“সিভিল কোর্ট হলে আশা আছে। জজ সাহেবদের টাকা খাওয়াতে হবে।
অর্থাৎ সোজা বাংলায়-- ঘুষ খাওয়ার জন্য অনেক জজ সাহেব কাতলা মাছের মতো বিশাল হাঁ করে থাকেন!
দরজার ওপাশে উপন্যাসের এই সংলাপের জন্য হুমায়ূন আহমেদকে কি পরিমাণ ঝমেলায় পড়তে হয়েছিল তা বাংলাদেশি মাত্রেই জানেন। ‘আত্মসম্মানে খোঁচা’ লাগায় দেশের বিচারকরা হুমায়ূন বিরোধী মিছিল করেছেন। বিষয়টি মিছিল-মিটিং-কুশপুতুল দাহ ছাড়িয়ে শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালত পর্যন্ত গড়ায়।
২০/২৫ বছর আগের ওই ঘটনায় তখন দেশজুড়ে তোলপাড়। পত্রিকাগুলো নিয়মিত এ সংক্রান্ত খবর ছাপছিল। বিচারকরা সাংবাদিকদের নামেও মামলা করলেন। হুমায়ূন তখন ধনে-মানে-জনে আজকের পর্যায়ে পৌঁছেননি। আসুন, ওই সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে হুমায়ূনের অনুভূতিটা তার ভাষায় পড়ে নেই একবার-
মামলা শুরু হলো| আমি হাইকোর্টে যাই| সঙ্গে আমার তিন কন্যা এবং তাদের মা| তারা ভয়ে অস্থির‚ এই বুঝি আমাকে জেলে ঢুকিয়ে দিচ্ছে| মামলার এক পর্যায়ে তিন বিচারক নিয়ে গঠিত বেঞ্চের একজন বললেন,‚ তিনি বিব্রত| মামলায় থাকবেন না| কিছুদিন পর আরেকটি বেঞ্চ তৈরি হলো|
সেই বেঞ্চের এক বিচারকও বললেন, তিনি বিব্রত| পনেরো ষোল বছর তো হয়েই গেল ‚বিচারকরা আমার বিষয়ে বিব্রত রয়েই গেলেন...”
হুমায়ূন বিষয়ে দেশের ‘ব্রাহ্মণ বুদ্ধিজীবীরা’ একসময়ে অনেক তুচ্ছাতিতুচ্ছজ্ঞানকারী মন্তব্য করেছেন, এখনও করেন। কষ্টের কথা হলো, তাদের তালিকায় যোগ দিয়েছিলেন সর্বজন মান্য ব্যক্তিরাও।
কিন্তু একবার বুকে হাত দিয়ে বলুন তো, আমাদের আদালত নিয়ে, আইন ব্যবস্থা নিয়ে, পুলিশ নিয়ে হুমায়ূন তার উপন্যাসে তখন যা বলেছিলেন- তা কি সঠিক ছিল না! তখন হুমায়ূনের পক্ষ নিয়েছিলেন ক’জনা? সেই সময়ে যদি শীর্ষ বুদ্ধিজীবীরা হুমায়ূনের পক্ষ নিতেন, তাহলে বিচার বিভাগ নিয়ে, শিক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে, চিকিৎসা, পরিবহন, খাদ্য, পুলিশসহ সবগুলো জাতীয় প্রতিষ্ঠান নিয়ে আজকের এই মাৎসন্যায় পরিস্থিতি হয়তো দেখতে হতো না। নীতি-আদর্শহীনতার ধেই ধেই নৃত্য, বিবেক-বুদ্ধির এই তীব্র আকাল অবশ-বিবশ হয়ে দেখতে হতো না।
একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন লেখক যা বলতে পেরেছেন, তা কি অন্যরা, আমাদের শিক্ষক, সামরিক-বেসামরিক আমলারা, রাজনীতিকরা, প্রকৌশলীরা, ব্যবসায়ীরা, গৃহকর্তা আর গৃহিনীরা পালন করেছেন? আমরা কি নিদেনপক্ষে আমাদের যার যার পরিবারকে দুর্নীতিমুক্ত, অন্যায় কাজে নিরুৎসাহিত আর নিজেরটা ষোল আনা অন্যেরটা কানা কড়িওনা মন্ত্র থেকে সংযত করতে পেরেছি?
