মনে আছে প্রথম যেদিন সমুদ্র দেখলাম সেদিন সমুদ্রের বিশালতা দেখেও মনের ভেতর একটুও রোমাঞ্চ জাগেনি। মনেই হয়নি এই প্রথম পৃথিবীর অপূর্ব এক সৌন্দর্যের সামনে আমি দাঁড়িয়ে আছি।
যেখানে আমার জন্ম, সেখানে আমার বাড়ির ঠিক একশ গজ সামনে থেকে যতদুর চোখ যায় দেখা যায় দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি। থৈ থৈ ঢেউয়ের সে কি জলকেলি! বিল আর সমুদ্রকে অতিকায় ক্ষুদ্র আমি তখন একদম আলাদা করতে পারিনি। আমার শৈশব কৈশোরের বিরাট একটা সময় কেটেছে প্রকৃতির নান্দনিক সৌন্দর্যের ক্ষেত্র চলনবিল এলাকায়। বর্ষা মৌসুমে ভরা যৌবনে টইটুম্বুর সেই চলনবিল। আর শুকনো মৌসুমে অবারিত মাঠ জুড়ে শুধু ফসল আর ফসল। যেদিকে চোখ যায় সবুজের মায়াময় হাতছানি। রুপে গুণে ভীষন রকম মায়াবতী আমার প্রিয় চলনবিল। দেশের যে প্রান্তেই থাকি না কেন বর্ষা আমাকে ভীষণ টানে। মনের ভেতরটা ঘিরে ধরে বিষন্ন মেঘ, যদি না বর্ষার ভরা চলনবিলের খোলতাই রুপ দেখতে পারি। নাড়ির টানে বিভিন্ন অজুহাতে এবং ছুটিছাটায় দৌড় লাগাই শৈশবের প্রিয় সেই জায়গায়। এবারো মে মাসের শেষে বাচ্চাদের নিয়ে গ্রীষ্মের ছুটি কাটাতে ক’দিনের জন্য সেখানে গিয়েছিলাম। টাকা উপার্জনের জন্য মানুষ তার ন্যূনতম বিবেকবোধ হারিয়ে ফেলছে এই উপলব্ধি অনেক কষ্টের।
ছোটবেলায় পাঠ্যবইয়ে পড়েছি পরিকল্পিত পরিবারের কথা। দেশে ক্রমাগত জনসংখ্যা বাড়ছে সেই সাথে বাড়তি জনগোষ্ঠীর জন্য প্রয়োজন হচ্ছে আবাসনের। খুবই স্বাভাবিক ঘটনা এটা। মানুষের আবাসন চাহিদা মেটাতে ফসলি জমিতে গড়ে উঠছে বাড়ি, সেখান থেকে গঠিত হচ্ছে পাড়া মহল্লা। বাংলাদেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে আবাসন প্রকল্পের এই দৃশ্য সবার কাছেই খুবই পরিচিত। বাড়তি মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণের সুযোগ তো করে দিতেই হবে। যখনই নিজের জেলা শহর নাটোরে যাই প্রতিবার এলাকার অবকাঠামোগত ভিন্নতা চোখে পড়ে। এই ভিন্নতার কিছু চিত্র মনকে বেদনার্ত করে। চেনা ছোট্ট মফস্বল শহর ক্রমে বড় হচ্ছে, দিনকে দিন এর বৈচিত্র বাড়ছে, হাজার রকম সুবিধা সৃষ্টি হচ্ছে এতে তো আনন্দ পাওয়ার কথা। অথচ এক বালতি গরুর দুধে এক ফোটা চোনা পড়লে যা ঘটে সেটাই ঘটছে। অনেক অনেক ভাল কাজের মধ্যে একটা মন্দ কাজ যখন মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে তখন অন্যসব কাজের সুফল ম্লান হয়ে যায়। আমি টের পেলাম আমার অনেকদিনের চেনা প্রকৃতির অপরূপ ছন্দময় একটা ধারা কোথায় যেন এসে হুট করে থেমে গেছে। কোথায় যেন বাড়াবাড়ি রকমের ছন্দপতন ঘটেছে। মানতে হবে দিনবদলের হাওয়া লেগেছে সর্বত্র। জনপদে উন্নয়নের জোয়ার বইছে। এরই ধারাবাহিকতায় চলনবিলের জলাশয় ভরাট করে আবাসন প্রকল্প বানাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এক্ষেত্রে কেউ প্রশাসনিক অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজনও বোধ করছেন না। সবাই ব্যবসায়ী হয়ে রাতারাতি টাকা বানাতে চান। পৌরসভার আশেপাশে যত্রতত্র ড্রেজার দিয়ে বালি ভরাট কার্যক্রম চলছে। চলনবিল জুড়ে এখন আবাসন প্রকল্পের রমরমা ব্যবসা। নাটোর জেলার সিংড়া পৌরসভা চলনবিলের মধ্যে অবস্থিত হওয়ায় সেখানে আবাসিক সংকট বেশ প্রকট। পৌরসভার কাছাকাছি ব্যক্তিমালিকানাধীন যেসব জমিতে কিছুদিন আগেও ফসল ফলতো এখন সেসব জমি আবাসন-আগ্রাসনের শিকার। চলনবিলকে দুভাগে বিভক্ত করা বগুড়া-নাটোর মহাসড়কের সিংড়া পৌরসভায় অবস্থিত প্রায় ১০০ ফুটের একটা ব্রিজের মুখ ঘেঁষে ১০ বিঘা জলাশয় ভরাট করে আবাসন প্রকল্প গড়ে তুলেছে স্থানীয় দুই ব্যবসায়ী। রাজ্জাক খামারু এবং মোহাম্মদ আলী প্রকল্পটির উদ্যোক্তা। তাদের এই প্রকল্পটির কারণে ব্রিজটি দিয়ে পানি চলাচল পুরো বন্ধ হয়ে গেছে। এর ফলে আমার ছোটবেলার সেই শান্ত সমুদ্র গতিবিধি পাল্টে হতে উঠতে পারে ধংসাত্মক। চলনবিলের পানির স্বাভাবিক বহমানতা তার দিক পাল্টালে প্রাকৃতিক বৈরিতার মুখে পড়তে পারে পুরো অঞ্চলটি। বিষয়টা নিয়ে বেশ ক’মাস আগে কিছু জাতীয় পত্রিকায় লেখালেখিও হয়েছে। ভেবেছিলাম যাক, এবার তাহলে বিষয়টার একটা রফা হবে! গ্রীষ্মের ছুটির কারণে এবার সেখানে গিয়ে দেখি প্রকল্পটি বহাল তবিয়তে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। প্লট হস্তান্তরের প্রক্রিয়া চলছে। সবই ঘটছে প্রশাসনের চোখের সামনে। চোখে ঠুলি আর কানে তুলো দিয়ে প্রশাসন ভাবলেশহীন নির্বিকার। বিষয়টা যেন অনেকটা এমন- ব্যক্তিমালিকানাধীন জমি সুতরাং জমির মালিক নিজের জমিতে কি করবেন, কি করবেন না আর তাতে মহাসড়কের ব্রিজ বন্ধ হল কি হল না সেটা নিয়ে হাউকাউ করা প্রশাসনের কাজ না। যেটা ঘটছে সেটাই ঘটার কথা--অতি স্বাভাবিক। কোনো অসামঞ্জস্য থাকলে সেটা দেখার এবং কঠোর হাতে নিয়ন্ত্রণের জন্য দেশে আদৌ সরকার আছে কিনা ভাবি মাঝে মাঝে! অসংলগ্ন, অবৈধ এবং দৃষ্টিকটু বিষয়াদি কি শুধু আমাদের মত সাধারণ মানুষদের চোখেই পড়ে!ভাবান্তরে প্রশাসনের লোকজন সবাই আসলেই এলিট শ্রেণীর। ভিন গ্রহের। সার্বিক নজরদারি করার সময় কোথায় তাদের! ক্ষমতার কামড়াকামড়ি করেই সময় যায়। নানারকম উল্টাপাল্টা ভাবনায় মনটা বিষন্ন হয়ে গেল।
পৌরসভার চোখের সামনে জলজ্যান্ত একটা ব্রিজকে পুরো অকার্যকর করে দেওয়া এই আবাসন প্রকল্পটি নিয়ে এলাকার মেয়র কোনো পদক্ষেপ নিয়েছেন কিনা জানতে ইচ্ছে হল। মেয়র শামিম আল রাজি জানালেন,‘ ‘’ব্রিজের মুখ বন্ধ করে দিয়ে গড়ে ওঠা আবাসিক প্রকল্পের জন্য পৌরসভা থেকে কোনো অনুমোদন নেওয়া হয়নি। পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা পুরো নষ্ট হয়ে গেছে। আমার কাজের সীমাবদ্ধতা আছে। ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়ায় চলছে এর কার্যক্রম। আমি নিজে নোটিস করেছি সেই সঙ্গে সওজ কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ করেছি। তবে তারা এখনো মামলা করেনি। সওজ তার ভূমিকা পালনে ব্যর্থ হলে তখন পৌরসভা থেকেই প্রকল্পের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিতে হবে। ‘’
সিংড়ার সংসদ সদস্য জুনায়েদ আহমেদ পলকের সাথে কথা হলে তিনি জানালেন, ‘আমি সড়ক বিভাগের সাথে যোগাযোগ করে প্রকল্পের জায়গা কয়েকবার মাপযোগ করিয়েছি। সওজ এর কিছু অংশ অবৈধভাবে প্রহণ করে নির্মিত প্রকল্পটির অবৈধ স্থাপনা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে। এর বাইরে পুরো প্রকল্পটির বিপক্ষে সওজ কিছু করার ক্ষমতা রাখেনা। আমি প্রকল্পটির অবৈধ কার্যক্রম নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরকে নোটিস করব খুব শিগগিরি। গোটা চলনবিল অঞ্চলের পরিবেশ রক্ষায় তারা যেন বিষয়টির সঠিক সুরাহা করেন আশা করবো। তবে আমি বলতে চাই পৌরসভা থেকে যেহেতু প্রকল্পটির কোন অনুমোদন নেওয়া হয়নি এবং এর বিরুদ্ধে পৌরসভাও কোন কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি তাই জনগুরুত্বপূর্ণ কাজে অব্যবস্থাপনার দায়িত্ব পৌরসভার মেয়রকে নিতে হবে। ’
একজনের ব্যর্থতা অন্যজন যদি ঢাকবে, তবে আরেকজনেরটা কে ঢাকবে? ব্যর্থতা নিয়ে প্রশাসনের লোকজন কথা বললে এখন সত্যিই হাসি পায়। ক্ষমতা যাদের হাতে তারাই যদি প্রয়োগিক ক্ষমতা প্রদর্শনে ব্যর্থ হন তাহলে আমরা আমজনতা কোথায় গিয়ে দাঁড়াব! ক্ষমতার সঠিক ব্যবহারে কম্পহস্ত মানুষ নিশ্চয়ই সেই কাজের জন্য উপযুক্ত নন। মানুষের আগ্রাসী ক্ষুধার কারণে বাংলাদেশ একদিন অন্য বাংলাদেশে রুপান্তরিত হবে। সেখানে আমার মত কিছু বুড়ো না পারব কিছু বলতে, না পারব প্রতিবাদ করতে---শুধু নেতিবাচক মুখভঙ্গী করে স্মৃতিকাতর হব। আশাহীন মানুষ নিজেরই কুশপুতুলের মতো। নিরন্তর আশা জাগিয়ে রাখি মনে।
মানুষের সব চাহিদাই পূরণ হতে হবে বৈধ এবং সুপরিকল্পিত ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে। রাজনৈতিক দলাদলি আর হঠকারিতার শিকার যেন না হয় আমাদের পরিবেশ।
বাংলাদে সময় : ১৯১০ ঘণ্টা, ০৪ জুন, ২০১২
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
[email protected]