আশার কথা, বিশ্বব্যাংক নিয়ে দেশে ও বিদেশে বেশ জোরেশোরে কিছু প্রশ্ন উঠেছে। আমরা যারা দীর্ঘদিন ধরে দেশে-বিদেশে বিশ্বব্যাংকের উন্নয়ন নীতির সমালোচনা করে আসছিলাম তাদের জন্য এটা সুখবর।
বাংলাদেশে বিশ্বব্যাংকের উপস্থিতির শুরু থেকেই খুব একটা হালে পানি পায়নি। জানা যায়, তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রথমে বিশ্বব্যাংককে দাতাদের বৈঠকে প্রবেশের অনুমতি না দেননি; পরে অবশ্য পেছনে বসার অনুমতি দিয়েছিলেন। কিন্তু পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাংক পেছনের সারি থেকে একেবারে সামনের সারিতে চলে আসে, দেশের নীতি পর্যায়ে, উন্নয়ন কার্যক্রমে, এমনকি রাজনীতি ও অভ্যন্তরীণ বিষয়েও হস্তক্ষেপ করতে থাকে। তাদের আসন পাকাপোক্ত করে নেয়। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের উন্নয়ন নীতি ও কর্মকাণ্ড নিয়ে বরাবর জনগণের পক্ষ থেকে সমালোচনা থাকলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল তা বিবেচনায় নেননি। কিন্তু একথাও হয়তো একদম ঠিক না। কারণ বিশ্বব্যাংক যখন দায়মুক্তি (‘ইম্যুনিটি’) দাবি করেছিল আমরা সম্মিলিতভাবে তা প্রতিরোধ করেছিলাম। দেশের শত শত সংগঠনের পক্ষ থেকে সম্মিলিত উদ্যোগের ফলে সরকারকে শেষ পর্যন্ত আমরা বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলাম যে, বিশ্বব্যাংককে দায়মুক্তি (ইম্যুনিটি) দিলে তা রাষ্ট্রের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের বিপক্ষে যাবে; একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে কোনোমতেই আইনের ঊর্ধ্বে রাখা ঠিক না। অনেক দেনদরবার, টানাপোড়েন শেষে শেষপর্যন্ত জনগণের চাপ ও দাবির কাছে বিশ্ববাংকের ‘মামাবাড়ির আবদার’ ভেস্তে যায়।
একইভাবে বিশ্বব্যাংক, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের উন্নয়ন প্রেসক্রিপশন ‘পিআরএসপি’ বা ‘দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র’ নিয়েও সারাদেশে নাগরিক সংগঠনগুলো সম্মিলিতভাবে সমালোচনা করেছিল। নাগরিক সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা সুষ্পষ্ট জানিয়েছিলাম, বিশ্বব্যাংক গংদের পিআরএসপি নীতি এদেশে দারিদ্র্য কমাবে না, বরং তা আরও বাড়িয়ে দিতে পারে। প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং সরকারের একটি অংশ অনুধাবন করেছিল যে, বিশ্বব্যাংকের চাপিয়ে দেওয়া একতরফা উন্নয়ন নীতি কখনোই জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চাহিদার প্রতিফলন ঘটায় না, এবং এই কথিত উন্নয়ন নীতি দারিদ্র্য নিরসনে আদৌ কার্যকর কোনো ভূমিকা রাখবে না। বরং বাণিজ্য উদারিকরণের নামে সেবাখাতসমূহ ( যেমন : শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানি সেবা ইত্যাদি) বেসরকারিকরণের মাধ্যমে কথিত ধনী ও উন্নত দেশগুলেরার বাজারেরে একচেটিয়া প্রসার ঘটবে; দেশের ক্ষুদ্র ও মাঝারি পুঁজির প্রতিষ্ঠানসহ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে অকার্যকর করে ক্রমশ ধ্বংস করা হবে, যা জনগণের জীবন ও জীবিকাকে সংকটের মুখ ফেলবে। এবং অনেক ক্ষেত্রে ঘটেছেও তাই। দেশের সর্ববৃহৎ কারখানা আদমজিসহ বিভিন্ন পাটকল বন্ধ করে দেওয়ার পেছনে বিশ্বব্যাংকের ভূমিকার কথা আমরা জানি, যা সরাসরি এদেশের হাজার হাজার মেহনতি শ্রমিক, নারী ও শিশু তথা জনগণের জীবন জীবিকাকে সংকটের মুখে ফেলে দেয়।
আমরা আরো জানি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসমূহের মূল্যবৃদ্ধি, তেল, গ্যাস, বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে বিশ্বব্যাংকের ভূমিকার কথা। নাগরিক সমাজ ও জনগণের পক্ষ থেকে বিশ্বব্যাংকের চাপিয়ে দেওয়া সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদ জানানো হয়েছে, সরকারের কাছে দাবি জানানো হয়েছে, কিন্তু প্রায়শ সরকার জনগণের দাবি উপেক্ষা করে বিশ্বব্যাংকের কাছে নতি স্বীকার করেছে, যা সম্পূর্ণভাবে এদেশের সাধারণ মানুষের উন্নতির বিপক্ষে। কিন্তু, সরকার দেরিতে হলেও পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার দিকে মনোযোগ দিয়েছে; এটাও আশার কথা।
সম্প্রতি, পদ্মাসেতুর ঋণচুক্তি বাতিল নিয়ে সরকার ও বিশ্বব্যাংকের মধ্যে যে টানাপোড়েন তৈরি হয়েছে এটাও আশার কথা। কেননা, এদেশের গণমাধ্যমগুলোর সক্রিয় ভূমিকার কারণে সারা দেশের আপামর জনগণ জেনেছেন বিশ্বব্যাংক কি ‘জিনিস’। সরকারের দুর্বলতা, আমলা-রাজনীতিকদের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ ইত্যাদি বিষয়ে জনগণ জানতে পেরেছেন। আমরা যারা দীর্ঘদিন বিশ্বব্যাংকের নীতি পর্যালোচনা করছি, এর প্রকল্পগুলো পর্যবেক্ষণ করছি ও জনগণের কাছে সমালোচনা হাজির করছি, তাদের জন্য উল্লেখযোগ্য ঘটনা এটি। এ ঘটনা দুনিয়াব্যাপী অগণতান্ত্রিক বিশ্বব্যাংকের অন্যায্য নীতিবিরোধী আন্দোলন ও প্রয়াসকে আরো বেগবান করবে, সন্দেহ নেই। কিন্তু পদ্মাসেতু সংক্রান্ত দুর্নীতির অভিযোগ, সরকার ও বিশ্বব্যাংকের অবস্থান, ঋণচুক্তি বাতিল ও পেছনের রাজনীতির আরো বিশ্লেষণ প্রয়োজন।
বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিলের সিদ্ধান্ত নিয়ে যারা নাকি-কান্না করছেন আমি তাদের পক্ষে নই। এখানে নাকি-কান্নার কিছু নেই, কারণ বিশ্বব্যাংক তাদের স্বার্থের বিরুদ্ধে কখনো এক পা বাড়ায় নি। বিশ্বব্যাংক একটি ঋণদানকারী আর্থিক প্রতিষ্ঠান, এটা কোনো আঞ্জুমানে মফিদুল ইসলাম নয়, এ বিষয়টি জনগণের কাছে পরিষ্কার হওয়া দরকার। স্বাধীনতা-পরবর্তী সময় থেকে বিশ্বব্যাংক আমাদের যে পরিমাণ ঋণ দিয়েছে তা বিশ বিলিয়ন ডলারের কিছু বেশি। আহামরি কিছু নয়। বরং অনেক ক্ষেত্রে সেসব ঋণ ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। উন্নয়নের নামে জনগণের চোখের সামনে হয়েছে ধ্বংসযজ্ঞ। এদেশে পরিবেশ-প্রতিবেশ-প্রাণবৈচিত্র্য ধ্বংসের পেছনে বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পগুলো কম দায়ী নয়। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে লক্ষ্যণীয়, বিশ্বব্যাংকের উন্নয়ন নীতি ও প্রকল্পের ভূমিকা নিয়ে টকশোর আলোচকরা, সাবেক আমলা-মন্ত্রীরা, বর্তমান রাজনীতিকরা, কথিত অর্থনীতিবিদরা এমনকি নাগরিক সংগঠনের কর্তাব্যক্তিরা জোরেশোরে কোনো প্রশ্ন তুলছেন না। এই ঘটনাটি স্বাধীন ও স্বনির্ভর অর্থনৈতিক ভিত গড়ে তুলতে আলোচনা করে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের পক্ষে আমাদের জন্য একটা বড় সুযোগ এনে দিয়েছে। সুযোগ এনেছে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা, শাসন ব্যবস্থার বিভিন্ন দিক পর্যালোচনা করে নিজেদের দুর্বলতাকে শনাক্ত করে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণের। ফলে রাজনৈতিকভাবে গুণগত রূপান্তরের পক্ষে, সমাজ ও দেশ গঠনের পক্ষে এ জাতীয় ঘটনা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখতে পারে।
অন্যদিকে আমাদের বিবেচনায় নেওয়া দরকার যে, বিশ্বব্যাংক যেসব অভিযোগে পদ্মাসেতু সংক্রান্ত ঋণচুক্তি বাতিল করেছে সেসব অভিযোগ ঢাহা মিথ্যা নয়। কারণ মিথ্যা নয় বলেই সরকার কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এদেশে দুর্নীতি আছে, দুর্নীতি হয় এটা তো মিথ্যা কথা নয়। পদ্মাসেতুর জন্য বিশ্বব্যাংকের যে ১২০ কোটি ডলার দেওয়ার কথা তার চেয়েও বেশি পরিমাণ অর্থের দুর্নীতি প্রতিবছর হয় এদেশে। দুর্নীতির অভিযোগের যদিও চূড়ান্ত ফয়সালা হয়নি, তবু এটা অনুমানযোগ্য যে, পদ্মাসেতু নিয়ে দুর্নীতির অভিযোগটি আমলে নেয়ার মতো। সরকার প্রথম দিকে এটি আমলে না নিলেও পরবর্তী সময়ে লক্ষ করা যায়, সেটি আমলে নিয়ে কিছু প্রতিকার করার চেষ্টা করেছেন। আমরা শাসনব্যবস্থার স্বচ্ছতার জন্য নিশ্চয়ই আশা করি যে, সরকার জনগণের সামনে বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে সকল দেনদরবারের নথিপত্র, চুক্তিপত্র ইত্যাদি স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও দায়বদ্ধতার স্বার্থে জনগণের সামনে তুলে ধরবে। বিশ্বব্যাংকেরও উচিত সকল দলিল দস্তাবেজ জনগণের সামনে হাজির করা। একটি আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিশ্বব্যাংক এদেশের সরকার ও জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। এক্ষেত্রে, বিশ্বব্যাংকের কোন কোন কর্মকতা এই প্রকল্পের সাথে জড়িত ছিলেন, তাদের ভূমিকা কী ছিল, সেসব বিষয়ে সরকার ও বিশ্বব্যাংকের পক্ষ থেকে কোনো প্রশ্ন তোলা হচ্ছে না। এ বিষয়টি অধিক গুরুত্বপূর্ণ যা জনগণের সামনে পরিষ্কার করা অতি দরকারি। মনে রাখা আবশ্যক, এদেশের কোটি কোটি সাধারণ মানুষ যেমন দুর্নীতি করেন না, তেমনি দুর্নীতিবাজ আমলা, রাজনীতিক ও সরকারকেও তারা সমর্থন করেন না। এদেশের রাজনীতির ইতিহাস বারবার তাই প্রমাণ করেছে।
