২০১২-২০১৩ অর্থবছরের বাজেটে বহুল আলোচিত ও সমালোচিত বিদ্যুৎ খাতের রুপরেখামুলক প্রণিধানযোগ্য বাজেটের কথা বলা হয়েছে। বিদ্যুৎ সেক্টর নিয়ে বাজেটে কি থাকছে তা কৌতূহল জাগিয়েছে সাধারণ মানুষের মনে।
সাধারণ মানুষজনের কাছে কতো টাকার বাজেট এলো কতো টাকার বাজেট গেলো তা খুব একটা গুরুত্ব বহন করে না। পুরো বাজেটে বিদ্যুৎ খাত নিয়ে কি থাকছে তা জানতে সমাজের নেহাত দরিদ্র মানুষজনও বসেছেন টিভির সামনে। প্রস্তাবিত বাজেটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে উন্নয়ন-অনুন্নয়ন মিলে ৯ হাজার ৫৪৪ কোটি টাকা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
এই অংকটা মোট বাজেটের ৫ শতাংশের সমান। গেল অর্থবছরে এ খাতে বরাদ্দ ছিল ৮ হাজার ৩১১ কোটি টাকা। এ বছরে এ খাতে ১ হাজার ২৩৩ কোটি টাকা বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে। আগামী অর্থবছরে বিদ্যুতের উৎপাদন ধরা হয়েছে ৮ হাজার ২৯ মেগাওয়াট। গত বছরের তুলনায় যা ৩ হাজার মেগাওয়াটেরও বেশি। অর্থমন্ত্রী বাজেট আলোচনায় উল্লেখ করেন এ সরকার যখন ক্ষমতা গ্রহণ করে তখন মাথাপিছু বিদ্যুতের ব্যবহার ছিল ২২০ কিলোওয়াট ঘন্টা।
যা ৩ বছরে বেড়ে হয়েছে ২৬৫ কিলোওয়াট ঘন্টা। ৩ বছরে সরকার ১ কোটি ৩০ লাখ গ্রাহককে নতুন করে বিদ্যুতের আওতায় আনতে পেরেছে। যার ফলে মোট জনসংখ্যার প্রায় ৫৩ শতাংশ বিদ্যুৎ ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে। ২০০৯ সালে এ সংখ্যা ৪৭ শতাংশে সীমাবদ্ধ ছিল।
বিশাল কর্মসাধনের পরও মানুষ লোডশেডিংয়ের কবল থেকে মুক্ত হতে পারেনি বলেও অর্থমন্ত্রীর আক্ষেপ ছিল বাজেট আলোচনায়। পুরো বাজেট আলোচনায় অর্থমন্ত্রী বার বার বিদ্যুৎ সেক্টরকে টেনে এনেছেন। রেন্টাল কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রলোর সাফাই গেয়েছেন। যারা এসবের সমালোচনা করে অর্থমন্ত্রীর ভাষায় তারা অজ্ঞতাবশতই এনব করে। । তিনি নিজেও অবশ্য বিভিন্ন সময়ে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পিছনে রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে দায়ী করে আসছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি উপদেষ্টাতো রেন্টাল কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোর সমালোচনাকারীদের দেশবিরোধী বলতেও পিছপা হননি। তবে সত্যিকার অর্থেই ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোই এ সেক্টরকে অস্থির করে তুলেছে।
আগামী বছরে বিদ্যুতের চাহিদার কথা বিবেচনা করে সরকার কিছু বিশেষ প্রকল্প গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। সামনের বছরে আরো অন্তত ৫টি ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র যোগ হচ্ছে বলে বিদ্যুত বিভাগ নিশ্চিত করেছে। তবে আগামী বছরে কতো লক্ষ নতুন বিদ্যুত সংযোগ দেয়া হবে তার কোন সঠিক পরিসংখ্যান অর্থমন্ত্রী দিতে পারেননি।
বিদ্যুৎ নিয়ে সরকারের নিজস্ব সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা রয়েছে। নিরবিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগের ব্যপারেও সরকার নতুন ফর্মুলায় অগ্রসরমান। বিদ্যুতের দাম বৃদ্ধিতে সরকার ডাবল হ্যাটট্রিকের পথে। একের পর বিদ্যুতের মুল্যবৃদ্ধির প্রতিযোগিতায় সরকার সাধারণ মানুষজনকে বিবেচনায় নিচ্ছে না।
এই প্রবণতা সরকারের জন্য বুমেরাং হয়ে যেতে পারে বলেই বিশ্বাস। আগামী অর্থবছরে কতোবার বিদ্যুতের মুল্যবৃদ্ধি হবে তা নিয়েও মানুষের মধ্যে ভীতি রয়েছে। সরকারের উচিত বাজেট আলোচনায়ই তা নির্দিষ্ট করা।
ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতেই সরকারের যতো আগ্রহ। পুরাতন বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো মেরামতে আগ্রহ নেই বললেই চলে। ২০০৯ সালে ক্ষমতা গ্রহণের পর আওয়ামী লীগ জনগণকে আশ্বস্ত করেছিল ২০১১ সালে লোডশেডিংয়ের কবল থেকে জাতির মুক্তি মিলবে। কিন্তু তাদের সেই প্রতিশ্রুতি বাস্তবতার ধারেকাছেও নেই।
