরাসি পারফিউমের রমরমা ব্যবসার ঐতিহাসিক মূল্য এ কারণের সঙ্গে জড়িত কি-না মার্গারেটের সঙ্গে দেখা হলে জেনে নিতে হবে। স্নানের ব্যাপারে ইংল্যান্ডও কম পশ্চাতপদ ছিল না। ষোড়শ শতাব্দীর রানি এলিজাভেথ সম্পর্কে শোনা যায়, উনি দুর্গন্ধ একদম সহ্য করতে পারতেন না। তাই সব সময় নিজের আশেপাশে পারফিউম ছিটানোর ব্যবস্থা রাখতেন। রানি মাসে একদিন স্নান করতে বদ্ধপরিকর ছিলেন বলে রানির সভাসদরা আড়ালে তাঁর শুচিবাই নিয়ে নানা কথা বলাবলি করতেন। অথচ একই সময়কালে ভারতে মুঘল বাদশাহ আকবর লালকেল্লায় প্রবহমান জলধারা দিয়ে উত্তাপ লাঘবের প্রক্রিয়াযুক্ত শুধু বাথরুমই নয়, বাথ-কমপ্লেক্সের মত বিশাল ও বিলাসবহুল হাম্মাম তৈরি করেন। মুঘল রাজপুরুষ ও রমণীরা আতর, গোলাপ পাপড়ি সহযোগে রাজকীয় স্নানে তৃপ্ত হতেন। হায়! আজকে কোনও দিক দিয়ে না পেরে বাংলাদেশের পাগলেরা প্রাচীন ইউরোপীয়দের সমকক্ষ হওয়ার জন্যই বোধ হয় স্নান পরিত্যাগ করে চলেছে!
পাগলদের দঙ্গল এড়িয়ে ডা. ফাহমিদকে দোতলার চেম্বারে পাওয়া গেল। মাঝ বয়েসী ডাক্তার সাহেবকে যত না চিকিৎসক মনে হচ্ছে, তারচেয়ে বেশি বুদ্ধিজীবীর মতো দেখাচ্ছে। এক মাথা কাঁচা-পাকা চুলের মাঝারি স্বাস্থ্যের লোকটির এক জোড়া চোখ চকচক করছে দীপ্তিতে। এমন চোখে চোখ পড়লে মানুষ ভালো হতে বাধ্য। আমার পরিচয় পেয়ে সহাস্যে বললেন:
-আসুন, আসুন। আপনার কথা শামীম সাহেব আমাবে ফোনে বলেছেন। কি করতে পারি আপনার জন্য?
আমি তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলি:
-আসলে আমি মাদকের বিস্তার এবং মাদকের সঙ্গে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক-অর্থনীতির প্রভাব দেখার চেষ্টা করছি। এ কারণে আপনার কাছে এসেছি, যারা ড্রাগসের কারণে মাদকাসক্ত বা মানসিক রোগীতে পরিণত হয়, তাদের সম্পর্কে জানতে। তবে শুরুতেই আমার একটি প্রশ্ন আছে। সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসার এতো বেহাল অবস্থা কেন ? রোগীরা কি সঠিক সেবা পাচ্ছে ?
