শেষাবধি মনোবাঞ্ছা পূরণ হতে যাচ্ছে বাংলাদেশের সেরা ‘সর্বদলভূক’ রাজনীতিক মওদুদ আহমদের। সমস্ত ইঙ্গিত ও আলামত সাক্ষ্য দিচ্ছে, প্রধান বিরোধী দল বিএনপি’র মহাসচিব পদটি হাসিল করতে যাচ্ছেন তিনি।
চির-রোগীরা আত্মীয়-স্বজনদের খোঁজ-খবর সচরাচর না-রাখলেও ডাক্তারের হাল হকিকত সম্বন্ধে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল। ডিসেপেনসারিগুলোর সাথেও চিররোগীদের সখ্য থাকে নিবিড়। চিররোগীরা নিজেরাই একেকজন ডাক্তার! অনায়াসে বলে দিতে পারেন কোন ঔষধের কী মাহাত্ম্য! চোর-ছিনতাইকারীদের কাছে আশেপাশের থানাগুলোর পুলিশ সদস্যদের পূর্ণ বায়োডাটা থাকে। সংগে থাকে জামিন-অনায়াস-করতে-সক্ষম এক শ্রেণীর উকিল-পেশকার-মুহুরির তালিকা।
বাংলাদেশের প্রশ্নবিদ্ধ রাজনীতিতে দুর্নীতি এক ওপেন সিক্রেট। ভাসুরের নাম উচ্চারণের ‘বেয়াদবির’ মতো কেউ বিস্তারিত বলেন না। দুর্নীতিগ্রস্তদের মানসিক শক্তি কিছুটা কম হয়। সেই সংগে যুক্ত হয় রাজনৈতিক ‘হয়রানিমূলক’ মামলার আশংকা। অন্য সব ব্যবসার মতোই রাজনীতি-ব্যবসায়ও আয়-ব্যয়ের হিসাব কষতে হয়। রাজনীতি ‘ব্যবসার’ জন্যে বড় ধরনের ইনভেস্টমেন্ট না লাগলেও লিগ্যাল ফির অংকটা মোটামুটি ভালো মানের। সেকারণেই ‘রাজনৈতিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো’ সব সময় ইন-হাউজ লিগ্যাল টিমের ওপর জোর দেন। সব রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরেই আইন পেশাদারদের আধিক্য ও দাপট অনেক বেশি। দলের অভ্যন্তরীণ ক্ষমতার বলয়ে আইনজ্ঞদের দাপট বেশি। গিভ অ্যান্ড টেকের হিসাবে আইন পেশার সাথে জড়িতরা নামি-দামি পদ ও আনুকূল্য (ফেভার) পেয়ে থাকেন। বিনিময়ে নিখরচায় নেতাদের মামলাগুলো লড়ে দিতে হয় যখন-তখন। অবশ্য বিনামূল্যে মিডিয়ার পাবলিসিটিটা বাড়তি পাওনা।
কিছুটা ক্লিন ইমেজের মির্জা ফখরুল ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব ‘মনোনীত’ হলেও তা দলের তৃণমূলের সাথে সম্পর্কহীন হেভি ওয়েটদের ইজ্জতে লাগে। রাজপথে হাঁটতে কষ্ট পান এমন এয়ারকন্ডিশন্ড নেতাদের কাছে সঙ্গত কারণেই ‘নন-এসি’ ফখরুলের নেতৃত্ব মনোপীড়ার কারণ। কেএম ওবায়েদের পর মির্জা ফখরুলই একমাত্র প্রমাণিত কার্যকর (ইফেকটিভ) মহাসচিব; যদিও এখনো তার নামের আগে ``ভারপ্রাপ্ত`` তকমাটি বহাল আছে। লংমার্চ থেকে শুরু করে সরকারবিরোধী সকল আন্দোলনে মির্জা ফখরুল রাজপথে-আন্দোলনে সক্রিয়। গুঞ্জন শোনা যাচ্ছিল, তাঁকে পূর্ণাঙ্গ মহাসচিব করা হবে। ষড়যন্ত্র তখনই দানা বাঁধে।
সেমিনার, আলোচনা নামসর্বস্ব নেতারা উঠেপড়ে লাগেন ফখরুল-রিজভীর মতো রাজপথে-আন্দোলনে সক্রিয়দের ঠেকাতে। ইলিয়াস আলী ইস্যুতে ক্রমাগত রাজপথ-উত্তপ্ত-রাখা মির্জা ফখরুলসহ সক্রিয় নেতাদের সাইজ করা হলো। বিএনপি বিরোধী দল হিসেবে তৃণমূল পর্যায়ে শক্তিশালী হলে ‘সেমিনার’ সর্বস্ব মওদুদ গংদের ’গুরুত্ব’ কমে যাবে নেত্রী খালেদা জিয়ার কাছে। অগত্যা নিজেদের ‘আধিপত্য’ বজায় রাখার একমাত্র সহজ পথ হচ্ছে, দল ও দলের নেতাদের বিভিন্ন মামলা মোকদ্দমায় ব্যতিব্যস্ত রাখা।