তদুপরি এ সেক্টরে কর্মরত কর্তাব্যক্তিদের অপরিপক্ক কথাবার্তা জনমনে নানান প্রশ্নের জন্ম দিচ্ছে। দেশ সামনের দিকে অগ্রসরমান। মানুষ এখন পিছনের কথা চিন্তা করতে চায় না। বিএনপির আমলে কি হয়েছে না হয়েছে তা মানুষ ভুলে গেছে। বর্তমান নিয়ে সাধারণ মানুষ আশ্বস্ত হতে চায়। তাই তুলনামুলক চিত্র নয়। সত্যিকার অর্থেই বিদ্যুতের উন্নয়ন প্রয়োজন। মানুষ বিদ্যুৎ চায়। আর সেই চাহিদা সরকারকেই পুরণ করতে হবে। বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণে সুষ্ঠ পরিকল্পনার প্রয়োজন।
অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিদ্যুতের প্রয়োজন । বিদ্যুৎ সংযোগ দিতে না পারলে বিদেশি বিনিয়োগ কমে যাবে। দেশে গ্যাস ও বিদ্যুতের অভাবে গত কয়েক বছর আশানুরুপ শিল্পোৎপাদন হয়নি বা ব্যাহত হয়েছে। অনেক কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বিনিয়োগে বন্ধ্যাত্ব বা ¯হবির অব¯হা বিরাজ করছে। প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী বিদ্যুতের যোগান দিতে এখনও সরকার এক রকম ব্যর্থই বলতে হবে। আওয়ামীলীগের নির্বাচনী অঙ্গীকার ছিল দেশে বিদ্যুৎ ও জজ্বালানি সমস্যা আশু নিরসন করবে।
কিন্তু সরকার তার গৃহীত পদক্ষেপ দিয়ে মানুষের মনে সন্তুষ্টি জন্মাতে পারেনি। যদিও বিএনপির রেখে যাওয়া হতাশাজনক এক বিদ্যুৎ সেক্টর নিয়েই আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। পূর্ববর্তী সরকার বিদ্যুৎ খাতে লুটপাট করে ভঙ্গুর অব¯হা রেখে গেছে এ কথা যেমন সত্য, তেমনি আবার বিদ্যুৎ খাতে যে অনিয়ম লুটপাট হচ্ছে সে অভিযোগও সত্য নয় বলে উড়িয়ে দেওয়া যাবে না।
ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র দিয়ে বিদ্যুত ব্যবসায়ীরা অঢেল বিত্ত বৈভবের মালিক হয়েছে। কিন্তু দেশের বিদ্যুতের চেহারার খুব একটা হেরফের হয়নি। জ্বালানি তেল ক্রয়ে সরকারকে প্রত্যেক মাসে ১২০০ থেকে ১৪০০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে।
বিনিয়োগের পূর্ব শর্ত হলো বিদ্যুৎ। সরকার সরাসরি বিনিয়োগকারীকে বিদ্যুৎ দিতে না পারলে জ্বালানি তেল দিতে হবে। সেক্ষেত্রেও প্রতি লিটার জ্বালানি তেলে সরকারকে ভর্তুকি গুনতে হবে ক্ষেত্রভেদে ২০ থেকে ২৬ টাকা। তাহলে এতো বিশাল আর্থিক ক্ষতির বোঝা নিয়ে কতোদিন চলতে পারবে তাও প্রশ্নাতীত নয়। বিদ্যুতের সিস্টেম লস ও চুরি রোধ করাও জরুরি। ছোট ছোট বিদ্যুত কেন্দ্র দিয়ে খুব আশাপ্রদ কিছু পাওয়া যাবে না। বিদ্যুতের যোগান দিতে হলে বড় বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের দিকে ধাবিত হতে হবে। কয়লা ও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র থেকে বড় ধরনের সাফল্য আসতে পারে। সেক্ষেত্রে সরকারকে অভ্যন্তরীন কয়লা উত্তোলনে ত্বরিৎ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একটা বড় প্লান্ট ¯হাপনে তিন বছরের মতো সময়ের প্রয়োজন হয়। কিন্তু এ সরকারের হাতে সময় খুব অল্প।
এই অল্প সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎ নিয়ে সরকার সাময়িক পদক্ষেপ ছাড়া দীর্ঘমেয়াদী পদক্ষেপ যে নেবে না তা বলাই বাহুল্য। গেলো তিনটি বছরে সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের সুবাদে বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানের বিল পরিশোধে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে হিমশিম খেতে হচ্ছে। সঠিক সিদ্ধান্তই বিদ্যুৎ পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটাতে পারে। তাই সত্যিকার অর্থেই বিদ্যুতের জন্য দীর্ঘমেয়াদী ও কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করার বিকল্প নেই। সরকার জাতিকে বিদ্যুতের ক্লান্তি থেকে মুক্তি দেবে এমন প্রত্যাশাই এদেশের সাধারণ মানুষের।
হাসান কামরুল: ভূতত্ত্ববিদ, [email protected];
বাংলাদেশ সময়: ১০০০ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০১২
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
[email protected]