ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

তোফায়েল-মেননের ক্ষোভের কারণ কী এটাই!

ফজলুল বারী, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯৪২ ঘণ্টা, জুন ৭, ২০১২
তোফায়েল-মেননের ক্ষোভের কারণ কী এটাই!

সংসদে হঠাৎ করে বিচার বিভাগ তথা সাম্প্রতিক বিশেষ আলোচিত বিচারপতি এ এইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিকের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের সাংসদ তোফায়েল আহমেদ এবং মহাজোটের তথা ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন কেন এভাবে এতটা উত্তেজিত, ক্ষিপ্ত আচরণ দেখালেন, এর সম্ভাব্য কারণ বলেছেন, হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট অ্যাডভোকেট মনজিল মোরশেদ।

সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী এই মনজিল মোরশেদ সম্পর্কে তোফায়েল আহমেদ সংসদে বলেছেন, ``যেন তার কোনো কাজ নেই, তাই খালি পত্রিকা দেখে দেখে রিট মামলা দায়ের করেন!``

আর মনজিল মোরসেদ বলেছেন, ‘আমি যেসব কাজ করেছি, তার অধিকাংশ কাজে সাধারণ মানুষ উপকৃত হয়েছেন।

কিন্তু যারা নদী ও সরকারি জমি দখল করেছেন তারা মারাত্মকভাবে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। তাদের ক্ষোভটাকেই সড়ক ভবন সংক্রান্ত মামলায় পরিকল্পিতভাবে কাজে লাগিয়েছেন সংসদ সদস্যদের মাধ্যমে’।

সম্ভাব্য কয়েকটি ঘটনার উল্লেখ করেছেন মনজিল মোরসেদ। এর মধ্যে প্রথমটি হচ্ছে, ভোলার ২৩ কোটি টাকার একটি কাজের টেন্ডারে কাউকে অংশ নিতে দেওয়া হয়নি। এ ঘটনায় একটি মামলা হয়। মামলাটি হয়েছিল তোফায়েল আহমেদের এক আত্মীয়ের বিরুদ্ধে।

মামলার অভিযোগে বলা হয়, তোফায়েল আহমেদের ওই ঘনিষ্ঠ আত্মীয় পিস্তল উঁচিয়ে টেন্ডারে কাউকে অংশ নিতে দেননি! ওই ঘটনার রিট মামলায় বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর বেঞ্চ টেন্ডারের কার্যক্রম স্থগিত করেন এবং রুল জারি করেন। পরবর্তি সময়ে বিষয়টি আপিল বিভাগে যায়। আপিল বিভাগ মামলাটি চার সপ্তাহের মধ্যে নিষ্পত্তি করতে বলেন।

এ আদেশের পরিপ্রেক্ষিতে অন্য একটি আদালত রুল শুনানি করে পুনরায় টেন্ডার আহবানের নির্দেশ দেন। মনজিল মোরসেদের ধারণা, এর কারণে তোফায়েল আহমেদ ক্ষুব্ধ হয়ে থাকতে পারেন। এছাড়া ঘটনাটি নিয়ে ভোলায় ঝাড়ু মিছিলও হয়েছে। এ কারণেও তিনি হয়তো একটু উত্তেজিত।

রাশেদ খান মেননের বিষয়ে মনজিল মোরসেদ বলেছেন, তিনি হাতিরঝিল ও তেজগাঁও এলাকায় শিল্প প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন। যারা ওই এলাকায় বেআইনিভাবে শিল্প প্লট বরাদ্দ পেয়েছেন, তাদের বিরুদ্ধে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর বেঞ্চ সুয়োমোটো আদেশ দিয়েছেন। এ কারণে হয়তো তিনিও ক্ষুব্ধ হয়েছেন।

এই দুটি ঘটনা শুনে আমি ব্যক্তিগতভাবে হতবাক হয়েছি। কারণ এ দু’জন রাজনীতিকই বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের দুই উজ্জ্বল নক্ষত্র। আমার মতো অনেকের চোখের মণি। বাঙ্গালির স্বাধিকার আন্দোলন থেকে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধ, এরশাদ স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন, যুদ্ধাপরাধী, সাম্প্রদায়িকতা বিরোধী আন্দোলনে দু’জনেই বরাবর সামনে থেকে নেতৃ্ত্ব দিয়েছেন। দু’জনেই হয়েছিলেন  ডাকসু’র ভিপি। যে দুটি সম্ভাব্য কারণ অথবা সাবজেক্টের কথা বলা হয়েছে, দেশের জন্য তাদের অবদান অনেক অনেক বড়।

মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর সংস্কারের বদনামে এই দুই অভিজ্ঞ রাজনীতিককে মন্ত্রিসভায় না নেওয়ায় যারা হতবাক-মর্মাহত হয়েছেন, আমি তাদের একজন। দু’জনের সঙ্গে নানা কারণে আমার একটি ব্যক্তিগত সম্পর্কও হয়েছিল। বাবার চাকরির সূত্রে আমার শৈশবের কিছুদিন দিন কেটেছে ভোলায়। সেই দ্বীপজেলা শহরের কালীনাথ রায়ের বাজারের ঐতিহ্যবাহী মোল্লাবাড়ী-তালুকদার বাড়ির মাঝামাঝি নাগর আলীর বাড়িতে আমাদের পরিবারটি ভাড়া থাকতো।

তোফায়েল আহমেদ তালুকদার বাড়ির জামাই। মোল্লাবাড়ী-তালুকদার বাড়িতে আমার শৈশবের অনেক খেলার সাথী আছেন। তাদের অনেকের সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্কটি এখনও অটুট। বড় হয়ে ভোলায় গিয়ে হোটেলে উঠলে সেই ছেলেবেলার খেলার সাথীদের তোফায়েল ভাই’র শ্যালকদের একজন হোটেলে এসে আমাকে তাদের বাড়ি নিয়ে যান। আমি সেখানে খুঁজি আমার ছেলেবেলার হারানো নানা স্মৃতি। সবার  ছেলেবেলার স্মতিই বুঝি এমন মধুর-অম্লান, মূল্যবান!  

যাদের স্নেহে থেকে ঢাকার মিডিয়ায় কাজ শুরুর প্রথম দিনগুলো কাটিয়েছি রাশেদ খান মেনন তাদের একজন। সর্বশেষ মেনন ভাই’র জন্মদিন উপলক্ষে এক লেখায় এসব লিখেছি। ইস্কাটনের গাউস নগরে তার ছোট ভাই মুক্তিযোদ্ধা শহীদু্ল্লাহ খান বাদল ভাই’র বাড়ির ছাদের ওপরের একটি বাসায় মেনন ভাই থাকতেন, সে কথা লিখেছিলাম সে লেখায়।

লেখাটি পড়ে আমাকে একজন একটি ক্ষুদে বার্তায় জানান সংসদীয় কমিটির সভাপতি হিসাবে আপনার একদার সর্বহারা মেনন ভাই’ কি পরিমাণ কামিয়েছেন, একটু খবর নিয়ে দেখুন। অনেক দিন দেশে নেই বলে টাটকা অনেক কিছুই জানি না। আরেক সর্বহারা দিলীপ বড়ুয়া যিনি খালেদার সঙ্গে চীন সফর  করে এসে মেনন ভাই-ইনু ভাইদের টপকে শেখ হাসিনার মন্ত্রিসভায় গিয়ে যে তিন বছরেই এত প্লট-গাড়ি সম্পদের মালিক হয়ে গিয়ে এখন ড ইউনূস থেকে শুরু করে অনেককে সারাদিন জ্ঞান দেন, তা সবার মতো মিডিয়ার মাধ্যমেই জানি।

গত বিএনপি আমলে হাওয়া ভবন সরকারের কাছের অনেককে খুশি করতে সরকারি রাস্তা গায়েব করে বানানো শিল্প প্লট দেওয়া হয়। সেখানে বিভিন্ন মিডিয়া মালিক থেকে শুরু করে আমার প্রিয় মেনন ভাইও যে সৌভাগ্যবানদের একজন হয়েছিলেন, তা জানা ছিলো না! ধন্যবাদ মনজিল মোরসেদ। সব দেখেশুনে ভেতর থেকে `নাউজুবিল্লাহ ` শব্দটি বেরিয়েছে! মুসলমান পরিবারে জন্মতো! এমন নানা কিছুতে ভিতর থেকে মুসলমানি/আরবি শব্দই বেরোয়!

এখন কারও আত্মীয়ের ২৩ কোটি টাকার টেন্ডার, কারও প্লট হুমকির মুখে পড়ার উত্তেজনা-আতঙ্কে সংসদ-বিচার বিভাগকে যে মুখোমুখি করা গেছে, এর জের কিন্তু  অনেকদূর গড়াবে মনে হচ্ছে! তোফায়েল আহমেদ-রাশেদ খান মেনন দু’জনে বুধবারও সংসদে রাষ্ট্রপতিকে দিয়ে বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর চাকরি নট করার উদ্যোগ নিতে স্পিকারকে তাগাদা দিয়েছেন!

সংসদ নেত্রী ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ‘সংস্কারবাদী চক্ষুশূল’ তোফায়েল-মেননকে মন্ত্রিত্ব না দেন, এ ইস্যুতে তাদের পক্ষ নেবেন মনে হচ্ছে। কারণ আমি আগেই লিখেছি, তার সবুজ সংকেত ছাড়া সংসদে এই আলোচনাটি হয়নি!

সরকারের গত সাড়ে তিন বছরের নানাকিছু দেখেশুনে পাওয়া অভিজ্ঞতাটি হচ্ছে খালেদা জিয়ার পরিবারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে সারাদিন বললেও নিজের দল-জোট বা কেবিনেটের কারও বিরুদ্ধ দুর্নীতির অভিযোগ উঠলে তিনি তাদেরকে প্রটেকশন দেন। এটা শেয়ার বাজারের দরবেশ চাচা-আবুল হোসেন থেকে সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত সবক্ষেত্রেই দেখা গেছে!
সংসদ-আদালতের মুখোমুখি অবস্থান নিয়ে বুধবারের পত্রপত্রিকার নানা রিপোর্ট পড়ে মনে হলো ড কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমির-উল-ইসলাম, ড জহির, ব্যারিস্টার রোকন উদ্দিন মাহমুদ প্রমুখ কোর্ট তথা বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর পক্ষ নেবেন। আর সরকারের নানাকিছুর সমালোচক বিএনপি-জামায়াত এ ইস্যুতে পরোক্ষভাবে সরকারের পক্ষ নিতে পারে।

কারণ এই বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরীর বেঞ্চ জিয়াউর রহমানকে ইতিহাসের খলনায়ক, অবৈধ ক্ষমতা দখলকারী, খালেদার সংবিধান ছুঁড়ে মারার বক্তব্যকে তিরস্কার করে তার বিরুদ্ধেও রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হতে পারে, এমন বলেছিলেন। আর এ সুযোগে যদি বিচারপতিদের অপসারণের কর্তৃ্ত্বটি সংসদের কাছে আনা যায় তাহলে আগামীতে আওয়ামী লীগের আমলে নিয়োগপ্রাপ্ত বিচারপতিদের সরাতে তা তারা কাজে লাগাবে!

যেখানে তাদের ভিতর মওদুদ আহমদের মতো কূটবুদ্ধির মানুষ আছেন, সেখানে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার এই সুযোগটি নিশ্চয় তারা হাতছাড়া করবেন না! সব মিলিয়ে এ পরিস্থিতিতে সরকারের বিরুদ্ধে কোর্টকে যতই লাগিয়ে দেওয়া অথবা লাগিয়ে রাখা যাবে, ততই বিএনপির লাভ এবং সরকার তথা আওয়ামী লীগের ক্ষতি!

ক্যাসেট কেলেংকারি মামলায় কোর্টকে ফাঁসানোর চেষ্টা করতে গিয়ে এরশাদ উল্টো এমন ফেঁসে গিয়েছিলেন যে এরপর কোনদিন কোনো কোর্টের কাছে গিয়ে আর কোনো সহানুভূতি পাননি। এই এরশাদের কারণে কোর্টের সদস্য এক বিচারপতিকে পদত্যাগ করে চলে যেতে হয়েছিল। আওয়ামী লীগ কি ভবিষ্যতের জন্য তেমন একটি গর্ত রচনা করতে যাচ্ছে?

ফজলুল বারীঃ সিডনি প্রবাসী সাংবাদিক
সম্পাদনা: নূরনবী সিদ্দিক সুইন, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।