ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

উপন্যাস

নীল উড়াল: ত্রয়োদশ পর্ব

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬১৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৫, ২০১৭
নীল উড়াল: ত্রয়োদশ পর্ব নীল উড়াল

নায়ক ম্যাকগিল ভার্সিটির অধ্যাপক-লেখক-অভিবাসী বাংলাদেশি। ফরাসি সুন্দরী মার্গারেট সিমোনের প্রণোদনায় দেশে মাদকচক্র নিয়ে গবেষণাকালে ঘটনা মোড় নেয় রোমাঞ্চকর বাঁকে। আসে ধুরন্ধর বন্ধু-অস‍ৎ ব্যবসায়ী এনামুল, সুন্দরী স্টাফ রোকসানা, মধুচক্রের জেনিফার-মলি-পরী, ক্লিনিকের অন্তরালের মিসেস খোন্দকার, রমনার শফি মামা ও ফুলি, ‘উড়াল যাত্রা’র সাইফুল, বিড়ালের কুতকুতে চোখের তরুণ সাংবাদিক ফরমানউল্লাহ এবং ছোটখালার রহস্যময় মেয়ে অন্তরা। প্রেম ও বেঁচে থাকার যুগল উড়ালে কাহিনী আবর্তিত হতে থাকে।

১৩.
ইন্টারকমের শব্দে চমকে উঠার মতো কোনও কারণ নেই; কিন্তু এই ফ্ল্যাটে অভ্যন্তরীণ ফোন যোগাযোগের যন্ত্রটি বেজে উঠতেই আমি কিছুটা আঁতকে উঠি। এখানে যে একটি ইন্টারকম আছে, সেটাই আমার মনে থাকে না।

না থাকার কারণ, আমি কাউকে ঠিকানা দিই নি, যোগাযোগ করতে বলি নি। তারপর যখন ফোন বাজে বিচলিত হয়ে ভাবি, কে? আসার মতো কেউ নেই, তার মধ্যে থেকে কে ফোন করেছে, সেটা ভেবে বের করা কলম্বাসের আমেরিকা আবিষ্কারের মতোই কঠিন। দ্বিধা জড়ানো কণ্ঠে ফোন রিসিভ করি:
-হ্যালো!

নীল উড়াল: দ্বাদশ পর্ব

ওপাশ থেকে বেশ সাবলীল গলায় উত্তর  পেলাম:
-স্যার, রিসিপশন থেকে বলছি। আপনার নামে একটি পার্সেল এসেছে।

কয়েক মুহূর্ত ভাবতে ভাবতে চলে গেল। ব্যক্তিই চিহ্ণিত করতে পারছি না, আবার বস্তু? এই বস্তু কোত্থেকে এলো? আমার ভাবনা প্রলম্বিত হয়।

রিসিপশনের গার্ডের তাড়া শুনতে পেলাম আবার:
-স্যার!

সম্বিত ফিরে আমি ওকে নিদের্শ দিলাম:
-ঠিক আছে, রুমে পাঠিয়ে দিন।

ফোন রাখতে না রাখতেই দরজায় ডোরবেল বাজিয়ে গার্ড প্যাকেট দিয়ে গেল। এসব আধুনিক ফ্ল্যাটের অনেক অসুবিধা ও বিচ্ছিন্নতার পরেও সুবিধার দিকগুলোকে খাটো করা চলে না। প্যাকেটের ভেতর এক গাদা কাগজ, সাংবাদিক শামীম পাঠিয়েছেন। সঙ্গে চিরকুটে লেখা: ‘আপনার জন্য প্রয়োজনীয় কিছু তথ্য পাঠালাম। ’

শর্মী চক্রবর্তী নামে এক তরুণ সাংবাদিক ও উন্নয়ন কর্মীর একটি রিপোর্ট পাঠিয়েছেন শামীম। নেশার জগতকে ঘিরে ঢাকায় লিভ টুগেদার আখ্যান রচিত হয়েছে সেখানে। দেরি না করে আমি রিপোর্টে নজর দিই:...কিমু এবং রেহান (নিশ্চয় ছদ্মনাম)। ধানমন্ডির এক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী। একই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিলেন তারা। পরিচয় থেকে ঘনিষ্ঠতা। ধীরে ধীরে জড়িয়ে পড়েন অমিয়-গরল এক সম্পর্কে। দ্বিধা-সঙ্কট উতরে বাসা ভাড়া নেন একসঙ্গে। এরপর তিন বছরের কিছু বেশি সময় স্বামী-স্ত্রীর মতো বসবাস। যদিও ধর্মীয় বা আইনগত কোন দিক থেকেই তারা স্বামী-স্ত্রী নন। দু’জনেই জানালেন ভাল আছেন তারা।