আমাদের মনোযোগ দেয়া উচিত স্বাধীন জাতীয় অর্থনীতির নীতিমালা প্রণয়নে। আর এ কারণেই ভেবে দেখা দরকার, পদ্মা ব্রিজ নিজস্ব অর্থায়নে কীভাবে নির্মাণ করা যায়। সরকার ও সংশ্লিষ্টদের প্রতিক্রিয়া ও আলোচনা থেকে মনে হয়, বিশ্বব্যাংক না থাকলে যেন এদেশ ভেসে যাবে। আদৌ তা নয়। বিশ্বব্যাংক বছরে ১.২ বিলিয়ন ডলার ঋণ দেয়, আর আমাদের প্রবাসী-আয় বৈধ উপায়েই ১২ বিলিয়ন ডলারের চেয়েও বেশি। এদেশে এমন শিল্পপতি আছেন যারা পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের মাধ্যমে পদ্মাসেতু নির্মাণ করতে পারেন বিদেশি ঋণ ছাড়া। সহযোগিতা নেওয়া যেতে পারে প্রবাসী বাংলাদেশীদের সংগঠিত করে। কেননা বিদেশি ঋণ এদেশকে অনেকাংশে দুর্নীতিগ্রস্ত করেছে, সমাজের একটি অংশকে দালালে রূপান্তর করেছে। মুক্তবাজার অর্থনীতির নামে বেসরকারিকরণের মাধ্যমে রমরমা করেছে কর্পোরেট ব্যবসা। ধনী-গরিবের আয় ব্যবধান ও বৈষম্যের মাত্রা ক্রমাগত বেড়েই চলছে। বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির বাস্তবায়ন হার লক্ষ করলেই তা সহজে পরিষ্কার হয়।
ঋণসাহায্যের কার্যকারিতা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আর্ন্তজাতিকভাবে কাজের অভিজ্ঞতা থেকে এটা স্পষ্ট যে, ঋণ সম্পূর্ণ রাজনৈতিক বিষয়। এর কার্যকারিতা নিয়ে ‘প্যারিস ঘোষণা‘ (২০০৫), ‘আক্রা কর্মপরিকল্পনা‘ (২০০৮) কার্যকর ভূমিকা রাখতে ব্যর্থ হয়েছে। দাতাদেশগুলো যেমন তাদের দেয়া প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে নি, তেমনি গ্রহীতা দেশগুলোও প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে পারে নি আশানুরূপভাবে। আর সর্বশেষ ২০১১ সালে নভেম্বরে কোরিয়ায় অনুষ্টিত মন্ত্রী পর্যায়ের চতুর্থ উচ্চ পর্যায়ের বেঠকের ফল হিসেবে ‘বুশান পার্টনারশিপ ফর ইফেক্টিভ ডেভেলপমেন্ট কোঅপারেশন’ কতটুকু ভূমিকা রাখবে তা প্রশ্নের সম্মুখীন। ফলে যারা বলছেন বিশ্বব্যাংকের সিদ্ধান্তের কারণে অন্যান্য দাতাগোষ্টি বিষয়টিকে গুরুত্ব সহকারে নিয়ে তারাও সহযোগিতার পথ বন্ধ করে দেবেন, তা ভুল। কারণ একটি আন্তর্জাতিক কাঠামোর মধ্যে বহুপাক্ষিক আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও দাতা সংস্থা কাজ করে এবং তারা প্রতিশ্রুতির কাছে দায়বদ্ধ। যেমন ‘সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ’ যা ২০১৫ সালের মধ্যে বাস্তবায়ন করার কথা, সেটির জন্য দাতা ও গ্রহীতা দেশগুলো দায়বদ্ধ। ধনী দেশগুলেরার দায়বদ্ধতা রয়েছে তাদের জাতীয় আয়ের ০.৭ শতাংশ গরিব দেশগুলোর উন্নয়নে ব্যয় করার। এছাড়া ব্যবসাবাণিজ্যসহ অন্যান্য দ্বিপাক্ষিক ও বহুপাক্ষিক চুক্তি ও সহযোগিতার বিষয় রয়েছে। ফলে দাতাগোষ্টি তাদের নিজেদের স্বার্থেই ঋণসাহায্যের ব্যবসা টিকিয়ে রাখবে। যদিও ইউরোপ-আমেরিকার মন্দা এরই মধ্যে কিছু প্রভাব ফেলছে এবং তারা বেসরকারি খাতকে সামনে এনে তাদের ভূমিকা ও প্রতিশ্রুতিকে পাশ কাটাতে চাচ্ছে। কিন্তু স্বাধীনতার পার দশক পরে এ প্রশ্ন তোলা আমাদের অত্যন্ত জরুরি যে, আমরা আর কতদিন দাতাদের ঋণের পেছনে ছুটব। এ ঋণ কার জন্য, এদেশের জনগণের উন্নতির জন্য, না একটি মুষ্টিমেয় অংশের স্বার্থের জন্য? ঋণ নেয়ার অর্থ যদি হয় ঋণের ফাঁদে আটকে যাওয়া, যেমনটি এদেশে লক্ষ লক্ষ গরিব মানুষ ক্ষুদ্র ঋণ সংস্থাগুলোর ব্যবসার ফাঁদে আটকে গেছে, তা হবে দুর্ভাগ্যজনক।
বিশ্বব্যাংক যে একটি অগণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান, অন্যায্য ও দুর্নীতিগ্রস্ত প্রতিষ্ঠান তা ২০০৬ সালে প্রকাশিত ‘ঋণসাহায্যের শর্ত ও রাজনীতি: বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর বৈধতার সংকট’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছিলাম। আজ ফোর্বস এ কথা বলছে। আমাদের কাছে এটি তাই গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। আমরা মনে করি, সরকারের উচিত পদ্মাসেতু সংক্রান্ত বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ আমলে নিয়ে বিচার বিভাগীয় স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন করে তা জনগণের সামনে তুলে ধরা; দোষী সাব্যস্তদের উপযুক্ত শাস্তি প্রদান করে সরকারের ভূমিকাকে সমুন্নত করা। কিন্তু বিশ্বব্যাংকের কাছে পুনরায় পদ্মাসেতুর চুক্তিকে কার্যকর করার যে কোনো উদ্যোগ হবে বিনাশী পদক্ষেপ। বরং সরকার বিশ্বব্যাংকসহ দাতাগোষ্ঠির সঙ্গে তার অবস্থানকে আরো স্পষ্ট ও শক্ত করতে পারে, বিশেষ করে, ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দাতাদের সাথে আলোচনাসহ ‘সাউথ-সাউথ কোঅপারেশনের পথকে প্রসারিত করতে পারে। সরকারের উচিত সুশাসন নিশ্চিত করা, জনগণের কাছে অধিক দায়বদ্ধ থাকা, এবং বিশ্বব্যাংক-এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের চাপিয়ে দেওয়া নীতিশর্তের বিরুদ্ধে শক্ত রাজনৈতিক অবস্থান নেওয়া। এ সুযোগ হারানোর অর্থ হবে এদেশের মানুষের শৌর্যবীর্য সাহসী ও স্বাধীনচেতা রাজনৈতিক মনোভঙ্গি ও আশাআকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে দাঁড়ানো।
দুর্বলের ওপর সবলের আক্রমণ নতুন নয়। বিশ্বব্যাংক এদেশে তাদের অবস্থান এমন প্রবলভাবে হাজির করেছে যে তারা ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণ প্রায়শ করে। এর কারণ সরকারের দুর্বল অবস্থান ও নতজানু নীতি। যারা বলছেন বিশ্বব্যাংকের এই আচরণ অপ্রত্যাশিত আমি তাদের সঙ্গে একমত নই। কেউ কেউ বলছেন বিশ্বব্যাংকের বক্তব্য অপমানজনক; আমি মনে করি সময় এসেছে নিজেদের উপযুক্তভাবে গড়ে তুলে অপমানের জবাব দেওয়া। না হয় অরণ্যে রোদন ফল বয়ে আনবে না। ফলে কীভাবে নিজেদের অবস্থান শক্ত ও সবল করা যায়, লোভলালসা প্রতিহত করে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, বিশ্বব্যাংকের নীতি ও প্রকল্পগুলোকে বিনাবিচারে সায় না দিয়ে জনগণের চাহিদা, অগ্রাধিকার ও অভিমতকে প্রতিষ্ঠা করা যায় তার জন্য সচেষ্ট হওয়া জরুরি।
এ কথা হয়তো ঠিক যে, ঋণচুক্তি বাতিলের ঘটনাটি আন্তর্জাতিক মহলে সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করবে কমবেশি। বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম ও হত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, দুর্নীতি, প্রশাসনিক স্বজনপ্রীতি, সুশাসন-স্বচ্ছতা-জবাবদিহিতার অভাব, গ্রামীণ ব্যাংক ইস্যু, রাজনৈতিক অস্থিরতা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক মহলে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। নতুন করে পদ্মাব্রিজ এমন কোনো বড় প্রভাব ফেলবে বলে মনে হয় না। কারণ বিশ্বব্যাংকের নীতি ও কার্যক্রম নিয়েও দাতাগোষ্ঠি ও উন্নত দেশগুলো অবগত। তারা সবসময় যে বিশ্বব্যাংকের সবকিছু আকাট্য ভেবে সমর্থন করে, অভিজ্ঞতা কিন্তু তা বলে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোর সঙ্গে অনেক বিষয়েই বিশ্বব্যাংকের সমতবিরোধ আছে বলে জানি। যুক্তরাজ্য ও নরওয়ে কয়েক বছর আগেই বিশ্বব্যাংককে জানিয়ে দিয়েছিল ঋণসাহায্যের সাথে জুড়ে দেয়া কঠিন শর্ত শিথিল না করলে সহযোগিতার বিষয়টি তারা পুনর্বিবেচনা করবে। আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকা জুড়ে বিশ্বব্যাংকের নীতি ও প্রকল্পের বিরুদ্ধে জনগণের শক্ত অবস্থান রয়েছে। সরকারগুলোরও বিশ্বব্যাংকের পক্ষে তেমন কোনো সায় নেই। বিশ্বব্যাংক ভারত ও শ্রীলংকায় তেমন কোনো প্রভাব বিস্তার করতে পারে না। ভারত পিআরএসপি গ্রহণ করেনি, শ্রীলংকা বিদেশি সাহায্যের কার্যকারিতা বিষয়ক প্যারিস ডিক্লারেশনকে পাত্তাই দেয় নি। সরকারের বিভিন্ন মহল যেভাবে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করছে তাতে সরকার খুব চাপে ও টেনশনে আছে বলে মনে হয়। আবার জোর গলায় বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি নিয়ে যখন প্রশ্ন তোলা হচ্ছে, মনে রাখতে হবে, পরবর্তী সময়ে বিশ্বব্যাংকের কাছে যেন ধর্না দিতে না হয়। পদ্মাসেতু ঋণচুক্তি পুনর্বিবেচনার জন্য যে কোনো উদ্যোগ সরকারের অসীম দুর্বলতার সামিল হবে। আমি মনে করি, এই ঘটনায় সরকারের এত্তো ভড়কে যাবার কিছু নেই। বরং এ ঘটনাটি শাপে বর হতে পারে।
সরকারের দুর্বলতাগুলো ক্রমশ কমিয়ে জনগণের পক্ষে একটি শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত গড়ে তোলাসহ দুর্নীতিমুক্ত জবাবদিহিমূলক শাসন ব্যবস্থা, মুক্তবুদ্ধি চর্চা ও গণতান্ত্রিক চর্চার পরিবেশ কীভাবে সমুন্নত করা যায় তার জন্য সচেষ্ট হওয়া প্রয়োজন। নিজের পায়ে দাঁড়ানোর সক্ষমতা অর্জন এ মুহূর্তে আমাদের জন্য সবচেয়ে দরকারি।
লেখক: বেসরকারি সংস্থা ভয়েস-এর নির্বাহী পরিচালক।
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর [email protected]