ঢাকা, সোমবার, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৩ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

জাবির ভিসি নির্বাচন আশার কথা: কিন্তু কিছু প্রশ্ন

জাকারিয়া পলাশ, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫৪ ঘণ্টা, জুলাই ৬, ২০১২
জাবির ভিসি নির্বাচন আশার কথা: কিন্তু কিছু প্রশ্ন

কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির দায়িত্ব নিয়েছিলেন অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন। তার কাছে সকলের প্রত্যাশা ছিল আকাশচুম্বী।

শুরুও করেছেন দারুণ এক ঘোষণা দিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ৭৩’র আদেশ বাস্তবায়নের প্রত্যয় ব্যাক্ত করেছিলেন দৃঢ়কণ্ঠে সর্বত্র। তিনি বলেছিলেন, ৭৩’র আদেশ হলো মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম ফসল। অনন্য এক গণতান্ত্রিক অধ্যাদেশ। মুক্তবুদ্ধি চর্চার স্বপক্ষে পরিপূর্ণ স্বয়ত্বশাসনের মূলমন্ত্র। তার সে প্রত্যয় বাস্তবায়নের পথ যে কুসুমাস্তীর্ণ নয় তা সকলেরই জানা। তবুও আমরা আশাবাদী। কারণ তার জীবনে এটিই প্রথম চ্যালেঞ্জ নয়। তিনি স্বাধীকারের কথা উচ্চারণ করেছেন বহুবার বহু আধিপত্যের বিরুদ্ধে। সহজে তিনি হার মানার পাত্র নন, এটাই আমারা জানি। ঘোষণা বাস্তবায়নের জন্য সকলের সাথে আলোচনার পথ বেছে নিয়েছেন। শিক্ষকদের মান ভাঙানোর আশ্বাস দিয়ে অনুরোধ করেছেন ক্লাসে ফিরতে। গণিত, উদ্ভিদবিজ্ঞানসহ অচল বিভাগগুলো সচল হতে শুরু করলো। কিন্তু এতেই সমস্যার অবসান নয়। পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগে ক্লাস রুম সঙ্কটকে কেন্দ্র করে কর্মচারীদের উপর হামলা হলো। কর্মচারীরা নামল বিচারের দাবিতে। ছাত্ররা নামল ক্লাস সঙ্কট নিরসনের দাবিতে। শুরু হলো জটিলতা। নানা ভ্যাজালে আবারো জটিল হতে শুরু করলো রাজনীতির অন্দরমহল। সবচেয়ে বড় সমস্যা হয়ে দাড়ালো শিক্ষকদের গ্রুপিং। সরকারের সমর্থক আওয়ামী লীগের গ্রুপ আগে ছিল দুটি। বিভাজনের মাধ্যমে এখন হয়ে গেল তিনটি। বিএনপিতো বিরোধী দল। নতুন ইস্যুর অপেক্ষায় সদা-সন্ধানী তারা। এছাড়া আপোষহীন বামপন্থী শিক্ষকদের গ্রপও আছে বড় ভূমিকায়। বেশ কয়েকটি গ্রুপ একসাথে আগের ভিসির দূর্নীতির তদন্ত দাবি করছে। অপরদিকে নতুন শিক্ষকরা আন্দোলনরত রয়েছেন এক অধ্যাপকের বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের অভিযোগ এনে। শিক্ষক সমিতিও বিভাজিত। সভাপতি- সাধারণ সম্পাদক একসাথে, সহ-সভাপতির নেতৃত্বে বাকীরা আরেক পক্ষে। কেউ ভিসিকে সমর্থন দিলেন, কেউ বললেন দেখি কি করেন উনি! এত জটিলতার মাঝেও গত শনিবার ভিসি প্যানেল নির্বাচনের ঘোষণা দিলেন অধ্যাপক আনোয়ার। সে অনুসারে আগামী ২০ জুলাই (এ মাসেই) নির্বাচন হচ্ছে। এ ঘোষণা তার সহজাত সাহসী স্বভাবের বহিঃপ্রকাশ বলা যায়। যেখানে ঢাকাসহ প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অনির্বাচিত ভিসিদের দোর্দ- প্রতাপে গণতন্ত্র অবরুদ্ধ সেখানে তার এ ঘোষণা যথেষ্ট প্রশংসনীয়। কিন্তু এই ঘোষণার মাঝে কোন শুভঙ্করের ফাঁকি আছে কিনা তাই ভাবনার বিষয়। কয়েকটি কারণে এই আশঙ্কা প্রকাশ করছি। আশঙ্কার কথা বলার আগে জেনে নেওয়া প্রয়োজন ভিসি প্যানেল নির্বাচন কিভাবে হয়।