কিমু আর রেহান একা নন। রাজধানী ঢাকা শহরে তাদের মতো জুটি এখন অনেক। বিয়ে না করেই সংসার করছেন তারা। আবার অনেকে জড়িয়ে পড়ছেন একাধিক সম্পর্কে। অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে নানা চমকপ্রদ তথ্য। উচ্চবিত্তের দরজা পেরিয়ে লিভ টুগেদার পৌঁছে গেছে মধ্যবিত্ত আর নিম্নবিত্তের দরজায়। অনেক টিনেজও নিজেদের জড়িয়ে নিচ্ছেন এ গন্তব্যহীন সম্পর্কে। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের মধ্যেই এ প্রবণতা বেশি। অনেকেই নিজেদের বিলাসবহুল জীবনের চাহিদা মেটানোর জন্য এ সম্পর্কের মধ্যে নিজেদের জড়িয়ে নিচ্ছেন। সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যমের অধিক প্রচলনের কারণেই এসব ঘটনা ঘটছে সহজে। মনোবিজ্ঞানীরা বলছেন, সমাজের মূল্যবোধের পিলারে ক্ষয় সৃষ্টির কারণেই এসব ঘটনা ঘটছে। কিমু আর রেহান জানালেন, আমাদের মধ্যে বাধা-ধরা কিছু নেই। এ সম্পর্ককে কোন সামাজিক রূপ দেবেন কি না, তাও তারা জানেন না। অন্যদিকে কিমু বলেন, আমি আমার পরিবারের পছন্দেই বিয়ে করব। কিন্তু এর পরও রেহানের সঙ্গে তার সম্পর্ক এভাবেই চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি। দু’জনেই বিলাসবহুল জীবন কাটাচ্ছেন। যখন যা ইচ্ছা তাই করছেন। কারও তরফ থেকে কোন আপত্তি নেই।

এমনই আরেকজন অধরা। খুবই দরিদ্র পরিবারের মেয়ে। কিন্তু তার চাওয়া আকাশছোঁয়া। যখন দশম শ্রেণিতে পড়ত তখনই সম্পর্ক হয় তার চাচাতো ভাই নিলয়ের সঙ্গে। যে সম্পর্ক একসময় ঘনিষ্ঠ আকার ধারণ করে। প্রয়োজন মেটানোর জন্যই নিলয়ের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়েছিল অধরা। নিলয়ও যখন যা পারতো তা দিত অধরাকে। তবে এ সম্পর্কে বেশিদিন নিজেকে ধরে রাখতে পারেনি অধরা। সে যখন এইচএসসি পরীক্ষা দেবে তখন তার নজর কাড়ে তার এলাকার শিক্ষক অমলেন্দু। অমলেন্দু ছিলেন ইংরেজির শিক্ষক। তার কাছে ইংরেজি পড়ার কৌশল গ্রহণ করে অধরা। অমলেন্দুকে অনুরোধ করে যেন তাকে ব্যাচে পড়ার সুযোগ দেয়া হয়। অধরার উদ্দেশ্য ছিল অমলেন্দুর কাছে যাওয়া, পড়া নয়। যখনই সে কোচিং ক্লাসে যেত পড়ার দিকে মনোযোগ না দিয়ে তাকিয়ে থাকত তার দিকে।

