প্রিয় স্যার,
অভিনন্দন নিন। শেষ পর্যন্ত মহামান্য রাষ্ট্রপতি ও আচার্যের এক আদেশে সঠিক সময়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে আপনার মতো একজন প্রিয় শিক্ষক নিয়োগ পেলেন।
কারণ, আপনার পূর্বসূরি সাবেক উপাচার্য শরীফ এনামুল কবির শুধু শিক্ষক নামের কলঙ্কই ছিলেন না, সন্ত্রাসের লালনকারীও ছিলেন। সন্ত্রাসের লালনকারী কেউ আর যাই হোক, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের অভিভাবক বা উপাচার্য হওয়ার যোগ্যতা রাখেন না।
স্যার,
ছাত্র রাজনীতি ও পরবর্তী সময়ে সাংবাদিকতা করার সুবাদে বেশ ক`বার কথা হয়েছে আপনার সঙ্গে। আপনার উদ্দেশ্যে আজকের এই খোলা চিঠি লিখছি, বাংলাদেশের একজন সাধারণ ছাত্র হিসেবে। এই চিঠিতে যা লিখছি, তার অনেক কিছুই হয়তো আপনি জানেন। আপনার মার্জিত ব্যবহার, আপনার সাধারণ জীবনযাপনের ধারা, ছাত্রদের প্রতি আপনার দায়বদ্ধতা আমাদের প্রত্যাশাকে বাড়িয়ে তোলে বলেই এক বুক আশা নিয়ে এই চিঠি লেখার অবতারণা।
আপনি নিশ্চয়ই জানেন, কোন পরিস্থিতিতে আপনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। গত ফেব্রুয়ারিতে ছাত্রলীগের সন্ত্রাসীদের হাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জুবায়ের নিহত হওয়ার পর অচলাবস্থার শুরু হয়েছিল। জুবায়ের হত্যার তদন্ত ও তার পরবর্তী অবস্থা নিয়ে শিক্ষকদের মতবিরোধ এখনও কাটেনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক জোট ও প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীদের কিভাবে রামদা, রড, পাইপ, চাপাতি দিয়ে কোপানো-পেটানো হয়েছিল তা-ও হয়তো আপনি শুনেছেন। শিক্ষার্থীদের সহ্যের সীমা শেষ হয়ে গিয়েছিল, দেয়ালে পিঠ ঠেকে গিয়েছিল বলেই প্রতিবাদ করতে বাধ্য হয়েছিলেন তারা।
সন্ত্রাসের বদলে সন্ত্রাস করে নয়, নিয়মতান্ত্রিকভাবে লাগাতার কর্মসূচির মাধ্যমে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন প্রগতিশীল ছাত্রকর্মীরা। জাহাঙ্গীরনগরের মাটি থেকে সন্ত্রাসের লালনকারী ওই উপাচার্যকে বিদায় হতে বাধ্য করেছিলেন সাংস্কৃতিক কর্মীরা।
স্যার,
আপনাকে আমি চিনেছি, ওয়ান ইলেভেন-পরবর্তী নির্যাতনবিরোধী আন্দোলনে। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থী নির্যাতনের ঘটনায় গড়ে ওঠা গণতান্ত্রিক আন্দোলনে নেতৃত্ব দিতে গিয়ে আপনি নিজেও নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন। তৎকালীন সরকারের পুলিশ বাহিনী আপনাকে গ্রেফতার করেছিল। শিক্ষক হিসেবে ছাত্র আন্দোলনগুলোতে বিশেষ করে আগস্টের ছাত্রবিক্ষোভের সময় আপনার সমর্থন-আত্মত্যাগ ভুলে যাওয়ার মতো নয়। সেই আন্দোলনের মাধ্যমে স্পষ্টতই আপনি ছাত্রদের পক্ষের শিক্ষক হিসেবেই নিজেকে প্রমাণ করেছিলেন।
বিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক চর্চা বিকশিত হবার জায়গা, মুক্তবুদ্ধির চর্চা এবং প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা বিস্তৃত করার স্থান। জাহাঙ্গীরনগরেই এই চর্চাটি সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে। তাই এই বিশ্ববিদ্যালয়কে দেশের সাংস্কৃতিক রাজধানী ঘোষণা করেছিলেন নাট্যাচার্য সেলিম আল দীন। অথচ বিগত উপাচার্যের সময়ে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ওপর কড়া বিধি-নিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। মুক্তমঞ্চ ব্যবহারের ক্ষেত্রে ভাড়ার পদ্ধতি চালু করা হয়েছিল। শরীফ এনামুল কবিরের শাসনামলে কোনো ছাত্র কিংবা সাংস্কৃতিক সংগঠনের অনুষ্ঠানে অতিথি-বক্তার নাম নির্ধারণের ক্ষেত্রে প্রশাসনের অনুমতি গ্রহণ করতে হতো।
রাত ১১টায় ছাত্রদের হলগেট বন্ধ করার ফতোয়া দিয়েছিলেন তিনি। ছাত্রদের বাস ও রুটের সংখ্যা কমিয়ে দিয়েছিলেন। ডাইনিং চিরতরে বন্ধ করারও উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। এতোসব বিধি-নিষেধের মাধ্যমে জাহাঙ্গীরনগরকে কয়েদখানা বানানোর ষড়যন্ত্র করেছিলেন তিনি।
আশা করছি, আপনি দায়িত্ব নেওয়ার পরপরই সাংস্কৃতিক কার্যক্রম- সংশ্লিষ্ট বিষয়সহ মুক্তবুদ্ধিচর্চার ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক সব বিধি-নিষেধ উঠিয়ে নিয়ে শিক্ষার্থীদের মুক্ত করে দেবেন।
স্যার,
গত ১৪ মে ডাকসু ভবনে একটি ছাত্র সংগঠনের গোলটেবিল বৈঠকে আপনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি হিসেবে বক্তৃতা করেছিলেন। সেখানে আপনি বলেছিলেন, ``সরকার বা ছাত্র সংগঠনের জন্য নয়, বরং বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের জন্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদ নির্বাচন হচ্ছে না। `` ডাকসু নির্বাচন না হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনার ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের মত প্রকাশের সুযোগ থাকছে না, এতে শিক্ষার্থীদের অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে বলেও আপনি মন্তব্য করেছিলেন। আমার মতো অনেকের কাছেই আপনার কথা খুব ভালো লেগেছিল।
এর পরে দেশের মিডিয়াগুলো যেদিন আপনাকে উপাচার্য নিয়োগের খবরটা প্রকাশ করে, অনেকের মতো আমিও খুশি হয়েছিলাম এই ভেবে যে, আপনি দায়িত্ব নিয়েই জাকসু নির্বাচনের ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু পরক্ষণেই সন্দেহ হলো। কারণ, এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বর্তমান উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক স্যারও দায়িত্ব নেওয়ার আগে একই রকম কথা বলেছিলেন। কিন্তু, দায়িত্ব নেওয়ার পর আরেফিন স্যার সেটা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নেই প্রায় দুই যুগ হলো। সম্প্রতি এক পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নিয়ে আপনার আশাব্যঞ্জক মন্তব্য আমাদের আশান্বিত করেছে। আমাদের বিশ্বাস, আপনি আপনার কথা ভুলে না গিয়ে ছাত্র সংসদ চালু করার ব্যবস্থা করবেন।
স্যার,
আপনি হচ্ছেন সেই কর্নেল তাহেরের ভাই যিনি এদেশের একজন বীর সেনানী ছিলেন। নিজের জীবনটা পর্যন্ত তিনি এদেশের নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের পক্ষে উৎসর্গ করে গিয়েছেন। কিন্তু মানুষের জন্য কাজ করতে গিয়ে কখনও পিছপা হননি।
আমাদের বিশ্বাস, আপনি যে দৃঢ় শপথ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের অভিভাবক হিসেবে নিয়োগ পাচ্ছেন, তা সঠিভাবেই পালন করবেন। আমরা মনে করি, পূর্ববর্তী উপাচার্য ক্ষমতার লোভে পদ আঁকড়ে থেকে যে করুণ পরিণতি বরণ করেছেন, আপনি তা করবেন না। সাধারণ ছাত্রদের পক্ষে কাজ করার জন্যই আপনি নিয়োগ পেয়েছেন, এটা ভুলে যাবেন না।
আমরা আপনার কাছ থেকে দেখতে চাই, কালোকে কালো এবং সাদাকে সাদা বলার সৎসাহস। যা সাবেক উপাচার্যরা করে দেখাতে পারেননি, শুধু রাজনৈতিক দলীয় সংকীর্ণতার কারণে। আমরা আশা করবো, যেসব ছাত্রলীগকর্মী সেদিন জুবায়েরকে হত্যা করেছিল, যার ধারাবাহিকতায় সাংস্কৃতিক জোটের নেতাকর্মীদের হামলার শিকার হতে হয়েছিল, তাদের ছাত্রলীগের কর্মী হিসেবে নয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের অযোগ্য শিক্ষার্থী, অপরাধী-সন্ত্রাসী হিসেবেই বিবেচনা করবেন। তাদের আইনের মুখোমুখি দাঁড় করাবার জন্য নিজেই উদ্যোগী হবেন।
নেতিবাচক রাজনৈতিক প্রক্রিয়া আর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের রাজনৈতিক দাসত্বের জন্য আমাদের শিক্ষাঙ্গনগুলো লীগ-শিবির-ছাত্রদলের সন্ত্রাসের কাছে বন্দী হয়ে থাকবে অনাগতকাল ধরে, এটি কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।
প্রিয় আনোয়ার স্যার,
অপরাধীদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিয়ে আজ প্রমাণ করুন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, এর প্রশাসন এবং অভিভাবকরা কোনো রাজনৈতিক দাসত্ব মানেন না। আমরা শিক্ষাঙ্গনে আর একটি লাশও দেখতে চাই না।
আমাদের প্রত্যাশা, আপনার হাতের ছোয়ায় মুক্তবুদ্ধি আর সংস্কৃতির চর্চাকেন্দ্র হিসেবেই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় তার পুরোনো ঐতিহ্য ফিরে পাবে, সন্ত্রাসের আবাসভূমি হিসেবে নয়।
সিয়াম সারোয়ার জামিল : কবি ও ব্লগার
[email protected]
বাংলাদেশ সময় : ০১১০ ঘণ্টা, মে ২০, ২০১২
সম্পাদনা : অশোকেশ রায়, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর;