আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক শতরঞ্জে বিশ্ব মোড়লদের দৃষ্টি এখন ‘সিরিয়া’র দিকে। প্রতিদিন সারা বিশ্বের মানুষের কাছে এসে পৌঁছুচ্ছে অনেক অপ্রীতিকর খবর।
অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য যে সিরিয়ার এই অপ্রীতিকর পরিস্থিতি বিশ্বের আধিপত্যবাদীদের ক্ষমতার ভিত আরও মজবুত করার জন্য একটি বড় মওকা। ‘হাওলা’ এবং ‘হোম’- এ দু‘সপ্তাহ আগে যে হত্যাযজ্ঞ হয়ে গেল তা বিশ্ব বিবেককে হতভম্ব করে দিয়েছে। শিশু এবং মহিলাসহ শতাধিক মানুষের লাশ, শত মানুষের আর্তনাদ সিরিয়ায় আধিপত্যবাদীদের হাতে সামরিক হস্তক্ষেপের মওকা তুলে দেবার জন্য যথেষ্ট। জাতিসংঘে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত তো বলেই ফেললেন প্রয়োজনে তারা জাতিসংঘের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা না করেই সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ করবেন। কাগজে আরও পড়লাম, মার্কিন সামরিক বাহিনীর প্রধান বলেছেন তারা আদেশের অপেক্ষায় রয়েছেন। অন্যদিকে রাশিয়া এবং চীন কফি আনানের শান্তি পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অটল।
এ প্রসঙ্গে সিরিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অভ্যন্তরীণ কলহ, এর সূত্রপাত এবং এগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত আনুষঙ্গিক বিষয়াবলির উপর আলোকপাত প্রয়োজন।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষে বলশেভিক বিপ্লবের কারণে সারা বিশ্ব যখন দু‘টি শিবিরে বিভক্ত হওয়ার পথে ঠিক সে সময়ে অটোমান সাম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ এলাকাকে যুদ্ধজয়ের প্রাপ্তি হিসাবে ব্রিটিশ এবং ফরাসি সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে ছেড়ে দেওয়া হয়। অটোমান সাম্রাজ্যের উর্বর অংশ ইরাক ও ফিলিস্তিন ব্রিটিশদের এবং সিরিয়া ফরাসিদের কক্ষিগত হয়। পক্ষান্তরে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য অঞ্চলগুলো অর্থাৎ যেগুলো অর্থনৈতিক দিক দিয়ে তেমন লাভজনক ছিল না সেগুলোকে বিভিন্ন উপজাতীয়দের হাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীকালে এগুলোতেই গড়ে ওঠে বিভিন্ন রাজতন্ত্র।
ফিরে আসা যাক্ মূল আলোচনায়। রাজনৈতিক কারণে ইরাক ও ফিলিস্তিন ভেঙ্গে দু‘টি দেশ হয়ে যায়; একটি হলো ফিলিস্তিন এবং অন্যটি জর্দান। একইভাবে সিরিয়া ভেঙ্গে হয়ে যায় ‘সিরিয়া‘ ও ‘লেবানন’। বর্তমানে সিরিয়ান রিফিউজিদেরকে আশ্রয় দিয়ে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্কে নতুন করে ফাটল সৃষ্টি করছে লেবানন।
অন্যদিকে, রয়েছে মার্কিন মদদপুষ্ট ‘ইসরায়েল’, যারা পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি সময়ে দখল করে নেয় ভূমধ্যসাগরের তীর ঘেঁষা সিরিয়ার একটি তাৎপর্যপূর্ণ ভূখণ্ড। দখলকৃত ঐ এলাকায় ইসরায়েলের দৌরাত্ম্য ইরান কিংবা সিরিয়ার কাছে সহনীয় নয়। আর এই উল্লেখযোগ্য কারণেই সিরিয়া এবং ইরানের মধ্যে এত সখ্য। এর আরও অনেক কারণ অবশ্যই রয়েছে। যেমন, ফিলিস্তিনের সঙ্গে ইরানের ব্যবসায়িক যোগাযোগ রক্ষা করার নিরাপদ রাস্তা হলো সিরিয়া। যে পথপানে সামান্য সাহায্যের আশায় চেয়ে থাকে ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী মানুষ।
মধ্যপ্রাচ্যের ভেতরে শিয়া-সুন্নিদের আদর্শগত মতপার্থক্য এবং পারস্পরিক আধিপত্য সংরক্ষণের লড়াই নতুন কিছু নয়। এ লড়াইয়ের ভীতিকর রূপ আমরা দেখেছি মাত্র কিছুকাল আগে বাহরাইনে। সেখানে সুন্নি রাজতন্ত্র তাদের একনায়কতন্ত্রবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনকে নির্মমভাবে স্তব্ধ করে দিয়েছে আর বিশ্বমোড়ল আমেরিকা তা দেখেও না দেখার ভান করে গেছে। আর সৌদি আরবে রাজতন্ত্রবিরোধী আন্দোলন তো দূরের কথা যে কোনো প্রকারের কানাঘুষাও কঠোর হাতে দমন করা হয়। রাজতন্ত্রবিরোধী বেশীরভাগ আন্দোলনই কিন্তু শিয়াদের নেতৃত্বে সংগঠিত হয়েছে। অতএব শিয়াসমর্থিত সিরিয়া সরকারের বিরোধী শক্তিরা যে সৌদি আরব ও আরবলীগের সমর্থন পাবে সেটাই স্বাভাবিক।
শিয়া-সুন্নিদের শত্রুভাবাপন্ন মনোভাব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের পশ্চিমা মিত্রদের জন্য এক মোক্ষম সুযোগ। এই সুযোগ তারা কাজে লাগিয়েছিলেন ইরাকে। সেখানে সাদ্দামবিরোধী আন্দোলনকে একদিকে শিয়া-সুন্নি ঝগড়ার ঢাল দিয়ে আড়াল করে রেখে অন্যদিকে মিথ্যা ডোসিয়ার তৈরি করে সরাসরি সামরিক হামলা চালিয়ে সরকার পরিবর্তন করা হয়েছিল। অথচ তা সেদেশের জনগণের কাম্য ছিল না। একইভাবে লিবিয়ায় জনগণ সরকারের পরিবর্তন ঘটায়নি; বরং সরকারের বদল হয়েছে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের সশস্ত্র সামরিক হস্তক্ষেপে। অত্যন্ত নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে ’মুয়াম্মার গাদ্দাফি’-কে। এরই পরিণতিতে লিবিয়া নামের রাষ্ট্রটি এখন আইন শৃঙ্খলাহীন, আগাগোড়া নৈরাজ্যকবলিত এক দেশ। সেখানে কেবলই রক্তের অবিরল ঝর্না বয়ে চলেছে। এই রক্তস্রোত কখন থামবে কেউ জানে না। থামানোর তাগিদও কারোর নেই।
একইভাবে এখন সিরিয়ার জনগণের মুক্তির আন্দোলনকে শিয়া-সুন্নি লড়াইয়ে রূপ দেওয়ার জন্য তৎপর আধিপত্যবাদীরা। সংবাদ মাধ্যমে যা স্পষ্টভাবে দেখানো হচ্ছে, সিরিয়া সরকার সমর্থিত ’আলওয়াইদ’ গোত্রের শিয়ারা-ই ‘হাওলা’ এবং ‘হোম’ অঞ্চলে হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছে। যাদের হত্যা করা হয়েছে বা হচ্ছে তারা সবাই ‘সুন্নি’। এই প্রপাগান্ডা বিশ্বের সুন্নিদের তথা আল্ কায়দার সমর্থন লাভের জন্য কিংবা ধর্মোন্মাদদের উসকে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। বাস্তবে কিন্তু হচ্ছেও তা-ই। সিরিয়া সরকারের বিরোধীরা মূলতঃ সুন্নি এবং সুন্নি সমর্থিত। আসাদের মদদপুষ্ট আধা সামরিক বাহিনীই ঘটাচ্ছে এইসব হত্যাযজ্ঞ---এই অভিযোগ যুক্তরাষ্ট্র ও তার পশ্চিমা মিত্রদের। তবে আসাদ-বিরোধীরাও যে সৌদি আরব ও আমেরিকার মদদে রক্তের হোলি খেলছে না --এমন কথা জোর দিয়ে বলা যাবে না।
সামরিক এবং অর্থনৈতিক হস্তক্ষেপ তো সেখানে হয়েই আছে। সৌদিদের অর্থ সাহায্য এবং যোগাযোগের জন্য প্রযুক্তি সরবরাহই সিরিয়ায় বিরোধী শক্তিকে বলীয়ান করে রেখেছে, যে কারণে সামরিক শক্তিতে সুসজ্জিত এবং অত্যন্ত শক্তিশালী ফোর্সকে তারা চ্যালেঞ্জ করতে পারছে। অন্যদিকে কফি আনানের প্রচেষ্টায় উৎসাহ দেওয়াকে লোকদেখানো নাটক ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছে না। যদি তাই না হতো তাহলে কফি আনানের সাথে আলোচনা চলাকালে বিরোধী ফোর্সের আক্রমণের খবর শুনতে হতো না।
প্রতিদিন যেসব খবর পত্রিকার পাতায় আসছে তা থেকে ধারণা করা যাচ্ছে যে, শিয়া-সুন্নি শত্রুতার মনোভাব এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে, এখন যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তাদের মিত্ররা সামরিক হস্তক্ষেপ করে তাহলে এ মনোভাব মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য এলাকায়ও ছড়িয়ে পড়তে পারে। ছড়িয়ে পড়াটাই স্বাভাবিক। অর্থাৎ ‘হাওলা’ কিংবা ‘হোম’ - এ যে পরিমাণ রক্তক্ষয় হয়েছে তার থেকে অনেকগুণ বেশি রক্তক্ষয় হওয়ার ঘোরতর আশংকা রয়েছে সিরিয়া এবং এর পার্শ্ববর্তী এলাকাগুলোতে।
সিরিয়ায় সামরিক হস্তক্ষেপ হলে শিয়া–সুন্নিদের পারস্পরিক ঘৃণা সারা মধ্যপ্রাচ্য তথা মুসলিম বিশ্বে ছড়িয়ে পড়তে পারে। সর্বোপরি উভয় পক্ষে ধর্মোন্মাদরা তো রয়েছেই। তাহলে উপায় ? রক্তক্ষয়ের পরিমাণ কমিয়ে সমাধান খুঁজতে হবে। আপাততঃ যা জানা যাচ্ছে তাতে মনে হচ্ছে কফি আনানের পরিকল্পনাকে উৎসাহিত করার পাশাপাশি রাশিয়া এবং চীনের মাধ্যমে বাশার আল্ আসাদের উপর চাপ সৃষ্টি করে তার ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা নিশ্চিত করাই হবে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। এতে করে আসাদ এবং বিরোধী পক্ষ একটা সমঝোতায় পৌঁছুতে পারে। আর সমঝোতায় পৌঁছুতে পারলেই সিরিয়ার জনগণ তাদের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করার সুযোগ পাবে। বহির্বিশ্বের সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন হলে সমস্যার সমাধান না হয়ে, লিবিয়ার মতো অবস্থা হয়তো হয়ে যেতে পারে । অর্থাৎ সৃষ্টি হতে পারে আইন শঙ্খলাহীন এক নতুন সিরিয়া যা বিশ্বের মুক্তিকামী মানুষের কাম্য নয়।
লেখক: ফ্রিল্যান্স রিসার্চার অন কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স, লন্ডন;জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
[email protected]