বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক ইলিয়াস আলী নিখোঁজ হয়েছেন, তাতে আমরা সবাই শঙ্কিত ও বেদনাহত। ইলিয়াছ আলীকে খুঁজে বের করা রাষ্ট্রের অন্যতম দায়িত্ব।
কিন্তু কথা হলো, এই বিষয়টিকে কেন আন্দোলনের ইস্যু করা হলো? ইলিয়াস আলী এবং তার গাড়িচালককে উদ্ধারের ব্যাপারে সরকার যদি শৈথিল্য দেখায়, বিরোধীদলের উচিত সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা কিংবা আলোচনায় বসা এবং কীভাবে তার সন্ধান মেলে বা তাকে সুস্থভাবে উদ্ধার করা যায়- সেই লক্ষ্যে যুগপৎ কাজ করা। এটাই হলো গণতন্ত্র। কিন্তু তা না করে তথাকথিত হরতাল সংস্কৃতি পালন উদযাপন করা এবং মানুষ হত্যা করা মোটেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য শুভ নয়। অবশ্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীসহ পুলিশপ্রধান ইলিয়াসের ঢাকার বাড়িতে গিয়ে তাকে উদ্ধারের আশ্বাস দিয়ে এসেছেন। এক্ষেত্রে বিরোধী দলের উচিত ছিল ধৈর্য্ ধারণ করা । কিন্তু বিরোধীদল আবেগ সামলাতে পারেনি। তারা হরতালের ডাক দেয়। হরতাল পালনের আগের দিন বাসে আগুন লাগিয়ে ঘুমন্ত বাসচালক বদর আলী বেগকে হত্যা করে। ইলিয়াস আলী রাষ্ট্রের নাগরিক, বদর আলীও এই রাষ্ট্রের নাগরিক। ইলিয়াসকে পাওয়ার জন্য বদর আলীকে হত্যা করা কি বাঞ্ছনীয়? সকলে অবশ্যই সমস্বরে বলবেন “’না’। একজন অভাজন বাস চালকের জীবনের মূল্য একজন ভাজন নেতার জীবনের মূল্যের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। সবারই জীবনের মূল্য সমান। সংবিধানে বলাই আছে আইনের দৃষ্টিতে সকলেই সমান ও আইনের সমান আশ্রয়ের অধিকারী। জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার অধিকার সংবিধানস্বীকৃত অন্যতম মৌলিক অধিকার। আগুনে দগ্ধ হয়ে বদর আলীর মারা যাওয়াটা এবং এক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ব্যর্থতা সংবিধানের চূড়ান্ত ব্যত্যয়।
বদর আলীর পুড়ে মারা যাওয়াটা ইলিয়াস আলীর নিখোঁজ হওয়ার ঘটনার মতোই বেদনাদায়ক। অন্য দিক থেকে তা আরো দুঃখজনক। কেননা বদর আলীর পরিবার হতদরিদ্র ও অসহায়। একজন বদর ছিলেন তার পরিবারের চালিকাশক্তি, কিন্তু ইলিয়াছ আলীর বেলায় তার অবর্তমানে তার পরিবারের আর্থিক সমস্যা হওয়ার আশঙ্কা খুবই ক্ষীণ। সবকিছুর বিচারে বদর আলীর মৃত্যুটা আজকের সভ্য সমাজে মানবিকতার এক চরম লঙ্ঘন। তার মৃত্যুটা নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা নেই। এ ব্যাপারে কোনো সংগঠনকে এমনকি জাতীয় মানবাধিকার কমিশনকেও সোচ্চার হতে দেখা যাচ্ছে না । এ বিষয়ে বিরোধী দল এখন পর্যন্ত কোনো বিবৃতি দেয়নি। তাদের কাছে বদর আলীর জীবনের কোনো মূল্য না থাকতে পারে, কিন্তু তার জীবন কি একটা ক্ষুদ্র কীটের সমান? ইলিয়াস আলী ও তার গাড়িচালককে জীবিত উদ্ধারের জন্য বিরোধীদলীয় নেত্রী তিনদিন হরতাল করার পর নতুন করে দুদিন হরতালের ডাক দিয়েছেন। আরও আল্টিমেটামের কথা বলছেন। তবে প্রথম তিনদিনের হরতালে যে পাঁচটি জীবন গেল, তার সুষ্ঠু বিচারের দাবিতে কেউ একদিনেরও আল্টিমেটাম দেয়নি।
এর মানে কি বিরোধীদল এসব হত্যালীলাকে সমর্থন দিচ্ছে, না কী একই সঙ্গে অদূর ভবিষ্যতের রাজনীতি যে অরাজক হয়ে উঠতে পারে তারই ঈঙ্গিত দিচ্ছে? বিরোধীদল আসলেই যদি জনগণের নিরাপত্তার কথা ভাবত, তাহলে প্রথমত তারা হরতালের মতো জনদুর্ভোগ বাড়ানোর আন্দোলনের ডাক দিত না এবং তা লাগাতার অচলাবস্থার সৃষ্টি করত না; আর যারা হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে সেই দলীয় কর্মীদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতো !
বিস্ময়কর হলেও সত্য আওয়ামী লীগও কিন্তু এসব হত্যার বিরুদ্ধে কোনো কথা বলছে না। যারা এসব তাণ্ডব ঘটাচ্ছে সরকার তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর আইনি পদক্ষেপ নিতে পারে এবং নিহতদের পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে পারে। সরকার চাইলে হরতালের মতো কর্মসূচি দেওয়া থেকে বিরোধীদলকে বিরত রাখতে পারে---এটা শুধু সম্ভব সরকারের পক্ষ থেকে যথার্থ সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে, কোনো পাল্টাপাল্টি বক্তব্য দেওয়ার মাধ্যমে নয়।
সরকারি দল এবং এর উপদলগুলোর হরতাল চলাকালীন কর্মকাণ্ড থেকে এটা আঁচ করা যায় যে, তারাও হরতালকে সমর্থন করে। তাদেরও হয়তোবা ভয় আছে যে তারা আগামীতে একদিন বিরোধীদল হবে, আর সেক্ষেত্রে বর্তমান বিরোধীদলের মতো হরতালের স্লোগান দিয়ে কিংবা মানুষ হত্যা করে জনজীবন বিষিয়ে তুলবে, আরো কত নাম না জানা পরিবারকে অসহায় করবে। বাস্তবিকই কারোরই অতীত ইতিহাস সুবিধার নয়। শুধু সরকারী দলের বিরোধী দল হওয়া এবং বিরোধী দলের সরকারি দল হওয়ার বিপরীতে ইতিহাস বা অভিজ্ঞতা যাই বলি না কেন- তা একই।
গণতন্ত্র হরতালের নামে মানুষ হত্যার কথা বলে না। হরতাল মানুষকে স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালন করতে হবে। মানুষের গাড়ি ভাঙচুর করে, ইটপাটকেল ছুড়ে ভয়ভীতি দেখিয়ে মানুষকে হরতাল পালন করতে বাধ্য করা যাবে না। এসব কারণে মানুষের স্বাধীন চলাচল ও যোগাযোগের মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। আদালতের রায়ে হরতাল মৌলিক অধিকার বলে সাব্যস্ত হয়েছে। অন্যদিকে মানুষের স্বাধীনতা তথা চলাফেরার-যোগাযোগ ইত্যাদির স্বাধীনতা সংবিধানে স্পষ্টভাবে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত। মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে আমরা আদালতের দ্বারস্থ হবো। তবে হরতালের কারণে চলাফেরা বিঘিœত হওয়ার কারণে আদালতের দ্বারস্থ হতে কাউকে দেখিনি। আমরা বলছি, হরতাল জোরপূর্বক চাপিয়ে দেওয়ার ব্যাপার নয়। উল্লেখ্য যে, সাবেক প্রধান বিচারপতি এবিএম খায়রুল হক যেভাবে বাংলাদেশের কথা বিবেচনা করে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আরো দুটার্ম রাখার কথা বলেছিলেন, সংবিধানে কিন্তু এমন আর কোনো বিধান নেই যার মধ্য দিয়ে হরতালকে গণতন্ত্র রক্ষার জন্য নিষিদ্ধ করা যেতে পারে। গণতন্ত্রের মুখপাত্র না হয়ে হরতাল এখন গণতন্ত্রবিনাশী ক্যান্সারের জীবাণু বহন করছে। হরতাল মানেই মানুষের জীবন কেড়ে নেওয়া, গাড়ি ভাঙা কিংবা মানুষের প্রিয় সখের প্রতিষ্ঠানটি নিজের চোখের সামনে আগুনে পুড়তে দেখা।
শেষ করার আগে একটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই, সেটা হলো সংবিধানে অনুচ্ছেদ ১১ তে গণতন্ত্রের সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে; সেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকার কথা বলা আছে, একই সাথে মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণের বিধান আছে। ব্যাপার হলো, শেষের বিধানটির কমবেশি প্রয়োগ থাকলেও অন্য উপাদানগুলোর কোনো অস্তিত্ব নেই। থাকবেই বা কী করে যেখানে হরতাল সংস্কৃতি মুখ্য, সেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চিয়তা গণতন্ত্রের তুচ্ছাতিতুচ্ছ ডিসকোর্স মাত্র?
লেখকবৃন্দ : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ৩য় বর্ষের শিক্ষার্থী
বাংলাদেশ সময় : ২২০১ ঘণ্টা, ২৯ এপ্রিল, ২০১২
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
[email protected]