বিজয় খুব ভাল বাঁশি বাজাতে পারে। ও আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের দু’বছরের জুনিয়র।
‘মিনার মাহমুদকে চিনতাম না, চিনতাম তার পত্রিকা বিচিন্তাকে। পত্রিকা দিয়ে যদি তাঁকে চেনার চেষ্টা করি, তাহলে তিনি একজন সাহসী সাংবাদিক, কিন্তু সাহসী একজন সাংবাদিক কি কাপুরুষের মত আত্মহত্যা করতে পারে? এর উত্তর আমার কাছে আছে। জাপানি ভাষায় হারাকিরি (এর আরেক নাম সেপ্পুকু) বলে একটা শব্দ রয়েছে, মূলত আত্মসম্মান বজায় রাখতে আত্মহনন। মিনার মাহমুদ আসলে হারাকিরির পথ বেছে নিয়ে নিজেকে বাঁচিয়ে গেলেন। ’
হারাকিরি শব্দটা সম্পর্কে আমার মোটেই কোনো ধারণা ছিল না। বিজয়ের লেখা দেখে প্রথম জানতে পারলাম। আত্মহত্যার আগে লিখে যাওয়া কথাগুলো জেনে মনে হয়েছে, কী বুকভরা অভিমান, অবহেলা নিয়ে চলে গেছেন তিনি। যে শহর এক সময় স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে কেঁপে উঠতো মিনার মাহমুদদের সাহসী প্রকাশনায়। সেই শহর থেকেই মিনার মাহমুদকে চলে যেতে হয়েছিল এক সময় ফেরারি হয়ে। মিনার যখন ফিরলেন নিজের শহরে, ততোদিনে শহরের মানচিত্র ঠিক থাকলেও পাল্টে গেছে অনেক কিছু। যারা তাকে শহরছাড়া করছিল, তারা এখন সরকারের সহযোগী। সারা দেশে মিছিল মিটিং করে দাবড়ে বেড়াচ্ছে। অথচ সেখানে মিনার মাহমুদের কোথাও সন্মানজনক জায়গা হয়নি জীবন চালানোর জন্য। বুকভরা অভিমান, হয়তোবা লজ্জা নিয়ে তিনি আবারও দেশ ছাড়লেন তবে এবার গেলেন না-ফেরার-দেশে। এই আত্মহত্যা তাই নিছক জীবন বিসর্জন নয়। এটা সমাজের বিরুদ্ধে একটা প্রতিবাদ, এটা হারাকিরি।
এক সময়ে যে শহরে মিনার মাহমুদ জুতো ক্ষয় করে চাকুরি খুঁজেছিলেন, তাকে আর দেখা যাবে না কোথাও। কেন মিনারকে হারিয়ে যেতে হলো নিজে থেকেই? মিনার মাহমুদ কি এতোটাই অযোগ্য ছিলেন তার নিজস্ব ভুবনে? মিনার মাহমুদ যেভাবে চলে গেলেন, যে কথা লিখে গেলেন মৃত্যুর আগে, সেই চলে যাওয়া কিংবা শেষ চিঠির ভাষাটা কি তার নিজস্ব ভুবনের লোকদের এতোটুকু ভাবাবে? আসলে সময়ের দাবিতে প্রতিটা পেশায় এতো্টাই প্রফেশনালিজম চলে এসেছে যে, কোনো ঘটনাই মানুষকে দু’দিনের বেশি ভাবায় না। মিনারের ঘটনাও হয়তো তাই হবে। যেভাবেই ব্যাখ্যা করা হোক না কেন মিনার মাহমুদকে স্বপেশায় ধরে রাখতে না পারা এবং সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডের বিচার চাওয়া থেকে ঝিমিয়ে পড়া ---দুটো ঘটনা সাংবাদিক এবং সাংবাদিকতার জগতে সবচেয়ে বড় পরাজয়।
আশির দশকে যারা বিন্দুমাত্র রাজনৈতিক সচেতন ছিলেন, কম বেশি পত্রিকা পড়তেন, তারা মিনার মাহমুদ কিংবা তার বিচিন্তাকে চিনতেন না, এ যেন অবিশ্বাস্য। মনে পড়ে পত্রিকাটি যেদিন বের হতো (সম্ভবতঃ দাম দু’টাকা ছিল), সকাল বেলা ঘুম থেকে উঠেই অপেক্ষা থাকতো হকার কখন আসবে। ঠিক প্রেমিকার জন্য প্রেমিকের বসে থাকার মতোই নিরবিচ্ছিন্ন প্রতীক্ষা। পত্রিকা আসতেই এক বসাতে পুরোটা পড়ে শেষ করা ছিল আমার অভ্যাস।
হঠাৎ করে সেই ব্যক্তি বাস্তবতার কারণে অনেক বছর নিজেকে লুকিয়ে রেখেছিলেন। সকলের অগোচরে হারিয়ে যাওয়া মিনার মাহমুদকে সেই সময়ের মানুষেরা এখনো এতো ভালবাসা নিয়ে মনে রেখেছে, সত্যি অবাক করার মতো। অগণিত মানুষের ভালবাসায় সিক্ত হচ্ছেন মিনার মাহমুদ। অনেকেরই হয়তো মিনারের মধ্যে জমে থাকা ক্ষোভ সম্পর্কে ধারণা ছিল না। থাকলে আমার বিশ্বাস তার বন্ধুদের কেউ কেউ নিশ্চয়ই তার জন্য কিছু করতেন। আসলে হার-না-মানা মানুষেরা কখনো নিজে থেকে কারো কাছে কিছু চাইবে না। তাদেরকে বুঝে নিতে হয়। সেই বুঝে নিতে ব্যর্থ হয়েছেন মিনার মাহমুদের বন্ধুরা। কিংবা ইচছাকৃতভাবে মিনার মাহমুদ নিজেকে বুঝতে দেননি। ঘটনা যেটাই হোক, তার মৃত্যুর মধ্য দিয়ে জানা গেল, শুধু পরিচিতরাই তার বন্ধু ছিল না। অজ্ঞাত সংখ্যক, অগণিত পাঠকের ভালবাসা ছিল তার জন্য, যাদের অনেককেই তিনি কখনো দেখেননি।
মিনার মাহমুদ সাহসী, মেধাবী হলেও বৈষয়িক ছিলেন না হয়তো। উনি বুঝতে পারেননি যে, এদেশে বেঁচে থাকতে হলে মতিউর রহমান হতে হয়, এরশাদ হতে হয়। মিনার মাহমুদরা এখানে বেঁচে থাকার অযোগ্য। কারণ তারা আপোষ করে না, কারণ তাদের হিপোক্রেসি নেই।
শনিবারের খবরেই দেখলাম, এরশাদ বলেছেন, “খেতে গেলে বিষ, বলতে গেলে পুলিশ। ” কথাটা সর্বাঙ্গে সত্য। কিন্তু সেটা কি এরশাদের মুখে মানায়? এই এরশাদই এতোদিন সরকারের সব কাজে সহযোগী ছিল। আজ গণ অসন্তোষের আভাস পেয়ে পিঠ বাঁচাতে আগে থেকেই বড় দু’দলের মধ্যিখানে অবস্থান নিয়েছে। যাতে হাওয়া বুঝে সেখানে যাওয়া যায়। প্রথম আলোর মতিউর রহমান সম্পর্কেও বিচিন্তায় এক সময়ে একটা রিপোর্ট এসেছিল। সেই মতিউর সাহেবেরাও বহাল তবিয়তে টিকে আছেন। একবার হাসিনার কাছে ক্ষমা চেয়ে, একবার বায়তুল মোকারমের খতিবের কাছে ক্ষমা চেয়ে এবং ভবিষ্যতে হয়তো সাম্প্রতিক প্রকাশিত একটা লেখার জন্য আজকের বিরোধী দলের কাছেও ক্ষমা চাইবেন। এভাবে আমরা প্রতিদিন শিখছি, ভালভাবে বেঁচে থাকতে হলে মতি হতে হয়, এরশাদ হতে হয়। মিনার হলে মরতে হয়। এই যখন শিক্ষা তখন সামনে আমরা কি আশা করতে পারি!
আজ মিনারের মৃত্যুতে তার ভক্ত, বন্ধুবান্ধব, সাংবাদিক-সমাজ থেকে শুরু করে সর্বস্তরে শোকের ছায়া নেমেছে। এমন সাহসী, প্রতিবাদী মানুষেরা শুধু মৃত্যুর পরেই সম্মান পান। জীবিত অবস্থায় অনেকেই এদের ভয় পায়। কারণ এদের সাহসী প্রতিবাদ থেকে হয়তো রেহাই পাবে না। কোনো কোনো আবেগী পাঠক বিভিন্ন স্বাধীন মিডিয়ায় তাই মিনারের আত্মহত্যার দায়ভার অনেকাংশে মিডিয়ার উপরেই চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন। কেউ কেউ বলছেন-
“……. তাকে নিয়ে (মিনার মাহমুদকে) দু’কলম লিখতে লজ্জা করা উচিত। যে লেখনী একজন মিনার মাহমুদকে বাঁচিয়ে রাখতে পারেনি, মৃত্যুর পরে মিডিয়ার ফালাফালি নেহায়েত ভণ্ডামী বলেই মনে হয়। এটা তারা যতোটা মিনার মাহমুদের প্রতি শ্রদ্ধা হিসেবে করছে, তার চেয়েও অধিকটা করে কর্পোরেট ভাবনা থেকে। ”
মিনার মাহমুদও হয়তো চলে যাবার আগে নিরবে বলে গেলেন, আসলে সাংবাদিকতার বর্তমান জগৎটা আমার নয়। আমার জগৎটা শেষ হয়ে গেছে সেই আশির দশকে। আজকে এখানে শুধু আপোষের খেলা। মতি, এরশাদদের উত্থানে মিনার মাহমুদেরা ক্রমশই দূরে চলে যাচ্ছেন।
[email protected]
বাংলাদেশ সময় ১১১৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ০১, ২০১২
সম্পাদনা:মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর।