প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইলিয়াস আলীর পরিবারকে সময় দিয়েছেন। বুধবার সন্ধ্যায় এ সাক্ষাৎ হবে গণভবনে।
মিডিয়ার মাধ্যমে আর্জিটা পেয়েই সাড়া দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। স্বজন হারানোর বেদনা যার নিজের ঢের জানা। মিসেস ইলিয়াসের মতো অবস্থায় যারা পড়েন তারা কোন অবস্থায় পড়েন, তা শুধু তেমন ভুক্তভোগীদের পক্ষেই জানা-বোঝা সম্ভব। যা কিছু সম্ভব সব সম্ভাবনাকে আঁকড়ে ধরে তিনি পজিটিভ কিছু বের করার আকুল চেষ্টা করেন।
এদিকে, এ সাক্ষাতে কী হবে না হবে তা ওয়াকিফহালরা জানেন। আমার শুধু একটা বিষয় খটকা লাগলো, তাহলো, বেগম ইলিয়াস কেন শুধু তার পরিবারের জন্য সাক্ষাৎ চাইলেন! ইলিয়াস আলীর সঙ্গে তার গাড়ি চালক আনসারও যে নিখোঁজ-হাওয়া হয়েছে, তার পরিবারটিকেও কেন সঙ্গে নেবার কথা বললেন না? বা সরকারি পক্ষের মাথায় এ বিষয়টাও কেন আসলোনা? এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে এরমাঝে অনেক ঘটনা-হরতালে বেঘোরে আরও কয়েকটি প্রাণ গেছে। আগুনে পুড়িয়ে মারা হয়েছে শ্রমজীবী গাড়িচালক বদর বেগ’কে। সাভারে প্রাণ গেছে আরেক শ্রমজীবী ট্যাক্সি চালকের। হরতাল-সহিংসতায় পুলিশের গুলিতে বিশ্বনাথে ৩ জন, লক্ষীপুরে ১ জনের প্রাণ গেছে। ইলিয়াস আলীর জীবন মূল্যবান। কিন্তু এই লোকগুলোর জীবন কী মূল্যহীন?
এ প্রশ্নটি সরকার ও বিএনপির কাছে থাকলো। অবাক ব্যাপার প্রাণ হারানো এই লোকগুলো, সংশ্লিষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোকে নিয়ে কিন্তু বিএনপিও কিছু বলছেনা!
১৭ এপ্রিলের ইলিয়াস এপিসোডকে কেন্দ্র করে অনেক অস্বস্তি ঘটেছে-ঘটানো হয়েছে দেশে। এইচএসসি’র মতো একটি পাবলিক পরীক্ষাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতেও কারও বিবেকে বাধেনি! এই পরীক্ষার ক্ষতি অনেক দূর যাবে। বিএনপি একটার পর একটা হরতাল দিয়ে গেছে, হরতালে স্থবির দেশকে সচল-স্বাভাবিক রাখতে পারেনি সরকার।
আমাদের দেশের কোনো সরকারই অবশ্য তা কখনো পারেনি। এর বিপক্ষে কিছু করতে গেলে উল্টো অস্বস্তি তৈরি হয়। এবারও হয়েছে। সবশেষ শুরু হয়েছে বিএনপি নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা-ধরপাকড়! আমাদের দেশে কেউ ক্ষমতায় গেলে পুলিশের কথায় বিরোধীদলের নেতাদের বিরুদ্ধে রাস্তার চা-দোকানির ক্যাশবাক্স লুটেরও মামলা দেয়! এমন মামলা আজকের আওয়ামী লীগের অনেক নেতার বিরুদ্ধেও আগে হয়েছে। আর এই সরকার দিয়ে চলেছে গাড়ি-ভাংচুর-পোড়ানোর মামলা!
মির্জা ফখরুলরা সাম্প্রতিক অবিরাম উস্কানিমূলক অনেক বক্তৃতা দিয়েছেন। এম কে আনোয়ার এমন সব ভাষা ব্যবহার করেছেন, শুনে মনে হবে এরশাদের পতনের পর আওয়ামী লীগে যেতে তিনি কেরামত আলীকে নিয়ে সেই যে ৩২ নম্বরের বাড়ি গিয়েছিলেন, শেখ হাসিনা যে তাদের দেখা দেননি, সে রাগ তার এখনও যায়নি! গয়েশ্বর চন্দ্র এমন কিছু বলতেন, তা শুনে মনে হবে, কেন সরকার তাকে ধরে-আটকে নেতা বানিয়ে দিচ্ছেনা!