ডা. ফাহমিদ আমার দিকে তাকিয়ে করুণভাবে হাসলেন:
-দেখুন, আমি সরকারি চাকরি করি। সরকারি ব্যবস্থার ত্রুটি বলা আমার জন্য সাজে না। আমিও এই ব্যবস্থার একটি অংশ বিশেষ। আপনার সব কথা মেনে নিয়ে অন্যভাবে আপনাকে উত্তর দিতে চাই। শিক্ষাজীবনে মেডিকেলের ছাত্রদের গ্রিক দার্শনিক হিপোক্রেটিস নির্দেশিত শপথ বাক্য পাঠ করতে হয়: ‘রোগীকে ভালোবেসে চিকিৎসা করব, অবহেলা বা অবজ্ঞা করব না। চিকিৎসার বিনিময়ে মুনাফা অর্জনের চেষ্টা থেকে বিরত থাকব। ’ হিপোক্রেটিস বিশ্বাস করতেন, সব ধরনের চিকিৎসাই নিঃস্বার্থ এবং মানবসেবার অন্তর্গত। তাঁর এই দার্শনিকতা বোধকে সারা বিশ্ব মর্যাদা দিয়েছে। এবং চিকিৎসকদের মধ্যে গভীর মূল্যবোধ গড়ে তুলতে চেয়েছে। চিকিৎসাশাস্ত্রের পড়ুয়া এবং পেশাদার চিকিৎসকেরা এই দর্শনকে, এই নৈতিকতাকে বিশেষ গুরুত্ব দেবেন, এটাই একান্ত কাম্য। বিশ্বের এবং আমাদের দেশের মহান চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের সামান্য অংশ আদর্শ দৃষ্টান্ত স্থাপনে সক্ষম হয়েছেন। আবার এ রকম চিকিৎসক ও চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান আকছার দেখা গেছে, যারা আর্থিক মুনাফাকে বিশেষ প্রাধান্য দিয়ে পরিষেবা আর সেবাধর্মকে অবমাননা করছেন। এই প্রবণতা বিপজ্জনক। এতে রোগী, চিকিৎসক, চিকিৎসা ব্যবস্থার আন্তঃসম্পর্কের অবনতি ঘটে। ডাক্তারদের ব্যাপারে অপবাদ, অভিযোগ ও গুজবের রাস্তাও প্রশস্ত হয়। আশা করি আপনার উত্তর পেয়েছেন।
ডা. ফাহমিদ ‘বুদ্ধিজীবী’-এর মতো দেখতে নন, বুদ্ধিজীবীই বটে। আমি বলি:
-সেটা ঠিক আছে। তাহলে চিকিৎসা দর্শন ডাক্তারদের কী শেখায়? পেশাদারিত্ব, সেবা না রোগ নিরাময়ের বিনিময়ে অর্থ সঞ্চয়?
এই ভাবুক চিকিৎসক আমাকে ব্যাখ্যা করতে থাকেন:
-এটা ঠিক যে, অর্থ ছাড়া কারও সংসার চলে না। চিকিৎসকেরও টাকার প্রয়োজন। তাই বলে প্রয়োজনের সঙ্গে প্রলোভনকে, মোহকে, আত্মসর্বস্বতাকে, অহঙ্কারকে জড়িয়ে ফেলা উচিত নয়। অসুখ নিয়ে নিরুপায় হয়ে মানুষ আমাদের কাছে আসে। একজন সুচিকিৎসককে তখন তাদের প্রাথমিক পরীক্ষার পর যথাসম্ভব দ্রুত সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে নিজেকেই প্রশ্ন করতে হয়-‘চিকিৎসকের প্রধান লক্ষ্য কী? অর্থ উপার্জন? রোগ নির্ণয়? রোগীর উপশম?’ একজন সুচিকিৎককে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে যথাযথ চিকিৎসা আর নিরাময়ের মাধ্যমে। পাশাপাশি এই অব্যক্ত সঙ্কল্প পোষণ করতে হবে যে, রোগী যেন হাসতে হাসতে বাড়ি ফেরেন। এই সঙ্কল্পের সঙ্গে যে নৈতিকতা জড়িত, তার নাম চিকিৎসা দর্শন। যে কোনও সহজ বা দুরারোগ্য ব্যাধি সারাতে না পারা মানেই চিকিৎসকের পরাজয়। একজন চিকিৎসক যখন চিকিৎসা করেন, তখন তিনি একই সঙ্গে যোদ্ধা এবং শান্তির প্রবক্তা। তার যুদ্ধ রোগীর সঙ্গে বা অর্থ উপাজনের সঙ্গে নয়। রোগের সঙ্গে। নিরাময়কে আয়ত্ত্বে আনবার জন্য। চিকিৎসা একই সঙ্গে চিকিৎসক নিজের এবং রোগীর মুখে হাসি ফোটায়। চিকিৎসা দর্শন রোগী ও চিকিৎসকের মুখে হাসি দেখতে চায়। সাফল্য, বিজয়, আনন্দের হাসি।
কিছু সময়ের জন্য থামলেন ডা. ফাহমিদ। তারপর আবার বললেন:
-হ্যা, আরেকটি কথা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। ভালোবাসা। চিকিৎসকের প্রধান দায়িত্ব রোগীকে, মানুষকে ভালোবাসা। গভীর ও নিঃস্বার্থ ভালোবাসা। এটা শুধু চিকিৎসার নয়, যে কোনও পরিষেবার প্রথম ও প্রাথমিক শর্ত। যদি কাউকে ভালোবেসে চিকিৎসা শুরু করা হয়, তাহলে অনতিবিলম্বে ডাক্তার ও রোগীর মধ্যে সুন্দর ও আস্থার সম্পর্ক গড়ে উঠবে। যে রোগী ডাক্তারকে আপনজন ভাবার সুযোগ পায়, তার রোগের উপশম অপেক্ষাকৃত সহজ। কেননা আস্থা আর ভরসা রোগীর আত্মবিশ্বাসকে বাড়িয়ে দেয়। ওষুধ প্রয়োগে তার প্রাণশক্তি দ্রুত বেগে আরও বেড়ে যায়। মানসিক চিকিৎসায় আমাদেরকে এসব ব্যাপার মমতার সঙ্গে লক্ষ্য রাখতে হয়।
তত্ত্বগত দিক থেকে ডা, ফাহমিদের কথা সত্য। হয়ত অনেকেই এসব কথা মেনেও চলেন। তারপরেও বাস্তবে রোগীরা ডাক্তারদের যথেষ্ট মনোযোগ, যত্ন, ভালোবাসা এবং চিকিৎসা পায় না। মাদকাসক্ত ও মানসিক রোগীর জন্য কেবল ওষুধ বা পথ্য নয়, প্রয়োজন সামগ্রিক চিকিৎসা ও প্রেরণা। সেটারই বড় অভাব। এ ধরনের তর্ক এক-দুই কথায় শেষ হবে না। আমার নিজের কাজের কথা আলোচনা করা দরকার। আমি প্রসঙ্গ কিছুটা পরিবর্তন করে জানতে চাই:
-মাদক গ্রহণ সমস্যাকে মানসিক রোগের আওতায় ফেলা যায় ? কেন ও কি কারণে মাদকাসক্তি ? কেমন তার চিকিৎসা ?
ডা. ফাহমিদ সরাসরি আমার দিকে তাকিয়ে খানিকক্ষণ অপলক চেয়ে রইলেন। মনে হল, তিনি উত্তর সাজাচ্ছেন:
-মানসিক রোগের কারণ ও চিকিৎসা নিয়ে চিকিৎসা বিজ্ঞানীরা নানা রকম মতবাদ পোষণ করলেও ব্যাপারটা হয়ে দাঁড়িয়েছে বিরাট একটি ধাঁধার মতো। যেমন, মানুষ যখন শিশু হিসাবে ভূমিষ্ঠ হয়, তার মনের অবস্থাটি তখন থাকে নিরাকার। তারপর সে বড় হতে থাকে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বৃদ্ধি পায় তার মানসিক অভিজ্ঞতা। তার চিন্তা-ভাবনায় আসতে পারে নানা ধারণা। মূল্যবোধ, মনের দিক থেকে অভিযোজন ক্ষমতা, বিচারবুদ্ধি প্রভৃতি। সেই মত সে গড়ে তোলে আচরণ। আসে সঙ্গতি বা অসঙ্গতি।
আমি ঠিক বুঝতে পারছি না ডা. ফাহমিদের কথাগুলো। উৎসুক্য নিয়ে তাকাতেই তিনি আমার মনের অবস্থা টের পেয়ে আরেকটু সহজ করে বললেন:
-আপনাকে উদাহরণ দিয়ে বুঝাচ্ছি আচরণের সঙ্গতি ও অসঙ্গতি কেমন করে নির্ভর করছে ব্যক্তির উপর। যেমন, কোনও কোনও অভিজ্ঞতা কারও কারও মনের উপর প্রচণ্ডচাপ সৃষ্টি করে, আবার নিজস্ব অভিযোজন-ক্ষমতার দরুন সেই চাপ মানুষ কাটিয়েও ওঠে। আবার অনেকে তা পারে না। জাপানের নাগাসাকি ও হিরোশিমায় পরমাণু বোমা নিক্ষিপ্ত হওয়ার পর অনেকে শহর ছেড়ে আত্মরক্ষার তাগিদে পালিয়ে গিয়েছিল। সে সময় নিকটজনের কথা মুহূর্তের জন্যেও তারা ভাবতে পারে নি। কয়েক দিন পর তারা শহরে ফিরে এসে দেখতে পায় তাদের ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। পুত্রকন্যা, স্ত্রী, আত্মীয় সব মৃত। এমন নিদারুণ অভিজ্ঞতায় অনেকে উন্মাদ হয়ে নদীতে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। হঠাৎ মানসিক ভারসাম্য হারিয়েই তারা এমনটি করেছিল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় বহু সৈনিকও হত্যালীলার অভিজ্ঞতায় বিভ্রান্ত হয়ে পাগল হয়ে যায়। নিকটজনের মৃত্যু, আঘাত, বিচ্ছেদ ইত্যাদি সহ্য করতে না পেরে অনেকে অবসাদজনিত রোগে আক্রান্ত হয়। বহু ক্ষেত্রে আর্থ-সামাজিক, শারীরিক বা যৌন সমস্যাও মনের উপর চাপ সৃষ্টি করে। স্বামী-স্ত্রী, প্রেমিক-প্রেমিকার পারস্পরিক বিশ্বাস ও মূল্যবোধের মধ্যে দ্বন্দ্ব তৈরি হলেও মানসিক রোগ এসে হানা দেয়। তখন অনেকেই প্রথমে সাময়িক মুক্তির জন্য নেশার জগতে চলে যায়। পরে চরম অভ্যাসের জন্য সেখান থেকে আর ফিরতে পারে না।
ডা. ফাহমিদকে থামিয়ে আমি জানতে চাই:
-একই অভিজ্ঞতা, তাতে কেউ মানসিক ভারসাম্য হারায়, কেউ হারায় না। তার কারণ কী?
হাসলেন ডা. ফাহমিদ:
-বেশ ভালো প্রশ্ন করেছেন। মনোবিজ্ঞানীদের ধারণা, ব্যক্তিবিশেষের মনের আধারের মধ্যেই থাকে তাবৎ মানসিক ঘটনা। বিশ্বখ্যাত শিল্পী সালভাদর দালি বিষয়টিকে ‘স্বপ্নদৃশ্য’ নামের একটি বিখ্যাত চিত্রে তুলে ধরেছেন। আসলে ভীতি, ক্রোধ, অবসাদ, হতাশা ইত্যাদি মানব চিন্তাক্ষেত্রে অসংলগ্নতার বীজ বপন করে। বাহ্যিক পরিস্থিতির উপর সেটার বিকাশ ঘটতে থাকে। সেই বিকাশ একেক জনের কাছে একেক রকম। তাই দেখা যায়, একই ঘটনায় বা কারণে কেউ ক্রোধে ফেটে পড়ে; কেউ অস্বাভাবিক রকম শান্ত থাকে। অনেকে ব্যর্থতা ও মানসিক যন্ত্রণায় সৃজনশীল হয়, যার প্রতিফলন পড়ে সৃষ্টিতে, নির্মাণে, কাব্যে, উপন্যাসে, সঙ্গীতের জগতে। মানসিক অস্থিরতার গভীরে ডুবে থেকেও কী করে যে নিজেকে সৃজনশীলতার শীর্ষে নিয়ে বসাতেন ভ্যান গখ, সে এক বিস্ময়। রবি ঠাকুরও ব্যক্তিগত সব যন্ত্রণাকে আড়াল করে সৃষ্টির আলো জ্বেলে উদ্ভাসিত হয়ে আছেন।
আমি আগ্রহ ভরে আরও জানতে চাই:
-এখানে কোনও কোনও ব্যক্তির ক্ষেত্রে মাদক দ্রব্য গ্রহণের প্রসঙ্গটি কখন আসছে?
ডা. ফাহমিদ তার ব্যাখ্যা দিতে থাকেন:
-মাদক দ্রব্য গ্রহণের পেছনেও কাজ করে অস্থির মানসিকতা। হতাশা, ব্যর্থতা। নিজের মধ্যে আস্থা ও সাহস হারালে জলে ভাসা মানুষ যেমন খড়-কুটো ধরে বাঁচতে চায়, মাদক গ্রহণ তেমনই একটি কাল্পনিক ভালো থাকা। দেখা গেছে, অনেক সময় এমন ঘটনা ঘটে, যা মনের উপর ক্ষোভ, ঘৃণা, চাপ সৃষ্টি করে। এর ফলে মস্তিস্কের স্নায়ুকোষেও চাপ পড়ে। সেখান থেকে তখন এমন কোনও রাসায়নিক যৌগ নির্গত হয়, যারা প্রভাবিত করে শরীরের বিভিন্ন স্নায়ুকে। স্নায়ুতন্ত্র তখন সে মানুষের নিয়ন্ত্রণে থাকে না। এই অবস্থায় কারও হাত কাঁপে, কারও মৃত্যুভয় বা আত্মহত্যার প্রবণতা দেখা দেয়, কেউ স্মৃতিভ্রংশ হয়, অবসাদগ্রস্থতায় আচ্ছন্ন হয়। এটা শারীরিক বা মানসিক আঘাত, উত্তেজনা বা বিরূপতার জন্যে হতে পারে। তখন যে নিজেকে স্থিরভাবে সামলাতে পারে, সে ভাগ্যবান ও সুস্থ। যে পারে না, সে অসুস্থ হয় কিংবা মাদকে আক্রান্ত হয়।
অনেক কথার পর ডা. ফাহমিদ আমার হাতে কয়েকটি কেসস্টাডি দিলেন। মাদকসেবী রোগীদের হিস্ট্রি আছে সেগুলোতে। মূলত প্রেমে বা জীবনে ব্যর্থতা, অপ্রাপ্তি ইত্যাদি হতাশায় আক্রান্ত হয়ে তীব্র মাদকাসক্তি নিয়ে যেসব রোগী তার কাছে এসেছে, এতে তাদের বিবরণ আছে। দিনে দিনে এরা সংখ্যায় বাড়ছে। এরাই মাদক ব্যবসার প্রধান ভোক্তা।
বিদায় জানানোর আগে ডা. ফাহমিদ বললেন:
-এদেরকে বোঝার চেষ্টা করুন, আর মাদকের উৎস ও রুট চিনে নিন। দুটোকে মেলাতে পারলে আপনার গবেষণার অনেকটা পথ খুলে যাবে।
আমি তার কথার সঙ্গে একমত হই:
-সত্যিই বলেছেন ডাক্তার। কিন্তু নীল নেশার ধুয়াক্রান্ত সোনালী ত্রিভুজের প্রতিটি বাহু কি প্রকাশ্যে থাকে ? তাদেরকে কি স্পষ্ট দেখা যাবে ?
গম্ভীর কন্ঠে ডা. বললেন:
-ঠিক কথা। তারপরও আমাদেরকে চেষ্টা চালাতে হবে। অন্ধকার থেকে আলোর অভিমুখকে বের করতে হবে।
ডা. ফাহমিদ তার ব্যক্তিগত মোবাইল নম্বর দিয়ে যখন ইচ্ছা তখন যোগাযোগের জন্য বললেন। কয়েকটি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রের ঠিকানা দিলেন। হাসপাতাল থেকে বের হয়ে ঢাকার বিখ্যাত জনারণ্যে মিশে আমার মনে হলো, এখানে হাজার মানুষ পাওয়া যাবে, তাদের মনের গোপন জগতের দেখা পাওয়া যাবে কিভাবে? কেমনে জানা যাবে, নদীর অন্তঃস্রোতের মতো বহমান মানব-মনের চোরা স্রোতের দিশা। চলবে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪০০ ঘণ্টা, আগস্ট ২৮, ২০১৭
জেডএম/