৭৩’র আদেশের ১১(১) ধারা অনুসারে সিনেট সদস্যদের ভোটে নির্বাচিত হন তিন জনের ভিসি প্যানেল। এই প্যানেলের মধ্য থেকে যেকোন একজনকে চার বছরের জন্য নিয়োগ দেবেন রাষ্ট্রপতি। সিনেট সদস্য কারা সেটিই এখন জানার বিষয়। ৭৩’র আদেশের ১৯ নম্বর ধারায় মোট ১১ টি ক্যাটাগরীর সিনেট সদস্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মাঝে ভিসি, প্রো-ভিসিবৃন্দ, কোষাধ্যক্ষ এবং ঢাকা উচ্চমাধ্যমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষাবোর্ডের চেয়ারম্যান পদাধিকার বলে সিনেটের সদস্য হবেন। সরকার মনোনীত ৫জন সরকারি কর্মকর্তা, জাতীয় সংসদের স্পিকার মনোনীত পাঁচজন সংসদ সদস্য, রাষ্ট্রপতি মনোনীত পাঁচজন বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, সিন্ডিকেট কতৃক মনোনীত পাঁচজন গবেষক, শিক্ষাপর্ষদের ভোটে নির্বাচিত পাঁচজন কলেজ অধ্যক্ষ, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাশ করা নিবন্ধিত গ্রাজুয়েটদের ভোটে নির্বাচিত ২৫জন গ্রাজুয়েট এবং শিক্ষকদের মধ্যথেকে নির্বাচিত ৩৩ জন শিক্ষক তিনবছরের জন্য সিনেটের সদস্য হবেন। এছাড়া জাকসু থেকে নির্বাচিত ৫ শিক্ষার্থী একবছরের জন্য সিনেট সদস্য হবেন। সেই হিসাবে বর্তমানে সিনেটে সদস্য হওয়ার কথা ৯১ জন। এ ৯১টি ভোটের হিসাব নিয়েই আমার কথা।
প্রথমত, ৭৩’র আদেশ অনুযায়ী ছাত্রদের পাঁচজন নির্বাচিত প্রতিনিধির অংশগ্রহণ করার কথা। কিন্তু ছাত্রসংসদ নির্বাচন হিমাগারে রক্ষিত রয়েছে দু’দশক ধরে। তাই সিনেটের অধিবেশন ছাত্রদের উপস্থিতি ছাড়াই হয়ে আসছে বিগত বছরগুলোতে। ভিসি নির্বাচনের আগে ছাত্রসংসদ নির্বাচন না হলে ছাত্রদের অংশগ্রহণ ছাড়াই নির্বাচিত হবেন ভিসি। প্রশ্ন হল ৭৩’র আদেশ বাস্তবায়নের জন্য তাহলে কোনটি আগে হওয়া উচিত- ছাত্রসংসদ নাকি ভিসি প্যানেল?
দ্বিতীয়ত, ৯১টি ভোটের মধ্যে জাকসু’র পাঁচ ভোট বাদ দিলে থাকে ৮৬ জন ভোটার। এর মাঝে ২৫ জন রেজিস্ট্রার্ড গ্রাজুয়েটের মেয়াদ শেষ হয়েছে ২০০১ সালে। ১৯৯৮ সালে সর্বশেষ নির্বাচন হয়েছিল এই পদগুলোতে। এছাড়া বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ক্যাটাগরি, গবেষক ক্যাটাগরি এবং অধ্যক্ষ ক্যাটাগরির ১৫ জনেরও সদস্য পদের মেয়াদ শেষ। সে হিসাবে আরও ২৫+১৫=৪০ জন ভোটারের ভোটদানের যোগ্যতা নেই। তাহলে বৈধ ভোটার থাকেন ৪৬ জন। ৯১ ভোটের বদলে ৪৬ ভোটেই নির্বাচন হবে নাকি ওই সব মেয়াদোত্তীর্ণ ভোটাররাও ভোট দিবেন সেটা প্রশ্নের বিষয়। সেক্ষেত্রে শিক্ষকদের মধ্যে আওয়ামী পন্থী দু’টি গ্রুপ, বিএনপি এবং বামপন্থীরা একযোগে ভিসি প্যানেল নির্বাচনের বিরোধীতার যে কারণ দেখিয়েছে তা যৌক্তিক মনে হয়। এসব মেয়াদোত্তীর্ণ পদে নতুন মনোনয়নের ব্যবস্থা করাই এখন প্রধান কাজ হওয়া উচিত গণতন্ত্রকামী অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের।
তৃতীয়ত, সিনেটরদের মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে এ বিষয়টি প্রশাসনের জানা ছিলনা এমনটি হতে পারে না। তাহলে ভিসি মহোদয় স্থগিত হয়ে থাকা ডীন নির্বাচনসহ এসব মেয়াদোত্তীর্ণ নির্বাচন রেখে হঠাৎ করে ভিসি প্যানেল নির্বাচনের ঘোষণা কেন দিলেন সে প্রশ্নও গুরুত্বপূর্ণ। তাহলে কি বিশ্ববিদ্যালয়টি আবারো নতুন কোন কৌশলী অপরাজনীতির নীল-নকশার কবলে পড়তে যাচ্ছে? ভোটারদের মাঝে শিক্ষক প্রতিনিধি রয়েছেন ৩৩ জন। এদের অধিকাংশই সাবেক ভিসি অধ্যাপক শরীফ এনামুল কবিরের সময়ে সিনেট সদস্য হিসাবে নির্বাচিত হয়েছেন। তাহলে কি এই সিনেট সদস্যদের ভোটের উপর ভর করে অধ্যাপক শরীফ এবার নির্বাচিত ভিসি হওয়ার পথ তৈরি করছেন? অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন কি তার সে পথের দিকপালের ভূমিকায় রয়েছেন? অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের ব্যক্তিত্বের সামনে এমন প্রশ্ন তুলতে আমরা চাই না।
চতুর্থত, যদি এমন পথে অধ্যাপক শরীফ আবার ভিসি প্যানেলে নির্বাচিত হন তাহলে কি রাষ্ট্রপতি তাকে নিয়োগ দেবেন? বাধ্য হয়ে পদত্যাগের পর মাত্র দু’মাসের মধ্যে সকলের কাছে তার তেমন গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে কি? এটা বিশ্বাস করা যায় না। তাহলে কি অধ্যাপক শরীফের সমর্থনে অধ্যাপক আনোয়ার নিজেই নির্বাচিত ভিসি হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। অনির্বাচিত ভিসির তকমা মুছতে চাইছেন? ভাল কথা। সেজন্য আনুসাঙ্গিক গণতান্ত্রিক ধাপগুলো ক্রমান্বয়ে শুরু করা কি যৌক্তিক ছিল না?
পঞ্চমত, বাংলাদেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিপ্রেক্ষিতে এখনই ভিসি নির্বাচন আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য লাভজনক কি না সেটিও আলোচনার বিষয়। এই সরকার সবকটি বিশ্ববিদ্যালয় অনির্বাচিত ভিসিদের দিয়ে চালিয়ে আসছে। অধ্যাদেশ লঙ্ঘন হচ্ছে, তবে সরকারের এজে-া বাস্তবায়ন তো হচ্ছে। এমতাবস্থায় সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি নির্বাচনের পরিবেশ কি রয়েছে? যদি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিসি প্যানেল নির্বাচন হয় তাহলে অন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতেও নির্বাচনের দাবি উঠতে পারে। সে দাবি পুরণের জন্য সরকার প্রস্তুত কি? তাহলে অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে নির্বাচনের দাবির পরও কেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন হলো না?
এত প্রশ্নের মাঝেও এখানে আশার দিক রয়েছে। তা হলো অধ্যাপক আনোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে যদি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ভিসি প্যানেল নির্বাচন করতে পারে তাহলে তা হবে সবগুলো বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য একটি বড় উদাহরণ। কিন্তু তা সর্বজনগ্রাহ্য করতে প্রয়োজন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতা। অর্থাৎ সবার আগে বৈধ ছাত্র সংগঠনগুলোর সহাবস্থানের মাধ্যমে ছাত্রসংসদ নির্বাচন, ডিন নির্বাচন, সিনেটের বিভিন্ন ক্যাটেগরির নির্বাচনের পরেই কেবল ভিসি প্যানেল নির্বাচন হওয়া উচিৎ।

জাকারিয়া পলাশ/ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, সাংবাদিক
[email protected]
বাংলাদেশ সময় ১৪৪৬ ঘণ্টা, জুলাই ০৬, ২০১২
সম্পাদনা: মাহমুদ মেনন, হেড অব নিউজ- [email protected]

 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।