কিন্তু এরা গাড়ি পোড়ানোয় জড়িত ছিলেন, এমন বিশ্বাসী সুস্থ লোক খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে। স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী বলেছেন, এরা গাড়ি পোড়ানোর হুকুমের আসামি। সত্যি যদি তাই হয় তাহলে এসব মামলায় তাদের নেত্রী খালেদা জিয়ার নাম নেই কেন? আওয়ামী লীগের গাছের পাতা যেমন শেখ হাসিনার ইশারা ছাড়া নড়েনা, খালেদা জিয়ার আদেশ-উপদেশ ছাড়া কী বিএনপিতে কোন কিছু হয়? এসব মামলায় খালেদা না থাকায় এসব নিয়ে সরকারি দাবির বিশ্বস্ততা আর নেই।
একেরপর এক হরতাল নিয়ে বিবেকহীন অস্বস্তিকর সময়ে দেশজুড়ে একটা প্রশ্নই সামনে এসেছে, তাহলো এ পরিস্থিতির শেষ কোথায়? দেশের কোটি বা এরও বেশি মানুষ এত গরিব যে, একদিন কাজ বন্ধ থাকলে তাদের পেটে দানাপানিও পড়েনা! এরপরও বিএনপি অবিরাম হরতাল, আরও কঠোর আন্দোলনের হুঙ্কার ছুঁড়েছে!
কিন্তু সে আন্দোলনের দল যে বিএনপি না, এত আরামপ্রিয়, বিতর্কিত নেতাদের নিয়ে যে অবিরাম আন্দোলন হয়না তা সর্বশেষ শিথিল হরতাল আর মামলার এপিসোডে ধরা পড়ে গেছে! বাংলাদেশে কোন আমলে বিরোধীদলের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়নি? গত বিএনপি আমলে কি আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা কম হয়েছে? সাবের হোসেন চৌধুরীদের বিরুদ্ধেতো ময়মনসিংহের সিনেমা হলে বোমা হামলার মামলাও হয়েছে। কিন্তু তাই বলে তৎকালীন বিরোধীদল কি লেজ গুটিয়ে আন্দোলনের মাঠে ছেড়ে চলে গেছে? এবার মামলা আর ধরপাকড় দেখে তার নেতারা কী পরিমাণ ভীরু-কাপুরুষ দৌড়ে ফার্স্ট, তা খালেদা জিয়া নিজের চোখে আবার দেখলেন!
কিন্তু এভাবেও যে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবেনা, এভাবে যে দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা যায়না, তা আন্দোলনে চ্যাম্পিয়ন দল আওয়ামী লীগের বোঝার কথা। মে দিবসের ছুটির পর বুধবার হয়তো নেতাদের জামিনের ব্যবস্থা হবে। হিলারি ক্লিনটনের সফরের কারণেই হবে। কারণ, হিলারি ক্লিনটনের সঙ্গে খালেদার দেখা করাতে তার পাশে বিএনপির মির্জা ফখরুল লাগবেই। বিএনপি এ ব্যাপারে মার্কিন পক্ষকে দিয়ে চাপ বাড়ালে ইস্পাত-কঠিন ভাব দেখানেওয়ালাদের পা কাঁপবেই।
হিলারি ক্লিনটনের সংবাদ সম্মেলনেও গুম-সংলাপ-সকল পক্ষকে নিয়ে নির্বাচন এসব বিষয় থাকার সম্ভাবনাই বেশি। এসব সরকারের পক্ষে যাবেনা। হিলারির ডরে অথবা সম্মানে এই ক’দিন হয়তো রাজনৈতিক হানাহানির বিরতি থাকবে দেশে। কিন্তু এরপর কী হবে? গত দুদিন এ প্রশ্নটি দেশের অনেককে করেছি। কারও কাছেই এর সঠিক জবাব নেই। একজন বললেন বিএনপির সমর্থনে তখন শামস কিবরিয়া, আহসান উল্লাহ মাস্টার এসব হত্যাকাণ্ড ঘটলেও লাশ পাওয়া গিয়েছিল বলে, সে সব ঘটনারও একটি গতি ঘটানো গেছে। কিন্তু এখানে যে জ্বলজ্যান্ত মানুষ নেই, লাশও নেই, অতএব এর সহজ সমাপ্তির কোনো রাস্তাও জানা নেই কারো।
ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
বাংলাদেশ সময় : ২০১৪ ঘণ্টা, ০১ মে, ২০১২
সম্পাদনা : আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর
[email protected]