প্রিয় সোহেল তাজ,
শেষ পর্যন্ত আপনি সংসদ সদস্যপদ থেকেও পদত্যাগ করেছেন। প্রতিমন্ত্রিত্ব থেকে যখন পদত্যাগ করেছিলেন তখন সদ্য নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সরকার এক বিষম বিপদকাল অতিক্রম করছে।
আপনি একটি পত্রিকায় খোলা চিঠি লিখেছেন, আপনার পদত্যাগের কারণ ব্যাখ্যা করে। যদিও এতে স্পষ্ট করে কিছুই বলা নেই। আপনি “কথার পেছনে অনেক কথা খুলে বলতে চাননি এবং অনেক ‘লুক্কায়িত সত্য’ জনসমক্ষে প্রকাশ করতে চাননি। আপনাকে হয়তো এজন্য অনেকেই বাহাবা দেবেন, দুঃখিত আমি এতে কোনো কৃতিত্ব দেখছিনে। আপনাকে পলায়মান একজন হেরে যাওয়া মানুষ মনে হচ্ছে আমার কাছে। এই উপলব্ধি আমার একার নয়, আপনার ও আমার প্রজন্মের অনেকের সঙ্গেই আলাপ করে জেনেছি তারাও আপনাকে এরকমটাই মনে করেন। হয়তো আমাদের এই মনে করায় আপনার কিছুই এসে যায় না, যেমনটি আপনি মনে করেননি যে, এই সময়ে বাংলাদেশের মানুষের পাশে আপনার থাকাটা জরুরি ছিল। কেন ছিল সেসব বিষয়ে যাওয়ার আগে আপনার খোলা চিঠি সম্পর্কে আরো দু‘চারটে কথা বলার আছে।
আপনি লিখেছেন, আপনি ‘সংগত’ কারণে মন্ত্রিসভা ও সংসদ সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করেছেন। এবং এই ‘সংগত’ শব্দটিকে আপনি নিজেই বাক্য থেকে আলাদা করেছেন কমা-বন্ধনী নিয়ে। আমরা ধরেই নিচ্ছি যে, এই সংগত কারণ যথার্থই সংগত। কিন্তু আপনিই চিঠিতে মন্ত্রিত্ব পেয়ে যা কিছু করতে চেয়েছেন এবং যা কিছু শুরু করেছিলেন (যেমন যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া) বলে উল্লেখ করেছেন সেগুলো এরকম মাঝপথে রেখেই চলে গেলেন? আপনি পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিত, যে শিক্ষা অর্জন করতে আপনি “কিশোরকাল থেকে “দিন-রাত কাজ করেছেন, সেই শিক্ষা কী বলে? কোনও কিছুকে মাঝপথে ছেড়ে যাওয়াটা, তা যে অজুহাতেই হোক না কেন, ম্যানেজার হিসেবে চাকুরি পেতে ‘জব ডান’ খুবই গুরুত্বপূর্ণ, আশাকরি বিষয়টি আপনার জানা। সে বিচারে আপনি কাজ শুরুর আগেই একবার সরে গেলেন, সময় শেষ হওয়ার আগেই আরেকবার। মাঝের সময়টুকু আপনি থাকলেন কি থাকলেন না তা নিয়ে দেশের মানুষ, আপনাকে যারা ভোট দিয়ে নির্বাচিত করেছে তারা ঠিক বুঝতে পারেনি। এক আলো-আঁধারির খেলা শেষে আপনি আবার এক দুঃসময়ে এসে সদস্যপদ ত্যাগ করলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্টের আগে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্র্রকারীরা যেমন চতুর্দিক থেকে ব্যুহ বেঁধে এই দেশকে রক্তাক্ত করার কারবার শুরু করেছিল, দেশ বর্তমানে ঠিক সেই অবস্থার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে। পরিকল্পিত খুন-খারাবি, রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টির মাধ্যমে গতিশীল অর্থনীতিকে থামিয়ে দেয়ার চেষ্টা, গুপ্ত-হত্যা বা গুমের ঘটনা তৈরি ইত্যাদি সব আলামতই ‘৭৫-এর ১৫ই আগস্টের আগের সময়টার সঙ্গে সাযুজ্যময়। আপনার বাবা সে সময় সেই অপশক্তির বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে যুঝেছিলেন এবং তিনি মৃত্যুতে মৃত্যুঞ্জয়ী হয়েছেন, পালাননি। দেশের মানুষ তার অবদানকে তাই কখনওই খাটো করে দেখেনি, দেখবে না। কিন্তু আপনি কি করলেন?
আপনি লিখেছেন, ‘সততা ও নিষ্ঠার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছি’, কখন করলেন? দায়িত্ব নিয়েই তো আপনি উধাও। তারপরও আপনার কথা মানছি, ‘দুর্নীতি, অনিয়ম ও অব্যবস্থাপনার বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত সোচ্চার ছিলাম’। প্রশ্ন হলো, শেষটা নির্ধারণ করলেন আপনি নিজেই। একটু জনগণের দিকে তাকালে ভালো করতেন, আপনাকে দু’দু’বার ভোট দিয়ে তারা সংসদে পাঠিয়েছেন, তাদের প্রতি আপনার তো একটা দায়িত্ববোধ থাকা উচিত ছিল। আপনি তো সাধারণ রাজনীতি করবেন না বলেই অসাধারণ হতে পদত্যাগ করেছেন, একবারও কি ভাবেননি, জনগণের পাশে ‘শেষ পর্যন্ত’ থেকেও অসাধারণ হওয়া যেতো? ‘যখন মনে করেছি, আমার সীমিত ক্ষমতায় জনগণের প্রতি দেওয়া কমিটমেন্ট আর রক্ষা করা সম্ভব নয়, তখন স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছি’-- দেখুন, বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে, যেখানে মানুষ পেটের দায়ে সন্তান বিক্রি করে দেয়, যেখানে ভোট বিক্রি হয় এক-দেড় কেজি চালে, যেখানে বিদেশি ফর্মুলায় সরকারের ভাগ্য নির্ধারিত হয়, নোবেল পুরস্কার দিয়ে যেখানে রাষ্ট্র শাসনের যোগ্য করে তোলার আন্তর্জাতিক পরিকল্পনা হয় সেখানে আমাদের সবারই ক্ষমতা যে ‘সীমিত’ তা আপনি এতোদিন পরে এসে বুঝতে পারলেন দেখে অবাক হলাম। শুধু বাংলাদেশে কেন, পশ্চিমা বিশ্বের যে আধুনিকতম ‘গণতন্ত্রে’র দেশে আপনি গেলেন সেদেশের প্রেসিডেন্টকেও ফিলিস্তিনের মানবতাকে জিম্মি রাখতে হয় শক্তিশালী ইসরায়েলি লবির কাছে। তিনি এই ‘অক্ষমতায়’ পদত্যাগ করলে আসলে সামান্য মানবতাবোধ নিয়েও কারো পক্ষে সেদেশের প্রেসিডেন্ট হওয়া সম্ভব হবে না। তাই তারা পরিকল্পনা করেন কি করে সব পক্ষকে ম্যানেজ করে একটি মধ্যবর্তী পথে সকলকে সঙ্গে নিয়ে পৃথিবীকে, সভ্যতাকে এগিয়ে নেওয়া যায়, গণতান্ত্রিক ধারাকে অব্যাহত রাখা যায়, তার। ধরুন, একাত্তরে নিজের ‘সীমিত ক্ষমতার’ দোহাই দিয়ে তাজউদ্দিন আহমদ যদি আপনার মতো মার্কিন মুলুকে চলে যেতেন তাহলে অবস্থাটা কী হতো, একবার ভাবুন তো? নাহ্, আপনাকে সে উচ্চতায় আমি স্থান দিচ্ছি না, বা সেই মহান ব্যক্তিকেও আপনার পর্যায়ে নামিয়ে আনছি না। প্রশ্নটা মাথায় এমনিতেই এলো। আপনার ‘অর্থসম্পদ বা ক্ষমতার বিন্দুমাত্র মোহ ‘ নেই, আমরা আশ্বস্ত হলাম, আপনার সন্ন্যাস-জীবন সার্থক হোক, দেশের ভেতর আপনি ‘সীমিত ক্ষমতা’ দিয়েও এলাকার উন্নয়নে ভ’মিকা রাখতে পারতেন, পারতেন হয়তো দশজন মানুষের মনে আশা জাগাতে, বিদেশে আপনি কেবল নিজের আয়ে নিজের পরিবারই চালাবেন- আপনার কেন্দ্র আপনি নিজেই, এতে এতোদিন ধরে কেন যে এতোগুলো মানুষকে আটকে রেখেছিলেন, সে প্রশ্ন এখন তোলাটা কি অযৌক্তিক হবে?
‘কাপাসিয়ার মানুষের মর্যাদা ও সম্মান রক্ষার্থে আমার সামনে এ ছাড়া আর কোনো পথ খোলা ছিল না’- হবেও বা, কারণ কাপাসিয়ার মানুষ তাদের বিচারবোধ ও বিশ্বাসকে আপনার কাছে গচ্ছিত রেখেছিল। তাদের সে আমানতের খেয়ানত করে আপনি পড়ে থাকলেন বাইরে, দায়িত্ব নিয়ে যদি দায়িত্ব ছাড়তেই হয়, তাহলে দায়িত্ব নেয়ার আগে ভাবাটা জরুরি ছিল। দায়িত্ব ছাড়ার ফলে যদি কোনো বৃহৎ অর্জন সম্ভব হতো তাও না হয় মানা যেতো কিন্তু আপনি তো সেরকম কোনো ইশারা কাপাসিয়াবাসীকে দেখিয়ে যাননি, তাই না? আপনি কাপাসিয়াবাসীকে পরামর্শ দিলেন, ‘ব্যক্তিস্বার্থকেন্দ্রিক রাজনীতি পরিহার করতে হবে’, প্রশ্ন তুলি, আপনি কোন্ সামষ্টিক স্বার্থ দেখলেন, একটু বুঝিয়ে বলবেন কি? আপনি নীতি-আদর্শের রাজনীতির কথা শোনালেন, নিজেকে সরিয়ে নিয়ে, সমস্যা থেকে পালিয়ে সমস্যার সমাধানের কথা বললেন, আমরা শুনলাম, কিন্তু মানতে পারলাম না ঠিক।
আপনি আশাবাদী হয়ে খোলা চিঠির শেষে বলেছেন, ‘হয়তো একদিন সুস্থ একটি রাজনৈতিক সংস্কৃতির মাধ্যমে দেশে সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হবে। বাংলাদেশ হবে সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধিশালী একটি দেশ’ - যথার্থ বলেছেন, আপনার আশা পূরণ হবে, আমরা তার আলামত দেখতে পাচ্ছি চারদিকে। অর্থনীতিতে আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান গবেষক ও স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানই বলছে বাংলাদেশের এগিয়ে যাওয়ার কথা। হ্যাঁ, নানা ক্ষেত্রে এখনও ব্যত্যয় ঘটছে, এরপরেও ঘটবে, মাত্র চল্লিশ বছর বয়স যে রাষ্ট্রের, হাজারো টানাপড়েন তাতে থাকবেই। কিন্তু সব কাটিয়ে উঠে এই দেশ যখন আপনার আশাবাদের জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে, তখন আপনার মতো একজন সোহেল তাজ সম্পূর্ণ বিস্মৃত হয়ে যাবেন, কারণ, পলাতকদের কেউ মনে রাখে না, ইতিহাসের ফুটনোটেও তাদের জায়গা হয় না। খুব রূঢ় শোনালেও, এই-ই বাস্তব। দেশ ও দশের প্রতি আপনার প্রেম নেই, আপনি নিজেকে ভালোবাসেন, নিজের অহং-কে ভালোবাসেন, আপনি তবে তাই নিয়েই থাকুন।
আপনার জন্য শুভ কামনা।
[email protected]
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
[email protected]