ঢাকা, সোমবার, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৩ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

বন্ধুগণ, এখন শত্রু-মিত্র চেনার কাল

মাসুদা ভাট্টি, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৪২ ঘণ্টা, মে ২২, ২০১২
বন্ধুগণ, এখন শত্রু-মিত্র চেনার কাল

কথায় বলে, বিপদে বন্ধু চেনা যায়। সত্যিই তাই।

স্বাধীনতা পরবর্তী বাংলাদেশ নানা বিপদের মধ্য দিয়ে এ পর্যন্ত এসেছে। রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক অনেক চড়াই উতরাই পার হয়েছে। দেখেছে হত্যা, রক্তপাত এবং ভয়ংকর লুটপাট। অনেকেই ধারণা করেছিল, বাংলাদেশ একটি ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হবে, সোমালিয়া কিংবা ইথিওপিয়া কিংবা আফ্রিকার আরো কিছু দেশের মতো। কেউ কেউ এরকম ধারণাও করেছিল যে, বাংলাদেশ পরিণত হবে মৌলবাদের আখড়ায়। বিশ্বের গণমাধ্যমে বাংলাদেশ নিয়ে এরকম নেতিবাচক সংবাদ হরহামেশাই দেখা গেছে। কিন্তু সবকিছুর পরও বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে, বৈশ্বিক মন্দার হাতে যখন অনেক বাঘা বাঘা অর্থনীতির দেশও বিপর্যস্ত, তখনও বাংলাদেশ বিশাল এক জনগোষ্ঠীর বোঝা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। অর্থনীতির গতি ঢিমে তেতালা হলেও থেমে যায়নি, চলছে। হয়তো আগামী বছর প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হবে না, কিংবা হবে, সেটা মুখ্য নয়। অর্থনীতি থেমে যায়নি, বাংলাদেশ ব্যর্থ রাষ্ট্রের তালিকায় নাম লেখায়নি, এই-ই সত্য, এর চেয়ে বড় কোনো সত্য নেই।

এতো কিছুর পরও বাংলাদেশ আবার এসে দাঁড়িয়েছে এক চরম বিপদের মুখোমুখী। এই বিপদ আভ্যন্তরীণ এবং শত্রুরাও এদেশেরই, যাকে বলে “এনিমি উইদি”। এই ঘরের শত্রু বিভীষণদের সম্পর্কে আমরা যে অজ্ঞ, তা নয়। বরং ১৯৭১ সালেই এরা শত্রুর খাতায় নাম লিখিয়েছিল। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত ছিল না, এমন কথা অনেকেই বলে থাকেন। এর সত্যাসত্য বিচার গবেষকরা করুন, কিন্তু প্রস্তুতি ছাড়াই কিংবা স্বল্প প্রস্তুতি নিয়েও যে বাঙালির বিরাট একটা সংখ্যা যুদ্ধে নেমেছিল, তাও এক চরম সত্য। অনেকে এখন যুক্তি দেখাতে পারেন যে, তারা ভয়ে যুদ্ধে নামেননি, নিজের প্রাণ, আপনজনদের প্রাণ বাঁচানোর জন্য তারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থেকেছেন। তাও মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু যারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়নি, যুদ্ধের বিরোধিতা করেছে, পাকিস্তানি সেনা বাহিনীর পক্ষাবলম্বণ করে মুক্তিকামী বাঙালি নিধনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা নিয়েছে, যারা হাজার হাজার বাঙালি নারীকে পাক সেনাদের হাতে তুলে দিয়েছে তারা? এই শেষোক্ত পক্ষকেই আমরা চোখ বুঁজে বাঙালির শত্রু আখ্যা দিতে পারি। মজার ব্যাপার হলো, এদের সঙ্গে পরবর্তীকালে বিশেষ করে ’৭৫-এর পরে যুক্ত হয়েছে একদল মানুষ, যারা নিজেদের মুক্তিযোদ্ধা বলে দাবি করেন, কারো কারো ক্ষেত্রে যুদ্ধে অংশগ্রহণের প্রমাণও রয়েছে, তারা। এবং ক্রমশঃ এই দু’পক্ষ মিলে এক বিশাল পক্ষের সৃষ্টি হয়েছে। আরও মজাদার হচ্ছে, এই সময়ে এসে এই পক্ষের ভেতর ৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত থাকা অংশটিকে এতোই ক্ষীণ মনে হয় যে, টিকটিকির লেজের মতো এরা যেনো খসেই পড়েছে। ৭১-এ এরা ধর্মের দোহাই দিয়েছে, ভারত-বিরোধিতার জোয়ার তুলেছে, এখনও তারা সম্মিলিত গলাই একই গীত গেয়ে চলেছে।

বর্তমানে যে দলটি রাষ্ট্র ক্ষমতায় আসীন তাদের ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা লিখতে গেলে মহাভারত লেখা যাবে। এই দলটি প্রগতিবাদী কিংবা প্রতিবাদী এমন অপবাদ হয়তো কেউই দেবে না। কিন্তু একটি জায়গায় এসে এই দলটির প্রশংসা করতে হয়, তাহলে এই দলটি জনতাবাদী। জনতার দাবি কি জিনিস, জনগণের প্রাণের কথা দলটি বোঝে। একাত্তরে বুঝেছিল, তাই তাদের ঘোষণা ছিল “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম”, তাই যার যা কিছু আছে তাই নিয়েই শত্রুর মোকাবিলায় জনগণকে উব্দুদ্ধ করেছিল। পরবর্তী সময়েও বার বার দেখা গেছে, জনগণ যেখানে দাবি নিয়ে একত্রিত হয়েছে, এই দল সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী, একাত্তরে মানবতার বিরুদ্ধে সংঘটিত অপরাধের বিচারের দাবি আজকের নয়। ১৯৭২ সালেই এর প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল। ৭৫ সালের পরতো সময়টা মূলতঃ ওদেরই ছিল। ফলে মানুষ অপেক্ষা করেছিল একটা সুসময়ের। সেই সুসময় এসেছে। জনগণ আওয়ামী লীগকে ম্যান্ডেট দিয়েছে এদের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার। প্রাথমিক গড়িমসি কাটিয়ে বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। দেখা যাচ্ছে, এভাবে চলতে থাকলে হয়তো টানেল শেষের আলোকরেখা আর খুব দূরে নয়। কিন্তু তার আগেই বাংলাদেশকে নিয়ে শুরু হয়েছে দেশজ ও আন্তর্জাতিক নানা ভানুমতির খেলা। আওয়ামী লীগ যখন বার বার যুদ্ধাপরাধের বিচার বানচাল করার জন্য একটি গোষ্ঠী কাজ করছে বলে বক্তৃতা বিবৃতি দিতে শুরু করে তখন আমার মতো অনেকেই হয়তো বিশ্বাস করতেন যে, আসলে নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকার জন্য দলটি এ কাজ করছে। কিন্তু যতোই দিন গেছে, যতোই চার ধারের শত্রুরা মুখ থেকে সুশীলতার নেকাব সরিয়েছে ততোই স্পষ্ট হয়েছে, আসলে দলটি মিথ্যে বলছে না। বাঘ আসছে, বাঘ আসছে, বলে তারা অযথাই চেঁচাচ্ছে না, সত্য সত্যই বাঙালির পালে বাঘ পড়েছে।

আজকে যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া চলছে, তখন দেশে ও দেশের বাইরে যে তৎপরতা চলছে, তাতে সত্যি সত্যিই ভীত বোধ করছি। বিশেষ করে আজ এই প্রশ্নে এমন সব মানুষের মুখোশ উন্মোচিত হয়ে যাচ্ছে, যারা এতোদিন ঘাপটি মেরে ছিলেন দেশবন্ধুদের দলে। পত্রিকায় কলাম লিখে, কেউবা টিভির টক শোতে, কেউ বা কূটনৈতিক তৎপরতা দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকানোর চেষ্টা চালাচ্ছেন। কোনো কোনো পত্রিকা আবার নিরপেক্ষতার ভান ধরে সব পক্ষকে সুযোগ করে দিচ্ছে কথা বলার। এতে কোন পক্ষ বেশি লাভবান হচ্ছে তা বলাই বাহুল্য। সম্প্রতি গণতন্ত্র রক্ষার নামে এক সুশীল ব্যারিস্টার গিয়ে যোগ দিয়েছেন বিএনপি-জামায়াত জোটের আসরে। কিছুকাল আগেও তিনি নাগরিক মঞ্চের নাম দিয়ে মাঠ কাঁপিয়েছেন কিন্তু এখন বোঝা গেলো কার দৌড় কাদের মসজিদ পর্যন্ত। যে আসরে তিনি বক্তব্য রেখেছেন, সেই আসরেই শিবিরের কর্মীরা প্ল্যাকার্ডে যুদ্ধাপরাধে অভিযুক্তদের মুক্তির দাবি জানিয়েছেন। তিনি কিন্তু নিজেকে বাঁচাতে একথা বলেননি যে, বাবুরা ওদের বাঁচাতে চেও না, ওরা দেশের শত্রু। পেনশনকালে এসে তিনি যে স্রোতে ভাসলেন, সেই স্রোতে আসলে ধর্মান্ধতার জমাট পুঁজে ক্লেদাক্ত, দেশবিরোধিতার তরবারি নিয়ে তারা প্রস্তুত সমৃদ্ধ বাংলাদেশকে আফগানিস্তান কিংবা সোমালিয়া বানাতে। আরেক চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীর পক্ষে সাক্ষী হিসেবে যাদের নাম আদালতে উল্লেখ করা হয়েছে, তারাও সকলেই সমাজে চিহ্নিত শিক্ষিত, ভদ্র ও বিশিষ্ট জন হিসেবে। কেউ কেউ আবার নিজের পক্ষে সাফাই গেয়ে বলতে চাইছেন, সাকা চৌধুরী মুক্তিযুদ্ধের সময় কী করেছেন, তা তাদের জানা নেই-এ কী কথা শুনি আজ মন্থরার মুখে। সত্যিই আমরা আজ চোখ থাকিতে অন্ধ, আর শ্রবণেন্দ্রিয় ৭৫-এর গুলির শব্দে বোধ করি অকেজোই হয়ে গেছে!!!

আমার পরিচিত এক মুখের ওপর হক কথা বলা স্বভাবের মানুষকে প্রায়ই বলতে শুনি, বাংলাদেশে এখন তিন ধরনের মানুষ জীবিত। এরা হলেন— এক. ব্রিটিশ আমলে জন্ম, পাকিস্তান আমলে বেড়ে ওঠা এবং বাংলাদেশ আমলে প্রতিষ্ঠা পাওয়া; দুই. পাকিস্তান আমলে জন্ম ও বাংলাদেশ আমলে বেড়ে ওঠা ও প্রতিষ্ঠা পাওয়া; তিন. বাংলাদেশেই জন্ম, বাংলাদেশেই বেড়ে ওঠা, বাংলাদেশেই প্রতিষ্ঠা লাভের চেষ্টা করে যাওয়া। প্রথম পক্ষ তিনবার জাতীয় সংগীত বদলেছেন, তিন পতাকার সামনে তাদেরকে আনুগত্য দেখাতে হয়েছে; দ্বিতীয় পক্ষ দু‘বার এই কাজ করেছেন, কিন্তু তৃতীয় পক্ষ একটি মাত্র পতাকাকে চিনেছে, জেনেছে বিশ্বাস করেছে। এই হক কথার মানুষটির মতে, প্রথম দুই পক্ষের মানুষগুলোর অনেকের মাঝেই নানা কিসিমের অসংগতি আছে, দুর্বলতা আছে, মিথ্যের আশ্রয় নেওয়ার প্রবণতা আছে, তথ্য গোপন করার অভ্যেস আছে, সর্বোপরি দেশের প্রতি ভালোবাসায় ঘাটতি আছে। আমি এই ভদ্রলোকের সঙ্গে সর্বৈব একমত নই ঠিকই কিন্তু তার কথা পুরোপুরি ফেলতেও পারি না। আমার পাঠকের কাছে সবিনয় অনুরোধ, বিষয়টি একটু ভেবে দেখবেন। কিন্তু একথাও সত্যি যে, এই প্রথম ও দ্বিতীয় প্রজন্মই মুক্তিযুদ্ধ করেছে, স্বাধীনতা এনেছে। তাদের অবদানকেও যেনো আমরা কোনোভাবেই খাটো না করি।

যা হোক, স্বাধীনতা পরবর্তী প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি কিন্তু এর সঠিক ইতিহাস থেকেও বঞ্চিত থাকবে, এরকমটি হবার কোনো কারণ ছিল না। সেরকমও হয়েছে। নতুন প্রজন্মের অনেককেই প্রশ্ন করলে স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধ পরবর্তী বাংলাদেশকে নিয়ে মিশ্র ও বিভ্রান্তিকর জবাব পাওয়া যাবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে অবশ্য এ নিয়ে খুব একটা চিন্তিত নই, কারণ, যে কোনো জাতি-ইতিহাস রচিত হয় সময়ের সঙ্গে সঙ্গে। সময় নিজেই ইতিহাসের কথক। ১৯৭১ যখন নিজেই নিজের সাক্ষ্য দিতে শুরু করবে, তখন সত্যিকার ইতিহাস বেরিয়ে আসবে এবং মানুষ জানবে সঠিক তথ্য। কিন্তু ততোদিনে হয়তো এই বিভ্রান্ত প্রজন্ম হারিয়ে যাবে। তাতে কি? অনাগত কালতো সত্যের কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে সত্য কথা বলবে, সেই বিশ্বাস আমি ধারণ করি, মনেপ্রাণে।

কিন্তু বন্ধুগণ, এখন শত্রুমিত্র চেনার কাল। আসুন আমরা চোখকান খোলা রাখি, দেশের অগ্রগতি ঠেকানোর কোনো ষড়যন্ত্রে ওরা যাতে সফল হতে না পারে সেদিকে সচেষ্ট থাকি।

wrighterলেখক: সম্পাদক, একপক্ষ।
[email protected]
সম্পাদনা: আহমেদ জুয়েল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।