২০১১ সালে সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ লাভের সুযোগ ঘটে আমার। মনে হল, যাক আর কিছু না হোক, সম্মানটা পাবো।
যারা পরিদর্শনে স্কুলের ক্লাসে যান, প্রশিক্ষণের জন্য পাঠদান করান কিংবা বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ, যারা স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদের সামনে বক্তৃতা দেন তাদের উদ্দেশ্যে বলছি- দয়া করে নিয়মিত একটি মাস দেশের যে কোনো মাধ্যমিক স্কুলের যে কোনো শ্রেণীতে পাঠদান করে তবেই শিক্ষকদের দায়িত্ব সম্পর্কে মন্তব্য করুন।
আপনি শিক্ষক, ক্লাসে পড়াবেন, দেখবেন ৬০ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে ২০ জন বই আনেনি। তাদেরকে বই আনার গুরুত্ব বুঝিয়ে আপনি পড়াতে শুরু করবেন। ১৫ জন শিক্ষার্থী পাবেন যারা গল্প করছে বা খাতায় খেলা করছে। আপনি এই শ্রেণীভুক্ত ছাত্রদেরকে কোনো শাস্তি দিতে পারবেন না। তাদেরকেও ক্লাসে মন দেওয়ার গুরুত্ব বিষয়ে ভালভাবে বোঝানোর চেষ্টা করবেন। এর মধ্যে কিছু শিক্ষার্থী আপনার বক্তব্য শুনে শান্ত হয়ে ক্লাসে মনোযোগী হবে। আর কিছু শিক্ষার্থী তাদের এই অভ্যাস পরিত্যাগে ব্যর্থ হবে।
এখানে জ্ঞাতব্য, কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী আপনার পাঠদানে ও মনোযোগী সহপাঠীদের বিরক্ত করছে। কিন্তু তাকে সামান্যতম শাস্তি এমনকি তার মনে কোনো আঘাত লাগে এমন কোনো উক্তিও আপনি করতে পারবেন না।
ক`দিন ধরে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখতে পাবেন। নিরুপায় হয়ে প্রধান শিক্ষকের মাধ্যমে অভিভাবকদের ডেকে পাঠাবেন। অভিভাবকরা বিভিন্ন ব্যস্ততার মাঝে এত ক্ষুদ্র কারণে ডেকে পাঠানোতে বিরক্ত প্রকাশ করবেন। এবং আপনি ক্লাস নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা রাখেন না সেই বিষয়ে বিশেষ মতামত (!) প্রকাশ করবেন।
আপনার ক্লাসে মনোযোগী শিক্ষার্থীদের স্বার্থে এবং শিক্ষকদের প্রতি অসদাচরণ ও শৃঙ্খলা রক্ষার্থে কয়েকজনকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নিয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। দুই থেকে তিন দিনের মধ্যে সম্মানিত জেলা প্রশাসক বা স্থানীয় সংসদ সদস্যের সুপারিশে ছাত্রটি আবার আপনার ক্লাসে উপস্থিত হবে। এবং সারা স্কুলে সে উচ্চৈ:স্বরে এটাই প্রচার ও প্রতিষ্ঠা করবে যে,``............. (উচ্চারণ অযোগ্য) শিক্ষকদের কোনো ক্ষমতাই নেই। ``
না, এখন আমি কোনো সম্মান বোধ করি না এ পেশায় এসে। এই কষ্ট, বেদনা শুধু ভুক্তভোগী শিক্ষকই বুঝবেন। যে ছাত্র তার শিক্ষককে সম্মান দেয় না, গুরুত্বহীন ব্যক্তি মনে করে, সে কি স্বার্থক মানুষ হতে পারবে? সুধীমহলের কাছে শুধু এটুকুই জানতে চাই, আপনাদের জীবন গঠনে কি কোনো শিক্ষকের শাসনের ভূমিকা ছিল না? তাই বলে আমি বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত শিক্ষক কর্তৃক শিক্ষার্থীকে অমানুষিক শারিরীক নির্যাতনের ব্যাপারটি সমর্থন করছি, দয়া করে এমনটা মনে করবেন না।
এবার একটু ভিন্ন বিষয়ে বলি। আমাদের মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী তার দায়িত্বের প্রতি অনেক আন্তরিক। যে সকল শিক্ষক ছাত্রদেরকে টিউশনিতে বাধ্য করে, তাদের জন্য উপযুক্ত কিছু করতে চেয়েছিলেন। পরিণামে আইন হল, নিজ স্কুলের ছাত্রদের পড়ানো যাবে না।
এই আইনটির প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে বলছি, খুবই সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত। আশা করি এ দ্বারা আমাদের অভিভাবক ও শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে। কিন্তু মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী, মাত্র আট হাজার টাকা স্কেল পাওয়া (সর্বসাকুল্যে নগদ ১২ হাজার তিনশ’ টাকা) একজন শিক্ষক তার পরিবার নিয়ে উর্দ্ধগতির বাজারমূল্যের এদেশে কিভাবে জীবন-যাপন করবেন তা ভেবে দেখেছেন কি? আনন্দে কেউ টিউশনি করে না, একান্ত প্রয়োজনেই এই পরিশ্রমের বাড়তি চাপ শিক্ষকেরা নিয়ে থাকেন।
আর সাংবাদিক ভাইদের বলবো, প্রতিদিন হাজার হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা বিভিন্নভাবে শিক্ষার্থীদের দ্বারা লাঞ্ছিত হচ্ছেন। দয়া করে সে বিষয়েও কি আপনারা আপনাদের সুনজর (!) দেবেন? শিক্ষার্থী মাত্রই নিষ্পাপ ফুল, আর শিক্ষক মাত্রই ফাঁকিবাজ, অত্যাচারী কথাটা সকল ক্ষেত্রে ঠিক না-ও হতে পারে।
আমার এ লেখা কোনো মহলের প্রতি ক্ষোভের বিষোদগার নয়। যদি কারো মনে এতটুকু কষ্ট দিয়ে থাকি তাহলে আমি ক্ষমাপ্রার্থী। তবে পাঠকদের উদ্দেশ্যে শুধু এটুকুই বলবো, শিক্ষার্থীদের পক্ষে যেমন আইন করা হয়েছে, ঠিক তেমনি তাদের অসদাচরণের জন্য এমন কোনো আইন করা কি উচিত নয় যেখানে সমাজের সকলের সমর্থন থাকবে ?
বাংলাদেশ সময় ১১২১ ঘণ্টা, জুলাই ০৭, ২০১২
সম্পাদনা:জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর [email protected]