ঢাকা, সোমবার, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৩ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

অবশেষে স্কুল পেল সীমা, এখন প্রয়োজন সীমা-বান্ধব সমাজ

সৈয়দ সাইফুল আলম শোভন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩৪ ঘণ্টা, জুলাই ৪, ২০১২
অবশেষে স্কুল পেল সীমা, এখন প্রয়োজন সীমা-বান্ধব সমাজ

গত ২২ মে বাংলানিউজ২৪.কম এ “বাবার ছুড়ে দেওয়া এসিডে জলসে যাওয়া শিশু” সীমার জন্য একটি স্কুলের দাবী নিয়ে লিখেছিলাম “সীমার স্বপ্ন বাঁচাতে একটা স্কুল চাই” শিরোনামে।

সংবাদটি প্রকাশ হওয়ার পর দুইদিনের মধ্যে আমার মেইল বক্সে শতাধিক ইমেইল এসে জমা হয়।

কত রকম মেইল, কারো ক্ষোভ কতৃপক্ষের প্রতি, কেউবা নিজ উদ্যোগেই স্কুল খুঁজেছেন। কারোবা চেষ্টা চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। কেউবা ভালবাসায় এক নজর সীমাকে দেখতে চান। এত এত মানুষের সাড়া পেয়ে সীমা কিংবা স্কুল নিয়ে হতাশ হওয়ার আর কোনো কারণই ছিল না। তারপর একে একে সময় টিভি, চ্যালেন আই, সমকাল, স্বাধীনমতসহ বেশকিছু প্রিন্ট ও ইলেক্সটনিক মিডিয়ায় এই সংবাদ গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ হয়।

ইতিমধ্যে ধানমন্ডি, ঝিগাতলা, মোহাম্মদপুর, রায়ের বাজারসহ সব মিলিয়ে সীমার জন্য আমরা খূঁজেছি প্রায় পঞ্চাশের অধিক স্কুল। পাশাপাশি ফেসবুকের বুন্ধুরাও নিজেদের এলাকার স্কুলে খোঁজ করেছেন। সীমার জন্য স্কুল খোঁজার তিন-চারজনের দলটা শতাধিক মানুষের দলে পরিণত হয়েছিল। এই দলের প্রতিটি মানুষের বিশ্বাস ছিল ‘আমরা পারব’। শেষ পযন্ত আমাদের বিশ্বাসের জয় হল।

আমার খুঁজে পেলাম সেই কাঙ্ক্ষিত স্কুল। স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা আমাদের জানালেন তিনি দায়িত্ব নিবেন। কোনো শিশুকেই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত করার অধিকার তার নেই জানিয়ে দিলেন। এই লড়াইয়ে তিনিও সমান অংশীদার হতে চান।

প্রবাসীবন্ধু এটম রহমানের আর্থিক সহযোগিতায় আমরা সীমা ও তার মা, ভাইয়ের
জন্য বাসা ঠিক করলাম। তিনজনের নতুন সংসার। আমরা দায়িত্ব ভাগ করে নিলাম। বিকেলে মানসিক শক্তি ফিরিয়ে আনার জন্য শিশু সীমাকে একেকদিন একেকজন সময় দিচ্ছেন। আর সীমাকে নিয়মিত পড়ানোর দায়িত্ব নিয়েছেন তুষার।

আজ সীমার স্কুলে প্রথম দিন।
 
ভোরে উঠেই তার প্রতীক্ষা কখন দশটা বাজে। সকাল থেকে সীমার বাসায় আজ ঈদ ঈদ আমেজ। গত রাতেই সীমার জন্য স্কুলের নতুন ড্রেস, ব্যাগ, খাতা, বই সবকিছু প্রস্তুত।

সীমার স্কুলে যাবে আমাদেরও প্রস্তুতির শেষ নেই। জাকির, সুমী, ওলি, কলি, তুষার সকাল সাড়ে ৮টায় জিগাতলা স্কুলে এসে জানাল সবকিছু প্রস্তুত। সকাল ১০টার আগে স্কুলের সামনে আমাদের ফেসবুকের বন্ধুরা অনেকেই এসে দাঁড়িয়ে আছে।   এসএম সৈকত নামের একবন্ধু সীমার স্কুলের প্রথমদিনে উপস্থিত থাকার জন্য মঙ্গলবার বিয়ে করে রাতেই ময়মনসিংহ থেকে ঢাকায় চলে আসল। কয়েকজন তাদের নিজেদের ক্লাস বাদ দিয়ে এসেছেন, অনেকে অফিস না করেই এসেছেন। প্রাত্যহিক ব্যস্ততাকে পাশ কাটিয়ে তারা এসেছেন শুধু সীমার জন্য। আমাদের সব বন্ধুর অপেক্ষার পালা শেষ করে এক সময়ে ঘড়িতে বাজে ১০টা।

আমাদের সবার উ‍ৎকন্ঠা: ক্লাসের অন্যান্য শিশু কিভাবে গ্রহণ করবে সীমাকে? ওরা কোনো অস্বাভাবিক আচরণ করবে না তো?  

স্কুলে গিয়েই আমাদের জন্য প্রথম দুঃসংবাদ প্রধান শিক্ষিকা আজ স্কুলে নেই; তিনি জরুরি প্রশাসনিক সভায় অংশ নিতে স্কুলের বাইরে আছেন। কিন্তু স্কুলের অন্য শিক্ষক-শিক্ষিকারা কত আন্তরিক, বন্ধুসুলভ হতে পারে তা জিগাতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে না গেলে বোঝা যাবে না।

সহকারি শিক্ষিকা এসে জানালেন যে আমরা সবাই প্রতিক্ষায় আছি কখন সীমা আসবে। সীমার ক্লাসের শিক্ষক জানালেন যে তারা সকল শিক্ষার্থীর সাথেই আলোচনা করে রেখেছেন। স্কুলের বন্ধুরা সীমাকে আন্তরিকতার সাথে গ্রহণ করলো।

আজ (বুধবার, ০৪ জুলাই, ২০১২) ‘ভর্তি যুদ্ধ’ শেষ হলো। শনিবার থেকে সীমার নিয়মিত স্কুলে যাওয়া শুরু হবে।

সীমাকে বাড়িতে দিয়ে এসে লিখতে বসেছি। এই কয়েক মাস স্কুল খোঁজা ছাড়াও বেশ কিছু অভিজ্ঞতা যোগ হয়েছে। সমাজে ভাল মানুষের সংখ্যা এখনও কম নয়। তেমনি সহযোগিতা কিংবা পরোপকার করার নেশা মানুষের এখনো নিঃশেষ হয়ে যায়নি। তার প্রমাণ আবারো পেলাম।

আমরা সবাই সীমাকে স্কুল থেকে বাড়ি দিয়ে অফিসে ফিরছি। আর ভাবছি শিশু সীমার জন্য স্কুল পেলাম। এইবার লড়াইটা আমাদের সমাজের ওই সকল মানুষের বিরুদ্ধে যারা সীমার বাবার অপরাধের দায় সীমার মত নিরপরাধ শিশুদের ওপর চাপিয়ে দেয়। এবং সীমাকে তারা অপরাধী বানিয়ে সমাজ থেকে বিছিন্ন করে।

এই সমাজে হাজারো সীমা আছে যারা অর্থিক অভাবসহ নানা অজুহাতে শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এই শহরে অসংখ্য শিশু শুধু জাত আর ধর্মের কারণে স্কুলের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। শুধু পিতার পরিচয় না থাকায় শিশুদের ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখা হয় পুরো ক্লাসে। এই সমাজে সীমার স্কুলে ভর্তি শুধুমাত্র সীমার অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই নয়। এটা সকল শিক্ষা বঞ্চিত শিশুর শিক্ষার অধিকার প্রতিষ্ঠার অন্যতম মাইল ফলক।

শুরু করেছিলাম সীমার জন্য একটি স্কুলের দাবি নিয়ে আর আজ শেষ করছি সীমা-বান্ধব একটা সমাজের দাবিতে।

ধন্যবাদ বাংলানিউজ২৪.কম। বাংলানিউজ-এ প্রকাশিত নিবন্ধ’র সূত্র ধরেই সীমার স্কুল খোঁজা দলটা ভারী হয়। এবং শেষমেষ আসে সাফল্য!

সৈয়দ সাইফুল আলম শোভন: পরিবেশ কর্মী
[email protected]

বাংলাদেশ সময় : ২১২৩ ঘণ্টা, ০৪ জুলাই, ২০১২
সম্পাদনা: আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।