সাংবাদিক দম্পতি রুনি-সাগর হত্যাকাণ্ডের তদন্ত ও দোষীদের গ্রেফতারের বিষয়ে কত আন্তরিকতা দেখল দেশবাসী! কেবল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বা পুলিশের আইজি নয়, খোদ প্রধানমন্ত্রী দেখভাল করছেন। তাহলে এখনও আমাদের বিচার চাইতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচী পালন করতে হচ্ছে কেন?
৪৮ ঘণ্টা নয়, ঘটনার ৪৯ দিন পরও কেন তদন্ত শেষ হলো না? কী কারণে এ রহস্য এখনও ধামাচাপাই রয়ে গেল? এ জিজ্ঞাসা আমার।
আমার সহকর্মী এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহরুন রুনি আর এক সময়ের ইত্তেফাকের এনার্জি বিটের প্রাণচঞ্চল রিপোর্টার মৃত্যুর আগে যিনি যোগ দিয়েছিলেন মাছরাঙ্গা টিভিতে বার্তা সম্পাদক হিসেবে। ওদের অপমৃত্যু হবে আমি কখনই ভাবিনি। এখনও বিশ্বাস করতে পারি না।
সাংবাদিক মৃত্যুর মিছিলে যোগ হলো এ প্রজন্মের পথিকৃত সাংবাদিক মিনার মাহমুদের নাম। গত ২৯ মার্চ বৃহস্পতিবার তার লাশ উদ্ধার হলো রাজধানীর খিলক্ষেত এলাকার পাঁচ তারকা হোটেল রিজেন্সির একটি কক্ষ (৭০২৮ নম্বর) থেকে। খালি হাতে তিনি ঢুকে ছিলেন হোটেলে! সিসি ক্যামেরার ছবি সে তথ্য দেয় আর হোটেল ম্যানেজমেন্ট ও মিডিয়ার সাথে বলেছে, তারা রুম সার্ভিস থেকে কোনো খাবার সরবরাহ করেনি। তাহলে র্যাবের তথ্যে বিভিন্ন ধরনের বোতল, বিপুল পরিমাণ ওষুধ কিভাবে এলো রুমে। এ মৃত্যু কি রহস্যাবৃত থাকবে?
ভীষণ মনে পড়ে আমার রুনির কথা। ওর সাথে সবশেষ ওর মৃত্যুর একদিন আগে এটিএন বাংলার কিচেনরুমে দেখা হয়েছিল। সেদিন আমাকে আমার জমজ সন্তান ঐতিহ্য আর ঐশ্বর্যের ছবি তোলার ব্যাপারে কিছূ পরামর্শ দিয়ে রুনি বলেছিল, ‘ভাই আমার মেঘেরও ছোট বেলার ভালো ছবি রাখতে পারিনি। আপনি এখন থেকেই সুন্দর পোশাক পরালেই সে অবস্থায় ছবি তুলে রাখবেন। ’ সে পরামর্শ এখন শুধুই স্মৃতি!
ওর মৃত্যুর আগের দিন আমি, এটিএন বাংলার চেয়ারম্যান মাহফুজুর রহমান স্যার ও তার ছোট ভাই মাকসুদুর রহমান রঞ্জু স্যারের সাথে টাঙ্গাইলের সখীপুরে গিয়েছিলাম। সেখানে চেয়ারম্যান স্যার ও রঞ্জু স্যারকে ‘টাঙ্গাইলের সখীপুর উন্নয়ন ভাবনা’ নামের একটি সংগঠন সংবর্ধনা দেয়। সেদিন অনুষ্ঠান কাভারেজ করে অফিসে ফিরতে রাত ১২টা বেজে গিয়েছিল আমার। সেই রাতে অফিসে ফিরে তারপর সেই সংবর্ধনার নিউজ রেডি করে বাসায় ফিরতে প্রায় রাত তিনটা বাজে। বাসায় ফিরে আমার দুই ‘রাজপুত্রের’ (ঐতিহ্য আর ঐশ্বর্য) সঙ্গ দিয়ে ঘুমাতে ঘুমাতে ফজরের আজান পড়ে গেল। অভ্যাসবশত আমি সকাল সাতটার খবর দেখার জন্য ড্রইং রুমে এসে টিভি অন করে রিমোট নাড়াচাড়া করতে করতে হঠাৎ টিভিতে স্ক্রল দেখলাম ‘সাংবাদিক রুনি আর সাগরকে হত্যা করা হয়েছে রাজাবাজারের নিজ বাসার বেডরুমে’। নিউজটা দেখা মাত্র আমার তো বোবা হয়ে যাবার অবস্থা! এই অবস্থায় আমি এটিএন বাংলার নিউজরুমে ফোন করলাম। জানালাম, জানলাম ঘটনা। তবে বিস্তারিত কিছুই জানতে পারলাম না। এরপর থেকে কত রংচঙা ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে শুরু করলো।
খোদ প্রধানমন্ত্রী বলে ফেললেন ‘কারো বেডরুমের তিনি নিরাপত্তা দিতে পারবেন না। ’ আমাদের প্রিয় নেত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা ভুলেই গেলেন যে উনার বাবা হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙ্গালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিজেও বেডরুমেই খুন হয়েছিলেন।
তার আগে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেফতারের ঘোষণা দিয়েও শেষ পর্যন্ত হয়নি। এর মধ্যে আবার পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) হাসান মাহমুদ খন্দকার বললেন, প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে এ হত্যাকাণ্ডের তদন্তে।
আর এ সুযোগে আমাদের সহকর্মী প্রিন্ট মিডিয়ার বন্ধুরা তো আমাদের কাপড় খুলে দেবার মতো করে লিখতে থাকলেন্ সাংবাদিক দম্পতি রুনি-সাগর হত্যাকাণ্ড নিয়ে। রুনি-সাগর হত্যাকাণ্ড বিষয়ে অনুমান নির্ভর যেমন ‘সাজানো নাটক জজ মিয়া খুঁজছে পুলিশ’ এরকম সংবাদ প্রকাশ বন্ধের বিষয়ে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পদক্ষেপ নেবার জন্য তথ্যসচিবকে নির্দেশ দিয়ে রুলও জারি করেছিলেন হাইকোর্ট। ২৮ ফেব্রুয়ারি হত্যাকাণ্ডের ১৮ দিনের মাথায় এ রুল ছাড়াও সুনিদিষ্ট তথ্য ছাড়া তদন্ত প্রভাবিত হয় এমন কোনো মন্তব্য না করার জন্যও তদন্ত কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেয় আদালত। সেদিন বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী ও বিচারপতি জাহাঙ্গীর হোসেনের হাইকোর্ট বেঞ্চে এ রিট আবেদন করা হয়েছিল। ওই হত্যাকাণ্ড ঘটনার তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে কেন গণমাধ্যমকে অবহিত করা হবে না তার নির্দেশনা চেয়ে মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস পিস ফর বাংলাদেশের পক্ষে এ রিট আবেদনটি করেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। তিনি জানিয়েছিলেন, সাংবাদিক দম্পতি রুনি-সাগরের খুনিদের কেন গ্রেফতার করা হবে না, এ বিষয়ে দুই সপ্তাহের রুল দিয়েছেন হাইকোর্ট। একই সাথে যত দ্রুত সম্ভব খুনিদের গ্রেফতারের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে।
এ বিষয়ে সুপ্রিমকোর্ট বার এসোসিয়েশনের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক বদরুদ্দোজা বাদল বলেছিলেন, এ হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত আসামিদের বিচারের আওতায় আনা হোক এটা সবাই চায়। এ বিষয়ে কারো আগবাড়িয়ে মন্তব্য করে তদন্তকে প্রভাবিত করা উচিত নয়।
সাংবাদিক দম্পতি হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে দায়ের করা রিটে স্বরাষ্ট্রসচিব, তথ্যসচিব, পুলিশের আইজি, র্যাবের মহাপরিচালক, ডিএমপি কমিশনার ও ডিসি দক্ষিণকেসহ মোট সাতজনকে বিবাদী করা হয়েছিল।
কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস পিস ফর বাংলাদেশের দায়ের করা রিটের পরিপ্রেক্ষিতে সাংবাদিক দম্পতি মেহেরুন রুনি-সাগর সরওয়ার হত্যাকাণ্ডের প্রকৃত কারণ নির্ণয় ও খুনিদের আইনের আওতায় আনতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে যে রুল জারি করেন হাইকোর্ট তার জবাব পাওয়া যায়নি।
২৩ মার্চ পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থার দুটি অগ্রবর্তী তদন্ত রিপোর্ট জমা দেওয়া হয় ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আলতাফ হোসেনের কাছে। আদালত গ্রীষ্মকালীন ছুটিতে থাকায় সে রিপোর্ট ও আদালতে জমা পড়বে ৮এপ্রিল। এই হলো এ মামলার তদন্ত অগ্রগতি। সম্প্রতি পুলিশের আইজি হাসান মাহমুদ খন্দকার এক অনুষ্ঠানে গণমাধ্যম কর্মীদের মুখোমুখি হয়ে বলেছেন, এ হত্যাকাণ্ড ধামাচাপা দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই। কারণ সবাই আন্তরিকতা নিয়ে যার যার দায়িত্ব পালন করছেন।
এই হত্যাকাণ্ড পরবর্তী সময়ে সহকর্মী সাংবাদিক বন্ধুরা,সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন ঐক্যবদ্ধভাবে মানববন্ধন, মিছিল, সমাবেশ কর্মসূচীও পালন করেছে। যে কর্মসূচীর বিষয়েও প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয়েছে বিভিন্ন পেশার মানুষের কাছে, কেন এত সময় নিয়ে আমাদের আন্দোলন কর্মসূচী?
সে বিষয়ে সঠিক কোনো উত্তর আমার অনুর্বর মাথায় আসেনি। তবুও তো আমাদের প্রাণের সংগঠন ডিউজে, বিএফইউজে, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটি ও জাতীয় প্রেসক্লাব এক প্ল্যাটফরমে এসে আন্দোলন করছে। এটা অবশ্যই বড় পাওয়া।
এই প্ল্যাটফরমের ব্যানারে ১ মার্চ মানববন্ধন ও সমাবেশ কর্মসূচী পালন করা হয়েছিল। সেদিনই ১৮ মার্চ মহাসমাবেশের ঘোষণা দেওয়া হয়। সে সমাবেশ থেকে আমাদের ঐক্যবদ্ধ প্ল্যাটফরমের পরবর্তী কর্মসূচী ৮ এপ্রিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘেরাও।
এত কিছুর পরও আমার প্রশ্ন আমাদের সহকর্মীর হত্যাকাণ্ডের তদন্ত কাজ আটকে থাকছে কেন? এখনও আমাদের বিচার চাইতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ঘেরাও কর্মসূচী পালন করতে হচ্ছে কেন?
রুনি-সাগর দম্পতির মৃত্যুর সময় বর্ষপূর্তি ((২৯ মার্চ) হয়েছে সাংবাদিক ফরহাদ খাঁ দম্পতি হত্যাকাণ্ডের। এর মধ্যে সাংবাদিকতার বিবর্তনের পথিকৃৎ সাংবাদিক মিনার মাহমুদ মারা গেলেন। জানি না, সাংবাদিক মৃত্যুর তালিকা আর কত দীর্ঘ হবে। কবেই বা সরকারের বোধোদয় হবে, টনক নড়বে!
লেখক: বিশেষ প্রতিনিধি, এটিএন বাংলা
ইমেইল: [email protected]
সম্পাদনা: রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর