আওয়ামী লীগ সরকার তার এই মেয়াদের প্রায় শেষ সময়ে এসে দাঁড়িয়েছে। এরপরে তারা আসবে কি আসবে না এ নিয়ে বলার সময় এখনও আসেনি।
প্রতিটি দেশেই প্রতিটি সরকার বছরে একবার বাজেট পেশ করে। সামান্য হের-ফের করে এই বাজেট আসলে জাতিকে খুব একটা নতুন কিছু দেয় না। কারণ, নতুন কিছু দেয়ার ক্ষমতা খুব কম দেশের, খুব কম সরকারেরই থাকে। মাথার সঙ্গে লেজ জোড়া দিয়ে, পরের বছর লেজের সঙ্গে মাথা মিলিয়ে মূল শরীর তৈরি করা হয়। এতে কেবল বাজেটের পরিধিই বাড়ে আর বাকিটা একই থাকে।
সম্প্রতি ফিন্যান্সিয়াল টাইমস-এ এরকমই একটি রিপোর্ট পড়ছিলাম। পশ্চিমা ও বড় অর্থনীতির দেশগুলোতে গত এক দশক ধরে একই রকম বাজেট প্রণীত হয়ে আসছে। মাঝে সরকার বদল হলে বাজেটের কিছু লাইন কাট-ছাঁট করা হয়; তাতে মানুষের ওপর করের বোঝা বাড়ে বৈ কমে না। তারপরও দেশ চালাতে হলে হারাধন মুদির মতোই একটি হালখাতা দরকার হয়। বাড়িভাড়া বাড়ার জিনিস বাড়বে, কর্মচারীর বেতন বাড়ানো যায় (কিন্তু কেন বাড়াবো?) এরকম কিছু নয়-ছয় করে হারাধন মুদিও বছরের ছক কষেন আর মুহিত সাহেব প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ‘অর্থ মন্ত্রণালয়’ লেখা পাটের ব্যাগ হাতে (এর আগের লাল স্যুটকেস এবার দেখা যায়নি, সরকার খানিকটা হলেও ইকো-ফ্রেন্ডলি হয়েছে এবং বাংলাদেশের সোনালী আঁশকে প্রমোট করছে, এজন্য সরকার ধন্যবাদ পেতেই পারে) সংসদে ঢোকেন এবং সংসদে দাঁড়িয়ে কয়েক ঘন্টা সময় নিয়ে সেই পাটের ব্যাগবাহিত নথি পাঠ করে শোনান। মজার ব্যাপার হলো, কোনো কালেই কোনো সরকারের বাজেটই বিরোধী দল গ্রহণ করে না; হয় তারা বলে উচ্চাভিলাষী, নয় তো বলে গরীব মারার বাজেট। আর অর্থনীতিবিদরা নানা রকম তুলনামূলক আলোচনা করতে থাকেন ক’দিন ধরে চলা সেমিনার আর সাংবাদিক সম্মেলনে। মিডিয়াও ব্যস্ত থাকে পুরো জুন মাস কেবল বাজেট নিয়েই।
আওয়ামী লীগ শুরু করেছিল বিরোধী দল হিসেবে সমান্তরাল বাজেট পেশ, দেখাদেখি বিএনপিও করেছে। মজার ব্যাপার হলো, বিএনপি এবার বাজেট পেশের আগেই নিজেদের কথা বলে ফেলেছে। ঘোড়ার আগে গাড়ি জুড়ে দিলে যা হয়, তাই-ই হয়েছে, বিএনপি’র প্রস্তাব মুহিত সাহেবের বাজেট-গাড়ির নীচে পড়ে গেছে।
ওদিকে বিভিন্ন সংগঠন আগামী কিছুদিন বাজেটে তারা কি পেলেন আর কি পেলেন না তা নিয়ে নিজেদের অংক কষা অব্যাহত রাখবেন এবং মিডিয়াকে ডেকে নিয়ে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করবেন। মিডিয়া সেগুলো মনোযোগ দিয়ে প্রচার-প্রকাশ করবে। নিজেদের আয়-উপার্জন কিংবা স্বার্থ (যাকে ইংরেজিতে ‘ভেস্টেড ইন্টারেস্ট’ বলা যেতে পারে) কোনো ভাবে আহত হোক তা কেউই চায় না, কিন্তু হিসেব-নিকেশ করতে গিয়ে বাজেটে কোনো না কোনো পক্ষকে কিছু না কিছুতো হারাতেই হয়। তাতেই রব ওঠে ‘গেল, গেল’। আর কিছু বেসরকারী উন্নয়ন-গবেষণা সংস্থা রয়েছে যারা নিজেদের স্বার্থেই “গবেষণা” করে প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে সাহিত্যের ভাষায় সমালোচনা করে থাকেন। আজ পর্যন্ত এমন কোনো বাজেট পাশ হয়নি যা নিয়ে তারা সাঙ্কেতিক শব্দে সমালোচনা করেননি। যেন এই জন্যই তারা অর্থ পেয়ে থাকেন, এবং সে কাজটুকুই তারা মন দিয়ে করেন। যেন বাজেট নিয়ে কিছু বাক্য ব্যয় না করলে তাদের রুজি হালাল হবে না। আমার কথা বিশ্বাস না হয় বর্তমান সরকারের দেয়া বাজেটসমূহ ও বিগত সরকারের দেয়া বাজেটগুলোর সময়কার পত্রপত্রিকা ঘেঁটে দেখুন, প্রায় একই বক্তব্য পাবেন। উদাহরণ হিসেবে আমরা এবারের বাজেট সম্পর্কে এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, গাড়ি আমদানীকারক প্রতিষ্ঠান এবং বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সিপিডির বক্তব্য কয়েকবার পড়ে নিতে পারি। এবং বিগত আমলেও এদের বক্তব্য একই ধারার ছিল।
কিন্তু এতো কথার পরও সংসদে বাজেট পাশ হয়ে যাবে, একটু কাট-ছাঁট্ হবে কিন্তু পাশ হতেই হবে নইলে সরকারের ধারাবাহিকতা নষ্ট হবে। কিন্তু বছর শেষে আবার বাজেট ঘাটতির খবর বেরুবে, উন্নয়ন বরাদ্দ ছাড়পত্র পাবে না এবং এপ্রিল-মে মাসে ঢাকা শহর খোঁড়াখুঁড়ি দেখে আমরা আবার বুঝতে পারবো যে, বাজেট আসছে, পুরনো টাকা রাস্তা খুঁড়েই খরচ করতে হবে। একই ঘটনা কেবল যে বাংলাদেশে ঘটে তা নয়, পশ্চিমেও ঘটে, আধুনিক পৃথিবীর এই-ই নিয়ম। এর বাইরে যাবার সাধ্য খুব কম দেশের খুব কম সরকারেরই আছে। কিন্তু যাদের কথা বলে সরকার বাজেট পেশ করে অর্থাৎ সাধারণ জনগণ এবং এদের দোহাই দিয়েই বিরোধী দল সরকারের দেয়া বাজেটকে প্রত্যাখ্যান করে; আবার এই সাধারণ জনগণের কথা তুলেই গবেষণা প্রতিষ্ঠানগুলো নানা তথ্য-উপাত্ত দিয়ে কঠিন সমালোচনা করে থাকে বাজেটের। কেবল সাধারণরা সাধারণই থেকে যায়, শুধু বাজারে গিয়ে জানতে পারে চালের দাম লাফ দিয়েছে। কিন্তু কিছুতো করার নেই, পেটের দায় বড় দায়; পেটের জন্যই দুনিয়া!!!
একটি বিষয় নিয়ে প্রতি বছরই নানা পক্ষে বেশ বাদানুবাদ হয়ে থাকে। তাহলো জিডিপির সূচক। সরকার বলে এক, উন্নয়ন সহযোগীরা বলেন আরেক; আর দেশের ভেতরকার কিছু বেসরকারি প্রতিষ্ঠান বিদেশি অর্থে গবেষণা চালিয়ে বলেন আরেক। যদিও দেখা যায় যে, এসব প্রতিষ্ঠানের প্রধানদের সঙ্গে যদি সরকারের সম্পর্ক ভালো থাকে তাহলে তারা সরকারের কথাকেই প্রকারান্তরে সমর্থন দেন আর সম্পর্ক খারাপ থাকলেই বেচাল। তারা শুরু করে দেন নানা কারসাজি। আমরা যারা সাধারণ মানুষ, যাদের জীবনযাত্রার মান নিয়ে এই সূচক নির্ধারণ হয় তাদের কাছে কেউ “পুছ” করেও দেখে না ব্যাপারটা। বাংলাদেশ বিগত দশকে কতোটুকু এগিয়েছে তা বোঝার জন্য বড় গবেষক হওয়ার প্রয়োজন নেই। সাদা চোখেই ব্যাপারটা বোঝা যায়। গ্রামীণ বা কৃষি-নির্ভর অর্থনীতির এই অগ্রগতিই যে বাংলাদেশকে এগিয়ে এনেছে এবং সেই সঙ্গে যোগ হয়েছে প্রবাসী শ্রমিকের অর্থ, সেকথা বলাই বাহুল্য। তবুও প্রতি বছর এই জিডিপির সূচক নিয়ে পক্ষ-বিপক্ষের জ্ঞান-গর্ভ মতামত প্রদান সত্যিই হাস্যকর মনে হয়। এ বিষয়ে একটি ছোট্ট কৌতুক পাঠকের সঙ্গে শেয়ার না করে পারছি না।
এক বন্ধু ধরা যাক তার নাম জন, অপর বন্ধু ববের সঙ্গে একজন ভদ্রলোকের পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলছেন, ‘হেই জন, আই উড লাইক টু ইনট্রোডিউস ইউ টু মাইকেল ট্রুডোর। হি ইজ অ্যান ইকোনমিস্ট, বাট হি ইজ রিয়েলি ভেরি নাইস’ (এই যে জন, আমি তোমার সঙ্গে মাইকেল ট্রুডোরকে পরিচয় করিয়ে দিতে চাই। অর্থনীতিবিদ হলেও তিনি কিন্তু সত্যিই খুব ভালো)।
যাহোক, বাজেট নিয়ে এতো কথা বলার অর্থ হচ্ছে, যে কোনো সরকারই নিজেদের স্বার্থ বিচার করে একটি বাজেট দিয়ে থাকে। বিরোধী দলও নিজেদের স্বার্থের কথা ভেবেই তার বিরোধিতা করে। আবার বিভিন্ন সংগঠন, প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি-মানুষও নিজেদের অবস্থান থেকেই বাজেটের ভালোমন্দ নিয়ে কথা বলেন। মাঝখানে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ কেবল থেকে যায় দূরে; আসলে যাদের জন্য এই বাজেট, তারাই বাদ পড়ে যায় পুরোটা প্রক্রিয়া থেকে। আগেই বলেছি, তারা কেবল বাজেটের জ্বালা টের পান কাঁচা মরিচে কিংবা বেগুন-তরকারিতে, মাছে বা মুরগিতে। আর দাম যার একবার বাড়ে তা আর কোনোওদিনই নামে না, এতে মুরগিও যা গরুও তা; কেবল মানুষেরই দাম ক্রমশঃ কমতে থাকে, কমতে কমতে মানুষ ক্রমশঃ মূল্যহীন হয়ে পড়ছে--- দুঃখটা এখানেই!!
লেখক: সম্পাদক, একপক্ষ।
[email protected]
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
[email protected]