হঠাৎ একদিন মাঝরাতে অমলেন্দুর মোবাইলে ফোন। তিনি ফোন রিসিভ করে অনেকবার হ্যালো হ্যালো করলেও ওপাশ থেকে কোন সাড়া আসছিল না। ফোন রেখে দিয়ে তিনি বুঝতে পারলেন এটা অধরার ফোন। পরের দিন অধরাকে জিজ্ঞেস করলেন। কিন্তু সে প্রথমত অস্বীকার করল। এরপর শুরু হয়  ফোনে কথা বলা। তখন অধরা তাকে বলল, স্যার আমি আপনার সঙ্গে কিছু কথা বলতে চাই। আপনি কি একটু চন্দ্রিমা উদ্যানে আসবেন। অমলেন্দুও রাজি হয়ে গেলেন। সেখানে যাওয়ার পর অধরা শুরু করল তার গল্প। নিলয়ের বিভিন্ন ছলনার কথা বলে অমলেন্দুর কাছে সহানুভূতি পাওয়ার চেষ্টা করলো সে। তিনি ভাবলেন মেয়েটা আসলেই অসহায়। আর অধরা এ বিষয়টি পুঁজি করে অমলেন্দুর কাছে যাওয়া-আসা শুরু করল। অমলেন্দু হিন্দু হয়েও আর নিজেকে অধরার কাছ থেকে দূরে রাখতে পারল না। শুরু হলো নতুন গল্পের। তখনও অধরার নিলয়ের সঙ্গে সম্পর্ক ছিল। তার পরও সে অমলেন্দুর সঙ্গে আবার সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ল। এভাবে চলতে চলতে যখন অমলেন্দু দুর্বল হয়ে পড়ল তখন অধরার সব কিছু দেখাশোনার দায়িত্ব নিয়ে নিল সে। অধরা তার পরিবারে প্রবেশ ঘটালো অমলেন্দুর। সে হয়ে গেল পরিবারের একজন। মায়ের কাছে হয়ে গেলো ছেলে আর অধরার কাছে বড় ভাই। আর এসবের আড়ালেই চলছিল তাদের সম্পর্ক, যা পুরোপুরি স্বামী-স্ত্রীর মতো।

অন্যদিকে, সুযোগ পেলেই অধরা কয়েক দিনের জন্য বেরিয়ে পড়ত নিলয়ের সঙ্গে। এসবের দিকে পরিবারের ছিল না কোন নজরদারি। প্রায় সময়ই মিথ্যা কথা বলত পরিবারের কাছে। এর কারণ অধরার বাবা-মায়ের সম্পর্ক তেমন ভাল ছিল না। তবে এগুলোকে তোয়াক্কা করত না অধরা। একদিকে বাবা-মা ঝগড়া করত, অন্যদিকে সে তার নিজের মতো চলত। একপর্যায়ে অমলেন্দু অধরাকে ভর্তি করায় একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে। আর তখন থেকেই তাদের সম্পর্কের মধ্যে দেখা দেয় ফাটল। কারণ সেখানে গিয়ে আরও নতুন সঙ্গীর সাহচার্যে পড়ে গেলো অধরা। যারা অমলেন্দুর চেয়ে বেশি বিত্তশালী। দিনের পর দিন অমলেন্দুর সঙ্গে মিথ্যা বলার মাত্রা বেড়ে যায় অধরার। অন্য আরেক ছেলের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ল সম্পর্কে। তবে একেবারে ছেড়ে দেয়নি অমলেন্দুকে। প্রয়োজন মতো সে আসত তার কাছে।

আর এসব বুঝতে পেরেও অমলেন্দু কিছু করতে পারেননি। নির্বাক ভূমিকা পালন করেন তিনি। তার পরও ছুটে যায় অধরার কাছে। কারণ, তিনি অধরাকে ভালবাসতেন। অন্যদিকে অধরা পরপর আরও দুটি সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। ঢুকে যায় নেশার জগতে। আর সেই নেশাকে সে অভিহিত করে বর্তমানের ফ্যাশন হিসেবে। একজন অধরার ছোট। কিন্তু এটি তার চাহিদার কাছে কোন বিষয় ছিল না। এ পর্যায়ে সরে যেতে থাকলেন অমলেন্দু। কারণ সে বুঝতে পারছিল এ বিলাসবহুল ও অন্ধকার জীবন থেকে অধরাকে সরিয়ে আনা যাবে না। শুরু করলেন নিজের ওপর নির্যাতন তাকে ভুলে থাকার জন্য। নিজেও প্রবেশ করলেন নেশার জগতে। ঠিকমতো কাজও করতেন না। কিন্তু অন্যদিকে অধরা নতুন সঙ্গী নিয়ে তার সামনে দিয়ে অবাধে চলতে শুরু করল। এসব যেন তার কোন বিষয়ই নয়। এখনও চলছে ঠিক একই অবস্থাতে। অধরার মধ্যে আসেনি কোন পরিবর্তন। বাবা-মা চেষ্টা করেছেন মেয়ের বিয়ে দেয়ার জন্য। কিন্তু সে তাতে রাজি নয়। অমলেন্দুর কাছে অধরা, অধরাই থেকে যাবে।

শুধু অধরাই নয় বর্তমানে অনেক মেয়েই জড়িয়ে পড়ছে এ রকম সম্পর্কে। এমনি আরেকজন তন্বী। সে প্রায় দুই বছর কামালের সঙ্গে লিভ টুগেদার করছে। তন্বী বলে বিয়ে মানেই ঝামেলা। নিজের স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলা। আর এ সম্পর্কে কোন ভুল তো আমি দেখি না, যেখানে আমরা দু’জন রাজি। আমি আমার ক্যারিয়ার নিয়ে অনেক বেশি ভাবি। বাইরের দেশে ইউরোপ-আমেরিকায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে চাই। বিয়ে করে ছেলেমেয়ের ভার নিতে চাই না। সংসারের ঘানি টানতে চাই না। কারণ নিজেকে বিবাহিত বলে পরিচয় দিলে আমার ক্যারিয়ার গড়তে অনেক সমস্যা হতে পারে এ জন্যই আমি লিভ টুগেদার করি।

আবার এমন অনেক ছেলেও আছে যারা ওই সব মেয়ের মতো ধারণা পোষণ করে না, তারা কেবল জৈবিক কারণে লিভ টুগেদার করছে।

লিভ টুগেদার আর বহুমুখী এ সম্পর্কের ব্যাপারে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক মনোবিজ্ঞানী ড. নাসরীন ওয়াদুদ বলেন, লিভ টুগেদার বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আর এর ব্যাপক বৃদ্ধির কারণ হলো আমাদের সমাজে যে পিলারগুলো ছিল তা ক্ষয়ে যাচ্ছে। আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ তথা পরিবার ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। পারিবারিক যে শিক্ষাটা সেটাই তারা এখন সেভাবে নিচ্ছে না। আর অপসংস্কৃতির প্রভাব তো আছেই। যাতে প্রভাবিত হয়ে এখনকার ছেলেমেয়েরা এসবের দিকে প্রভাবিত হচ্ছে। উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়ের মধ্যে যেমন এর প্রবণতা আছে, এর সঙ্গে সঙ্গে এখন মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেমেয়েকে এদিকে বেশি ঝুঁকতে দেখা যাচ্ছে। তারা তাদের পারিবারিক সব মূল্যবোধ হারিয়ে এ পথে এগিয়ে যায়। আর এসবের কারণে সমাজ হারিয়ে ফেলছে তার পরিচয়। এখন মানুষ বিবাহ বন্ধনে বিশ্বাসী না। তারা মনে করে, এতে অনেক দায়িত্ব, তাই নিজেরা নিজেদের মতো করে এ সম্পর্ক গড়ে তুলছে, যাতে তারা পূর্ণ স্বাধীনতা পেতে পারে। আর এসবের কারণে বাড়ছে ডিভোর্স। ভালবাসা শুধু এখন দেহনির্ভর। যার মধ্যে নেই মনের কোন আবেদন। আর এসবের কারণে দিন দিন সমাজ ধাবিত হচ্ছে ধ্বংসের দিকে। নেশার দিকে। অন্ধকারের দিকে।

রিপোর্ট পড়া শেষে আমার মুখ ম্লান হয়ে আসে। নেশা অক্টোপাসের মতো কত দিকে ছড়িয়ে যাচ্ছে। নানা পয়েন্ট নোট করতে করতে আমার নোটবুক ভরে যায়।

বাংলাদেশ সময়: ১২১৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৫, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

উপন্যাস এর সর্বশেষ