এবারের সরকারের দেয়া মামলার বৈশিষ্ট্যে লক্ষ্য করা যায় যে, তৃণমূলের সাথে সম্পর্কিত নেতাদের বিরুদ্ধেই মামলা দায়ের হয়েছে। আর এ সুবাদে আগাম জামিনের নামে উকিল-রাজনীতিকদের গুরুত্ব বেড়েছে বহু গুণ। মামলা সংক্রান্ত বিষয়া নিয়ে আলাপ-আলোচনার জন্যে যখন-তখন ম্যাডামের ‘দুর্ভেদ্য’ দরোজা খোলা পাবার দুর্লভ সুযোগে ধন্য হতে পারছেন। সব মিলিয়ে বিভিন্ন মিডিয়ায় তাঁর বিভিন্ন ‘আলোকচিত্র’ আর বাতচিতের ফলাও প্রচার।
বিরোধী বিএনপি নেতাদের মধ্যে ক্ষমতাসীন সরকারের সাথে ‘নিবিড় ও আন্তরিক’ সম্পর্ক একমাত্র মওদুদ ভাইয়ের। পুরনো অভ্যাস অনুযায়ী তিনি সব সময় সব সরকারের মন্ত্রী হবার শপথের জন্যে সদা প্রস্তুত থাকেন। আত্মীয়তার সূত্রে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকদের ওপর মওদুদের ‘প্রভাব ও সখ্য’ বেশ গভীর। বর্তমান সরকারের আমলে ‘রাজনৈতিক মামলা’ প্রত্যাহার হয়েছে শুধু মওদুদের। এই বিরল সৌভাগ্যপ্রাপ্ত সবেধন নীলমণি বিএনপি নেতা তিনি। বিএনপি’র বিভিন্ন নেতারা মামলা ও হয়রানির মুখে পড়লেও মওদুদ এসব ‘দুর্ভাগ্যের’ ঊর্ধ্বে।
রাজনৈতিক দল চালাতে গেলে লাগে রাজনৈতিক কর্মসূচি। রাজপথের মির্জা ফখরুলরা দৌড়ের উপর থাকলেও দলের স্বার্থে কর্মসূচি চাই, চাই যোগ্য নেতা। চাই যোগ্য মুখপাত্র। মওদুদ এমন এক নেতা যিনি যুগপৎ আদালতে মামলার কার্যক্রম চালানোর পাশাপাশি বিভিন্ন সেমিনার সিম্পোজিয়ামের অলংকার হতে পারবেন। অ্যান্ড হি ইজ ভেরি মাচ প্রেজেন্টেবল। কথার জোরে আদালত কাঁপিয়ে ফেলেন আর সামান্য পাবলিক সামলাতে পারবেন না?
‘গায়ের রং’ বদলে অভিজ্ঞ মওদুদ এরই মধ্যে বিরোধী নেত্রী খালেদা জিয়ার আস্হাভাজন সাকাচৌর মতো ‘ধুরন্ধর’কে পেছনে ফেলে এসেছেন। নিশ্চিত ও নিরাপদ আসনে খালেদা জিয়া মওদুদকে জিতিয়ে সংসদে এনেছেন। দলের বর্তমান ‘ক্রাইসিসে’ মওদুদই একমাত্র বিকল্প খালেদা জিয়ার কাছে। সরকারের নীতি নির্ধারক মহলের সাথে ভারসাম্য বজায় রেখে আন্দোলনের নামে সেমিনার-সিম্পোজিয়ামের ‘সম্মানজনক’ রাজনৈতিক কর্মসূচিতে মওদুদই সেরা বাছাই। মওদুদের সঙ্গে রয়েছে বিশাল এক ‘বাতিল ও বৃদ্ধ’ নেতাগ্রুপের আশীর্বাদ, সহানুভূতি ও সমর্থন।
বিএনপিকে রাজনৈতিকভাবে ‘জীবিত’ রাখতে মহাসচিব পর্যায়ের একজন নেতার বড়ো প্রয়োজনীয়তা থেকেই মওদুদের ভাগ্যে জুটতে যাচ্ছে মহাসচিবের বরমাল্য। বড় উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ মওদুদের। ঈর্ষণীয় তাঁর ম্যানিপুলেটিং যোগ্যতা। প্রশ্ন হচ্ছে, অভিষেকটা কখন হচ্ছে?
ইমেলঃ [email protected]
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর