বুকের পাঁজরে শুধু হারানোর বেদনা আর হাহাকার! সত্যিই না ফেরার দেশে চলে গেলো আরো একজন। শীলা আফরোজা, হাস্যোজ্জ্বল মেয়েটি, সাংবাদিকতার এক মেধাবী মুখ।
মৃত্যুর কালো ছায়া এভাবে ঢেকে দিচ্ছে কেন আমাদের মিডিয়াজগৎ?
দীনেশ ’দা, রুনি ও সাগর ভাই এর হত্যাযজ্ঞের বিচার পেলাম না এখনো, এরই মধ্যে সাহসীপ্রাণ মেধাবী অগ্রজ মিনার মাহমুদের আত্মহনন! এতোটাই শোকস্তব্ধ করে রেখেছিলো, মনের অনুভূতিগুলো লেখার জন্যে ল্যাপটপে হাত দিয়েও এগুতে পারিনি। মেধাবী এই সাংবাদিকের হতাশা আর বঞ্চনা তাকে ঠেলে দিয়েছে আত্মহননের দিকে। এই বেদনা প্রতি মুহূর্তে আমাকে তাড়া করে ফিরছে।
অথচ এই আত্মহনননের জন্যে যারা দায়ী, তারা বেশ শান্তিতে আর মৌজে আছেন। যদিও এদের কারণে আরো অনেক মেধাবী সাংবাদিক রাজধানী এবং দেশের নানান প্রান্তে কর্মহীন অথবা বিনাবেতনে বা নামমাত্র বেতনে কর্মরত। সুখের পায়রাদের সুখ কী আর শেষ হয় কখনো ? এদেশে যে নষ্টদের দখলেই সবকিছু থাকতে হয়।
মিনার মাহমুদকে নিয়ে যারা লিখছেন সুযোগ পেলে সবই প্রাণভরে পড়ি। আর ভাবি, এতো সহমর্মী, এতো বন্ধু তার ছিল, তবু বাংলাদেশের এই বিশাল মিডিয়াজগতে তার ঠাঁই হলো না কেন? আমরা এতো গোষ্ঠীকেন্দ্রিক বা ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে গেছি, মেধাবী সহকর্মীকে সাথে নেবার সাহস হারিয়ে ফেলেছি ? এভাবে মেধার অবমাননা আর বঞ্চনার পরিণতিতে বাংলাদেশের মিডিয়াকে অনেক মূল্য গুণতে হবে নিশ্চয়ই।
শীলার সাথে অনেক দিনের যোগাযোগ বিচ্ছিন্নতায় ভেবেছিলাম আরো অনেকের মতো বুঝি শীলাও দেশের বাইরে কোথাও চলে গেছে। বেশ ক’বছর আগে একবার (সম্ভবত ২০০৪-৫ সালে) আট মার্চে স্কয়ার গ্রুপের পক্ষ থেকে সফল নারীর প্রতিকৃতি হিসেবে শীলা আফরোজাকে নিয়ে একটি বিজ্ঞাপনচিত্র করেছিলো। এর আগে থেকেই তার সাথে আমার ভালো বন্ধুত্ব। শীলা যখন ভোরের কাগজে ছিল, আমি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা গেলে একসাথে আড্ডা দেয়া হতো। মাঝে মাঝে ফোন করে গল্পে মেতে উঠতো। তার বিজ্ঞাপনচিত্র দেখে তাই ভীষণ ভালো লাগায় মন ভরে গিয়েছিলো। ফোন করে অভিনন্দনও জানিয়েছিলাম। প্রাণোচ্ছ্বল শীলা বিনয়ের সাথে বলেছিলো, হঠাৎ করেই তাকে নিয়ে এ বিজ্ঞাপনচিত্র করেছে স্কয়ার। আমি গর্বের সাথে বলেছি, তার যোগ্যতা আছে বলেই তাকে এ স্বীকৃতি দিয়েছে। এর পরে কোনো এক সময়ে যথারীতি মোবাইল হারিয়ে তার নাম্বার হারিয়েছি, আর কথা হয়নি। এই মুহূর্তে মন এতোটাই ভারাক্রান্ত আমি জানি না আমি কী লিখছি। কোনোভাবেই ভাবতে পারছি না শীলার সাথে সত্যিই আর দেখা হবে না! তার এতো সুন্দর নির্মল হাসিটা আর দেখবো না? এ কী করে সম্ভব!
গত সাত-আট বছর ঢাকায় কাজ করার সময়ে মানসিক চাপ আর কাজের চাপে নিজে থেকে বন্ধুদের কারো সাথে তেমন যোগাযোগ করা হয়ে ওঠেনি। যারা নিজেরা ফোন করেছে হয়তো কথা হয়েছে। অবাক লাগছে আমরা কতোটা বিচ্ছিন্ন, শীলার এ মরণব্যাধিতে আক্রান্ত হবার খবরটা জানতেই পারলাম না?
সাপ্তাহিক ডে-অফে চট্টগ্রাম ফেরার তাগিদ আবার সময়মতো কাজে যোগ দেবার টেনশনে বন্ধু-সহমর্মীদের সাথে একটু একাত্ম হওয়া আর হয়ে ওঠেনি। দীর্ঘ যোগাযোগ-বিচ্ছিন্নতার কারণে শীলার শারীরিক অবস্থার কথা জানা ছিল না। ভীষণ অপরাধবোধে ভুগছি।
মঙ্গলবার বিকেল থেকে জরুরি কাজে ব্যস্ত ছিলাম ইন্টারনেট খোলাই হয়নি। রাতে বাংলানিউজে শীলার ছবি দেখে প্রথমে ভেবেছি তার নতুন কোনো সাফল্যবার্তা বুঝি পাবো। স্তব্ধ হয়ে গেলাম একের পর এক হেডলাইন পড়ে! না ফেরার দেশে? শীলা? কেন? কী করে? কী হলো? এতো প্রশ্ন নিজেকে করে জবাব পেলাম এ সংক্রান্ত সংবাদ এবং বন্ধুদের প্রতিক্রিয়া পড়ে। রুদ্ধশ্বাসে লিখতে বসে গেলাম। ঘড়িতে রাত দশটার বেশি বাজে। অফিসে বসে লেখাটা শেষ করে বাড়ি ফিরবো। শেষ কথা বলি, শুধু মনে হয় জীবনের উদ্বৃত্ত সময় পার করছি। এতো কাজ বাকি, শেষ তো করতে পারবো না; না ফেরার দেশে যাবার আগে কিছুটা কাজ অন্তত: যেন গুছিয়ে যেতে পারি। আর কায়মনোবাক্যে প্রার্থনা করি সহকর্মী, সহমর্মীরা যে যেখানে আছেন সবাই যেন সুস্থ এবং ভালো থাকেন। শুভকামনা সবার জন্যে। ভালো থাকবেন সবাই।
[email protected]
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর।