বেশ কিছুদিন যাবৎ সাংবাদিকদের উপরে পুলিশি অত্যাচার এবং অতি সম্প্রতি পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের বেতন বৃদ্ধির দাবীতে চলা আন্দোলনে শ্রমিকদের উপরে পুলিশদের নির্মম নির্যাতনের বেশ কিছু ভয়াবহ ছবি ফেইসবুক, ব্লগে ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে।
খুশীর বিষয়, পোশাক শিল্পের এই অচলাবস্থা বেশীদিন স্থায়ী হয়নি।
রাজনীতিবিদদের কাছে গরীবের প্রয়োজন হয় শুধুমাত্র ভোটের সময়ে। ধনীর প্রয়োজন টাকার জন্য। ভোট দরকার প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর। কিন্তু টাকার প্রয়োজন প্রতিটা মুহুর্তে। গরীবেরা আবেগী। তাই তারা পাঁচ বছর পরে ভোট আসতেই সব ভুলে যায়। যে নেতারা ক্ষমতায় গিয়ে তাদের স্বার্থকে গুরুত্ব দেয়নি, তাদের মিথ্যে প্রতিশ্রুতির ফাদেঁ পড়ে আবারো ভোট দিয়ে ক্ষমতায় পাঠায়। অন্যদিকে, ধনীরা বুদ্ধিমান। তারা বেশ ভালভাবেই রাজনীতিবিদদের টাকা দিয়ে কিনে ফেলে। রাজনীতিবিদরা হিসেবী। তাই হিসেব কষে ধনীর পক্ষেই তার অবস্থান যায়। তাইতো ন্যায্য মজুরির দাবিতে লড়াইরত রাজপথে শ্রমিকের রক্ত ক্ষমতায় থাকা লোকদের টলাতে না পারলেও মালিক পক্ষের এক হুমকিতে তাদের ঠিকই টনক নড়ে।
বছরের পর বছর ধরে আমরা দেখে আসছি শ্রমিকরা বেতন ভাতা বৃদ্ধির দাবিতে রাস্তায় আন্দোলন করে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে মারাও যায়। অন্যদিকে, মালিকপক্ষ বলে আসছে বেতন বাড়ালে তাদের আন্তর্জাতিক বাজারে টেকা দায়। অভিজ্ঞতা বলে ভিন্ন কথা। পোশাক শিল্পের মালিকদের অনেকেই যুক্তির চেয়েও দ্রুতগতিতে একের পর এক কারখানা বাড়িয়ে টাকার কুমীর হয়েছে। যারা টিকতে পারেনি তার পিছনে শ্রমিকের বেতন বাড়ানো কারণ ছিল না। প্রতিযোগিতাপূর্ণ বাজারে ভিন্ন কারণে তারা ছিটকে পড়ে। এভাবে বছর না পেরুতে অনেক পোশাক শিল্প মালিকের গাড়ীর মডেল পাল্টেছে। তাদের জীবন ধারনের মান পাল্টানোটা অসম্ভব দ্রুত গতিতে হলেও যাদের ঘামের বিনিময়ে এই পরিবর্তন সেই শ্রমিকদের জীবনের মান অসম্ভব ধীর গতিতেও একটুও বদলায়নি। উদ্যোক্তা হিসেবে আয়ের বড় অংশ তারা নেবেন তাতে কারো আপত্তি নেই। কিন্তু কারখানার সাথে যুক্ত সেই শ্রমিকরা যারা কিনা কারখানাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন, তাদেরকে বঞ্চিত করে কেন? শুধু পোশাক শিল্পেই নয়, আমাদের দেশে সব ক্ষেত্রেই ‘আয় বৈষম্যে বড়। এটা এমন এক পর্যায়ে যে, এটাকে ‘শ্রমের শোষন’ না বললে অন্যায় হবে।
অনেকেই পোশাক শিল্পে থেমে থেমে গোলযোগ নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে বলেছেন, আসলেই কি বেতন ভাতা বৃদ্ধিই শুধুমাত্র কারণ? ইতিমধ্যে আমাদের মানবাধিকার কমিশনের প্র্রধান এর পিছনে অন্য কারো ইন্ধন থাকার ইঙ্গিত দিয়েছেন। প্রধান বিরোধী দল স্পষ্ট করে বলেছে, প্রতিবেশী দেশের জড়িত থাকার কথা। ক’দিন পরপর বিভিন্ন কারণে আমাদের পোশাক শিল্প অঙ্গন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। সরকারের উচিৎ এর পিছনে থাকা সঠিক কারণগুলোকে চিহ্নিত করে তার স্থায়ী সমাধানের ব্যবস্থা করা। যদি শ্রমিকদের ন্যায্য কোন দাবি থাকে, সেগুলো অবশ্যই মেনে নিতে হবে। আর যদি এর পিছনে কথিত ষড়যন্ত্র থাকে তবে অবশ্যই তার মূলোৎপাটন করা দরকার। মনে রাখতে হবে, শ্রমিকদের শোষণ করে শ্রমিক অসন্তোষ জিইয়ে রেখে ষড়যন্ত্র ঠেকানো যাবে না। ষড়যন্ত্র করতে হলে তার একটা প্রেক্ষাপট লাগে। শ্রমিকদের শোষণের মাধ্যমে আমরা নিজেরাই সেই ষড়যন্ত্রের ক্ষেত্রটা তৈরি করে দিচ্ছি। এমনিতে শ্রমিক নেতা আমিনুলের মৃত্যুকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশের পোষাক শিল্প হুমকির সন্মুখীন। আবার এই নতুন অসন্তোষ আমাদের তৈরি পোশাক শিল্পকে আরো নাজুক পরিস্থিতির মধ্যে ঠেলে দেবে। আমাদের পোশাক শিল্পের ক্ষতি হলে শুধু মালিক কিংবা শ্রমিক ক্ষতিগ্রস্ত হবে না, পুরো জাতিকে এর নেতিবাচক ফল ভোগ করতে হবে।
কেউ কেউ বলছেন, একজন শ্রমিকের নিম্নতম মজুরি কতো হবে? কিসের ভিত্তিতে নির্ধারণ হবে সেটা? প্রশ্নগুলো খুবই যৌক্তিক। নিম্নতম মজুরি কতো হবে সেটা নির্ধারণ করা খুব কঠিন না। কিন্তু কঠিন হচ্ছে কিসের ভিত্তিতে হবে সেটা নির্ধারণ করা। বিতর্কের সেই সুযোগে বারবার বঞ্চিত হয় শ্রমিকদের দাবি। পৃথিবীর প্রত্যেকটা দেশে এর স্ট্যান্ডার্ড ভিন্ন। সেই দেশের অর্থনীতি এবং অন্যান্য বিষয়ে সরকারের নীতির উপরে ভিত্তি করে সেটা বিবেচিত হতে পারে। যেমন উন্নত বিশ্বে একজন শ্রমিকের নিম্নতম মজুরি যেটা নির্ধারিত হয়, একজন শ্রমিক যদি সপ্তাহে নিদেনপক্ষে চল্লিশ ঘন্টা কাজ করতে পারে তবে সেই নিম্নতম মজুরি পাওয়া শ্রমিকও বাড়ি এবং নতুন গাড়ি হাঁকাতে পারে। বাংলাদেশে ভাল চাকরি করা লোকেদের পক্ষেও যেটা সম্ভব হয় না। সেক্ষেত্রে একজন শ্রমিকের আয় দিয়ে সে বাংলাদেশে গাড়ি বাড়ি কিনবে সেটা নিশ্চয়ই ভাবা যায় না। অর্থনীতির এই জটিল মারপ্যাঁচ কিংবা পশ্চিমা অর্থনীতির ম্যাজিক বুঝা আমাদের মতো সাধারণ মানুষেদের পক্ষে সম্ভব নয়। যদিও সেখানে পৃথিবীর সব স্থানের মতোই আয় বৈষম্য আছে। কিন্তু কাজ করা কোন ব্যক্তিই ব্যতিক্রমী ঘটনা ছাড়া জীবনের প্রয়োজনীয় জিনিস উপভোগ করার সামর্থ্য রাখে। কাজেই আমরা আসলে শ্রমিকদের জীবনযাত্রার মান কোন অবস্থানে দেখতে চাই সেটার উপরে ভিত্তি করেই শ্রমিকদের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করতে হবে। মালিকপক্ষ উদ্যোক্তা হিসেবে যদি নিজেদেরকেই কারখানার একমাত্র মালিক ভেবে বসেন তাহলে মুনাফার সিংহভাগই তারা লুটে নেবার ধান্দায় থাকবে। মালিকপক্ষকে চিন্তার এই জায়গাটায় পরিবর্তন আনতে হবে। কারখানার প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত সকলেই কোন না কোনভাবে সেই কারখানার মালিক। কাজেই লভ্যাংশের ভাগ নির্ধারণে আকাশ পাতাল পার্থক্য থাকাটা খুবই অন্যায়।
কারখানা বাঁচাতে হলে শুধু মালিকপক্ষ বাঁচলে চলবে না। কারখানার প্রাণ শ্রমিকদেরও বাঁচাতে হবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্টদের মনে রাখতে হবে, কারখানার বাইরেও শ্রমিকদের জীবন আছে। মানুষের পুরো জীবন মানেই তার স্বাস্থ্য, বিনোদন, তার খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান। যে কটি টাকা ১০ থেকে ১২ ঘন্টা কঠোর শ্রমের পরে দেওয়া হয় সেটা দিয়ে কি সেই জীবন চলে?
অস্বীকার করার উপায় নাই, পোশাক শিল্পের উপরে দেশের অর্থনীতি অনেকাংশে নির্ভরশীল। তাই সঙ্গতকারণেই যখন এই শিল্প হুমকির মুখে পড়ে তখন সবাই বলেন, ‘দেশের অর্থনীতিকে বাঁচাতে’ এই গোলযোগ থামাতে হবে। ’ বক্তব্যের সাথে কারো কোন দ্বিমত নেই। দ্বিমত শুধু কথাটার প্রতিফলন কিভাবে ঘটছে সেটাকে নিয়ে। আমাদের সেই ‘দেশের অর্থনীতি’ কার জন্য? যে দরিদ্র শ্রমিক শুধুমাত্র বেঁচে থাকার ন্যূনতম সামর্থ্য অর্জনের জন্য কারখানায় মালিকের এবং রাজপথে পুলিশের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে আন্দোলন করে তারা কি দেশের বাইরে? বেঁচে থাকার যুদ্ধরত এই শ্রেণীর সংখ্যাই কিন্তু বেশী। ওদের বাঁচান। তাহলেই দেশ বাঁচবে।
[email protected]
বাংলাদেশ সময় ১০২৪ ঘণ্টা, জুন ২২, ২০১২
এমএমকে- [email protected]