ঢাকাঃ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম ব্রিটিশদের অত্যাচার-নির্যাতনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়েছিলেন তার অগ্নিস্ফূলিঙ্গসম সব লেখায়। এজন্য নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল তাঁর বিখ্যাত অনেক গ্রন্থ।
পুলিশি নিপীড়নের ঘটনা কবিকে মারাত্মকভাবে আহত করেছিলো। নজরুলের নিজের লেখাতেই ফুটে উঠেছে ব্রিটিশ পুলিশের সেই বর্বরতার কথা। এক লেখায় নজরুল লিখেছেন ‘পুলিশ হলে বোধ হয় আর মানুষ থাকতে নেই। ’
কবির প্রাণাধিক প্রিয় দ্বিতীয় পুত্র বুলবুলের অকাল মৃত্যুর পর একবার ব্রিটিশ পুলিশ হানা দিয়েছিল তার বাড়িতে। পুরো ঘর তল্লাশির পর পুলিশের নজর পড়ে একটি বাক্সের ওপর। নজরুল সেই বাক্সটি আঁকড়ে ধরেছিলেন। পুলিশকে আকুতি জানিয়েছিলেন বাক্সটি না খোলার জন্য। নাছোড়বান্ধা পুলিশ জোর করে বাক্সটি খুলে তাদের কাঙ্ক্ষিত অবৈধ কিছু পায়নি, দেখতে পায় অকালপ্রয়াত কবিপুত্র বুলবুলের পোশাকপরিচ্ছদসহ ব্যবহৃত কিছু সামগ্রী।
পুলিশের এই অমানবিক আচরণ কোমলপ্রাণ কবিকে দারুণভাবে ব্যথিত করেছিলো।
এরপর পেরিয়ে গেছে বহুযুগ। উপমহাদেশ ব্রিটিশমুক্ত হয়েছে ১৯৪৭ সালে। কিন্তু দীর্ঘকাল পেরিয়ে গেলেও ব্রিটিশের রেখে যাওয়া প্রশাসন, বিশেষ করে পুলিশ বাহিনীর আচরণ যে এতটুকুও বদলায়নি তা গত ক’দিনের স্বাধীন বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের আচরণে টের পাওয়া যাচ্ছে।
সংবাদকর্মী হিসেবে গত ক’দিনে ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী হওয়ার সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য হয়েছে আমার। চাকরি জাতীয়করণের দাবিতে দেশের প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে কয়েক হাজার রেজিস্ট্রার্ড বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান ধর্মঘট শুরু করেন গত ১৪ মে। সরকারের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া না পেয়ে রাতটা শহীদ মিনারে কাটিয়ে পরদিন ১৫ মে প্রধানমন্ত্রীকে স্মারকলিপি দিতে ধর্মঘটী শিক্ষকরা রওয়ানা হন তেজগাঁও-এর উদ্দেশ্যে। কিন্তু শাহবাগ মোড়েই তাদের আটকে দেয় পুলিশ।
আটকে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি পুলিশ। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের প্রকৃত দানবীয় চেহারা দেখতে পান প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে আসা ক্ষুধা আর শারীরিক অবসাদে কাতর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা।
প্রথমে শান্ত-নিরীহ এসব শিক্ষককে জলকামানের গরম জল ঢেলে ছত্রভঙ্গ করে দেওয়ার চেষ্টা চালায় পুলিশ। উত্তপ্ত্ রাজপথে গরম পানিতে শিক্ষকদের কয়েকজন জ্ঞান হারান সঙ্গে সঙ্গেই। তারপর চলে কয়েক ঘণ্টাব্যাপী অমানুষিক নির্যাতন।
গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ে লেখাপড়া শিখে চাকরি পেয়ে এসব পুলিশ সদস্য বেমালুম ভুলে গেলো শৈশবের শিক্ষাগুরুদের কথা! একপর্যায়ে উত্তেজিত পুলিশ ``শুয়োরের বাচ্চা``, ``কুকুরের বাচ্চা`` বলে লাথি মেরে রাস্তায় ফেলে দেয় অনেক শিক্ষককে। সে দৃশ্য দেখে শিক্ষকদের সঙ্গে সংবাদকর্মী হিসেবে নিজের চোখের জল ধরে রাখতে পারিনি ওইদিন।
শনিবার রাজধানীর আগারগাঁও মহিলা পলিটেকনিক কলেজে ছাত্রীদের আন্দোলনের ছবি তুলতে গিয়ে পুলিশের বেধড়ক লাঠিপেটার শিকার হন তিন ফটো সাংবাদিক।
মঙ্গলবার পুলিশের হাতে আবারও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন সাংবাদিকরা। ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালত সংলগ্ন এলাকায় বিচার চাইতে আসা এক নারীর শ্লীলতাহানি করার পর ওই নারীর বাবাসহ তিনজন সাংবাদিক ও দুই আইনজীবীকে প্রকাশ্যে বেধড়ক পেটায় পুলিশ সদস্যরা।
নির্যাতনের এই দু’টি ঘটনা অনেকের মত আমাকেও মর্মাহত করেছে, তবে বিস্মিত করেনি। কারণ, নজরুল ব্রিটিশ পুলিশকে উদ্দেশ্য করে ‘পুলিশ হলে বোধ হয় আর মানুষ থাকতে নেই’ বলে যে মন্তব্য করেছিলেন, আমাদের পুলিশ তার সেই উক্তির প্রতি সম্মান রাখছে বৈকি!
বাংলাদেশ সময় : ২২২৮ ঘণ্টা, মে ২৯, ২০১২
সম্পাদনা : জাকারিয়া মন্ডল, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর;
জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
[email protected]