ঢাকা, সোমবার, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ০৭ অক্টোবর ২০২৪, ০৩ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

এমসি কলেজের ছাত্রাবাস ও শিক্ষামন্ত্রীর একটা পুরনো কথা!

ফারুক যোশী, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩০০ ঘণ্টা, জুলাই ১৪, ২০১২
এমসি কলেজের ছাত্রাবাস ও শিক্ষামন্ত্রীর একটা পুরনো কথা!

সিলেটের এমসি কলেজের ছাত্ররা সিলেটের প্রাচীনতম একটি ছাত্রবাস পুড়িয়ে দিয়েছে। কে পুড়িয়েছে, এ নিয়ে মতৈক্য না-ও থাকতে পারে।

মূলত যুদ্ধটা ছিলো ছাত্রশিবির আর ছাত্রলীগের। খবর থেকেই জানা যায় ছাত্রশিবিরের দখলেই ছিলো এ ছাত্রাবাস। দখলটা নিয়ে নিতে ছাত্রলীগ হয়ত মওকা পেয়েছিলো, কিন্তু শেষমেষ দখল নেওয়া হয়ে উঠেনি। জ্বলে-পুড়ে অঙ্গার হয়ে গেছে ঐতিহ্যের এই ছাত্রাবাস, একে একে তিনটি ব্লক।

যারা এই কলেজের ছাত্র, বিশেষত ছাত্রাবাসের আবাসিক ছাত্রদের কান্না দেখেছি আমরা টিভির পর্দায়। তাদেরতো কান্না আসবেই। তারা এখানে বাস করতো। এখানে তারা তাদের বই-খাতা-নোট-প্রজেক্টসহ অসংখ্য জিনিষ জমিয়েছিলো। এখানকার পরিবেশ তাদের হাতছানি দিতো আগামীর উজ্জ্বল দিনগুলোর। ছাত্রাবাসের অনেক নিরীহ ছাত্র আজ চেখে দেখছে অন্ধকার, কারণ এখন তাদের নতুনভাবে গোছাতে হবে আবার। মধ্যবিত্ত-নিম্নমধ্যবিত্ত কিংবা নিম্নবিত্ত পরিবারের জন্যে আবার নতুন করে চেপে বসলো হাজার হাজার টাকার বোঝা। কিছু ছাত্রের কাছে হয়ত নষ্ট রাজনীতির হাতছানিও ছিলো । শিবিরের কর্মীদের একটা প্রভাব ছিলো এখানে। এরা এক মিথ্যে আবেগের সঙ্গী হয়ে পরকালের পথ প্রশস্ত করার জন্যে আহবান করছিলো মূলত অসত্যের পথে। কারণ যে সত্যের জন্যে তারা লড়তে চায় কিংবা যে সত্যটুকু তারা তাদের হৃদয়ে ধারণ করেছে, তা মূলত এক বিষাক্ত কালিমায় ঢাকা। এই সংগঠনের পূর্বসূরীরা তাদের কালো হাত  রাঙ্গিয়েছে নিরীহ বাঙালিদের রক্তে। ধর্ষণ-খুন-লুন্ঠনের দায়ে এদের সংগঠনের আগের মানুষগুলোর বিচার চেয়ে আসছিলো বাঙালী জাতি দীর্ঘ চল্লিশটি বছর ধরে। মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় নিয়ে এখন তারা বিচারের কাঠগড়ায়। বাংলাদেশের মানুষ ঐ অপরাধীদের শাস্তি চায়।

কিন্তু ছাত্রলীগ---যারা এখন মাত্র একটা ইস্যু নিয়েই বাজারে আছে, তাহলো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার--- কি আসলেই এই যুদ্ধাপরাধীদের বশংবদদের ঠেকাতে এমসি কলেজের ছাত্রাবাসে যুদ্ধ বাঁধিয়েছে। আমাদের বিস্ময় লাগে, সরকারী দলের ছাত্ররা কেন-ই বা আগুন দিয়ে ঠেকাবে ঐ বশংবদদের? আমাদের কি বিশ্বাস করতেই হবে ছাত্রশিবিরকে তাড়াতে আগুন দিতে হবে ছাত্রবাসে? তাহলে রাজনীতির নীতি আর নৈতিকতা কোথায়? কোথায় আদর্শের বুলি? কে বা কারা, কেন-ই-বা জ্বালিয়ে দেয়া হলো এই ছাত্রবাসগুলো? ছাত্রাবাসগুলো জ্বালিয়ে দেবার পেছনে কি আসল কারণ? নিছক কি ছাত্র নামধারীদের গুণ্ডামির পরিনাম এটা, না-কি এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে সিলেটের কোনো আবাসন বাণিজ্য? কিংবা টেণ্ডারবাণিজ্যের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা ?

এই ছাত্রাবাসটির সঙ্গে জড়িয়ে আছে এমনকি হাজার হাজার পুরনো ছাত্রদের আবেগ। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ তার আবেগ ধরে রাখতে পারেননি। তার রাজনৈতিক জীবনের সুন্দর দিনগুলোর স্মৃতিজড়ানো ছিলো ছাত্রাবাসের তিন নম্বর কক্ষ ঘিরে। তাইতো এই ব্রিটেনেও দেখছি এ নিয়ে পুরনোদের আবেগমিশ্রিত কথা। মুক্তিযুদ্ধ করেছেন, একসময় ডাক্তারি পেশা থেকে এখন অবসর জীবন যাপন করছেন এমন একজন মানুষ ফোন করে বললেন, কি এমন মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, যা জাগিয়ে রাখতে শিবিরকে ছাত্রাবাস থেকে সরিয়ে দিতে গিয়ে শেষপর্যন্ত ছাত্রাবাসটাই জ্বালিয়ে দিতে হবে?

ব্রিটেনে ছড়িয়ে আছেন পুরনো অসংখ্য সেইসব ছাত্র, যাদের মাঝে এমনকি দেশে অসাধারণ ফলাফল করা ছাত্র আছেন, তারা উচ্চারণ করছেন তাদের আবেগের কথা, ক্ষোভের কথা। এই কলেজ সংসদের নির্বাচিত প্রতিনিধি থেকে শুরু করে আছেন অনেকে পেশাদার মানুষ। এমসি কলেজের এক প্রাক্তন ছাত্র নাসায় (NASA)কাজ করতেন এক সময়, এখন আমেরিকার ভার্জিনিয়ার একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি; ঐদিনই ফোন করে লন্ডনের এক সাংবাদিকের সঙ্গে শেয়ার করেছেন এ নিয়ে তার বেদনার কথা। ঘৃণা উচ্চারিত হচ্ছে সব মহল থেকে। ধিক্কার দিয়ে কি লাভ ! ধিক্কার নয়, আমাদের চাওয়াটা দেশ ও জাতির মতোই। শিক্ষামন্ত্রী বলেছেন, বিচার হবেই। তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের জাতীয় রাজনীতির চূড়ায় বসে শিক্ষামন্ত্রী কিংবা অর্থমন্ত্রী আর কতটুকুই করতে পারবেন? এ প্রশ্নতো থেকেই যায়। কারণ আমরা দেখেছি স্থানীয় ক্ষমতাসীন দল থেকে এমন কোনো কঠোর ভাষাই উচ্চারিত হয়নি অপরাধীদের প্রতি। "অপরাধী যে-ই হোক"---আসল অপরাধীর সন্ধান করবে-তো স্থানীয়রাই, কেন্দ্র কিংবা মন্ত্রী কি-ই করতে পারেন ?

বাংলাদেশের ছাত্র রাজনীতিতে চলছে নৈরাজ্য। টেন্ডারবাজ সন্ত্রাসীদের আরেক নাম হয়ে গেছে ছাত্র। অনেক ছাত্রই আছেন, যারা এখন ছাত্র থাকতেই কোটি কোটি টাকা ব্যয় করে নির্বাচন করার স্বপ্ন দেখেন। সেভাবে শিক্ষকদেরও আছে রাজনীতি। বুয়েটের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একদিকে শিক্ষকদের আন্দোলন, অন্যদিকে ভিসির দাবি, ‘’প্রধানমন্ত্রী বললে পদত্যাগ করবো। ‘’

কতটা মেরুদণ্ডহীন হলে একজন ভিসি ছাত্র-শিক্ষকদের দাবিকে তোয়াক্কা না করে প্রধানমন্ত্রীর ইশারার দিকে চেয়ে থাকতে পারেন। কিভাবেই না জাতির বিবেক বলে খ্যাত আরেকজন সাবেক ভিসি বলতে পারেন তারেক জিয়া এ প্রজন্মের আদর্শ। এভাবেই ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্যে কিংবা আগামী দিনে ক্ষমতার অংশীদার হবার জন্যে শিক্ষক নামধারী কতিপয় সরকারী নেতাও চালিয়ে যাচ্ছেন যাচ্ছেতাই।

ক্ষমতা আর অর্থের হাতছানিতে শিক্ষাঙ্গনগুলো একের পর এক সন্ত্রাসের ক্ষেত্র হয়ে উঠছে। এ সরকারের এক ব্যাপক সার্থকতা হলো আজকের শিক্ষাব্যবস্থা। সরকারের এই সার্থকতায় পরিকল্পিতভাবেই যেন চেষ্টা চলছে কালিমা লেপনের, পাঁয়তারা চলছে শিক্ষাঙ্গনগুলোর সুষ্ট পরিবেশ  ধ্বংস করে দেয়ার। এমসি কলেজের ছাত্রবাসে আগুন তারও এক অংশ হতে পারে। এ প্রসংগে শিক্ষামন্ত্রীকে তারই বলা একটা কথা স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, স্বৈরাচারী এরশাদের পতনের পর সংসদ নির্বাচনে আজকের শিক্ষামন্ত্রী পরাজিত হয়েছিলেন। সে নির্বাচনে পরাজিত হয়ে তার এলাকা বিয়ানীবাজারের এক বিশাল জনসভায় বলেছিলেন, "আমি জানি এ নির্বাচনে জনগণ আমাকে পছন্দ করেছে", সঙ্গে সঙ্গে সিলেটের একটি প্রবাদ উচ্চারণ করে তিনি আরও বলেছিলেন; "তবে এ-ও জানি, বেড়ায়ও এই নির্বাচনে ধান খেয়েছে"। আমরাও যারা ভোটার ছিলাম, তারাও জানতাম সেই বেড়ার ভেতরের কেউ ধান খায়নি। যাদের দিয়ে এই বেড়া কিংবা মনুষ্য-দেয়ালটা তৈরি করা হয়েছিলো তারাই ছিলো তার পরাজয়ের মুল কারণ। মাননীয় শিক্ষামন্ত্রীর `বেড়ায় ধান খাওয়ার` ঘটনা তো ঘটেনি এমসি কলেজের  অঙ্গার হয়ে যাওয়া ছাত্রাবাসে----এ বিশ্বাসটা আমরা রাখতে চাই। সেজন্যেই ভাবতে অনুরোধ করি শিক্ষামন্ত্রীকে।

[email protected]
ফারুক যোশীঃ যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সাংবাদিক ও কলাম লেখক
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর
[email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।