হুমায়ূনের ‘জজ-কাতলামাছ-ঘুষ’ কাণ্ডের সময়টায় আমি কিশোর-তরুণ। এই আমার কাছেও তখন মনে হয়েছিল হুমায়ূন শতকরা একশ’ ভাগ হক কথা বলেছেন। কিন্তু ‘আইন জাননেওয়ালাদের’ তোপে আর ‘যা হচ্ছে ভালোই তো’ বলে বুদ্ধিওয়ালাদের নিস্পৃহতায় হুমায়ূন পড়েছিলেন মারাত্মক গ্যাড়াকলে। যাদের নৈতিক দায়িত্ব ছিল তাঁর পাশে দাঁড়ানোর, তারা জাত্যাভিমানে রইলেন দূরে সরে, তামাশা দেখতে। এখন তামাশা দেখার ব্যবস্থা পুরো জাতিকে নিয়েই হয়েছে। ওজন থেকে নিয়ে শিক্ষা, টিপাইমুখ থেকে পদ্মাসেতু, মোবাইল ফোন থেকে টমেটো জুস- সর্বত্র নীতিহীনতার যেমন খুশী সাজো প্রতিযোগিতা শুরু হয়ে গেছে। প্রতিদিন এই প্রতিযোগিতার বেগ তীব্রতর হচ্ছে।
আসুন, জজ সাহেব এবং কাতলা মাছ জটিলতার বিষয়ে হুমায়ূন আহমেদের নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনাকারী লেখাটির এই সুযোগে একবার পুরো পড়ে নেই। এতে হিমু সৃষ্টির পটভূমিও কিছুটা উঠে এসেছে।
“পাঠকরা ভুলেও ভাববেন না ময়ূরাক্ষী বের হওয়ার পরপরই যুবক শ্রেণীর বিরাট অংশ হলুদ পাঞ্জাবি পরে রাস্তায় নেমে গেল| আমিও মনের আনন্দে একের পর এক হিমু বাজারে ছাড়তে লাগলাম| পাশ বইয়ের খাতায় টাকা জমা হতে লাগল| শুরুতে হিমুকে আমি মোটেই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করিনি| তখন আমার প্রিয় চরিত্র মিসির আলি| আমি লিখছি মিসির আলি| এই ভদ্রলোকের লজিকে এবং বিশ্লেষণী ক্ষমতায় আমি মুগ্ধ|
এর মধ্যে আমার অর্থনৈতিক অবস্থার সামান্য উন্নতি হয়েছে| বন্ধু-বান্ধব‚ ব্যাংক এবং প্রকাশকদের কাছ থেকে ধার করে এলিফ্যান্ট রোডে একটা ফ্ল্যাট কিনে ফেলেছি| পনেরশ স্কয়ার ফিটের ছোট্ট ফ্ল্যাট| তাতে কী‚ দুটো বেডরুম আছে| একটা বারান্দা আছে|বারান্দায় বসলে সুন্দর কোনো প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখতে পাই না| জুতার দোকান দেখতে পাই| ছয়তলা থেকে জুতার দোকান দেখা খারাপ কিছু না|
বারান্দায় বসে চা খেতে খেতে আমি জুতার দোকান দেখি এবং পরের লেখাটা কী হবে ভাবি| আমার তিন মেয়ে তখন সামান্য বড় হয়েছে| বড় মেয়েটি ক্লাস সিক্সে পড়ে‚, মেজোটি পড়ে ক্লাস ফোরে| ভোরবেলা স্কুলের পোশাক পরে তারা কিছুক্ষণ ধবল রঙের ডিপফ্রিজের সামনে দাঁড়ায়|
কারণ তাদের বাবা রাতে যা লিখেছে তা ডিপফ্রিজের ওপর সাজানো থাকে| আমার এইদুই কন্যা বাবার লেখার সর্বশেষ অংশ না পড়ে স্কুলে যাবে না| আমার লেখক জীবনে এর চেয়ে বড় পুরস্কার পেয়েছি বলে মনে পড়ে না| আমার এই দুই কন্যার কোনো একজন‚ খুব সম্ভব বড়জন আমাকে একদিন বলল‚, বাবা ময়ূরাক্ষীর মতো আরেকটা বই লেখ| হিমুর বই|
হিমুকে নিয়ে কন্যার আগ্রহে লিখে শেষ করলাম দরজার ওপাশে| বই প্রকাশিত হলো| আমি পড়লাম মহাবিপদে| হাইকোর্টে বিচারকদের সমিতি আছে| সমিতির মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হলো‚ এই বইটি লিখে আমি মহা অন্যায় করেছি| মহান বিচারকদের সম্মান ধুলায় লুটিয়ে দিয়েছি| কারণ আমি লিখেছি জজ সাহেবরা ঘুষ খান|
উপন্যাসে ঘটনাটা এরকম- হিমুর মাতুল বংশ পিশাচ শ্রেণীর| তারা হেন দুষ্কর্ম নাই যা করে না| তাদের ধারণা যে কোনো কাজ টাকা দিয়ে করানো সম্ভব| তাদেরই একজন জজ সাহেবকে ঘুষ দিয়ে এই কাজটা করাতে চাচ্ছে| জজ সাহেবরা ঘুষ খান- এটি হিমুর ধান্ধাবাজ মামার কথা| বইতে কিভাবে এসেছে দেখা যাক|
মামা গোসল করে জায়নামাজে বসে গেলেন| দীর্ঘ সময় লাগল নামাজ শেষ করতে| তার চেহারা হয়েছে সুফি সাধকের মতো| ধবধবে সাদা লম্বা দাড়ি| মোনাজাত করার সময় টপটপ করে তার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল| আমি অবাক হয়ে এই দৃশ্য দেখলাম|
তারপর বল‚ কী ব্যাপার?
একজন লোক জেলখানায় আছে মামা| ওর সঙ্গে দেখা করা দরকার‚ দেখা করার কায়দা পাচ্ছি না| দরখাস্ত করেছি‚ লাভ হয়নি|
খুনের আসামি? তিনশ বারো ধারা?
কোন ধারা তা জানি না‚ তবে খুনের আসামি|
এটা কোনো ব্যাপারই না| টাকা খাওয়াতে হবে| এই দেশে এমন কোনো জিনিস নেই যা টাকায় হয় না|
টাকা তো মামা আমার নেই|
টাকার চিন্তা তোকে করতে বলছি নাকি? আমরা আছি কী জন্য? মরে তো যাই নাই|টাকা সঙ্গে নিয়ে আসছি| দরকার হলে জমি বেঁচে দেব| খুনের মামলাটা কী রকম বল শুনি| আসামি ছাড়ায়ে আনতে হবে|
তুমি পারবে না মামা| তোমার ক্ষমতার বাইরে|
আগে বল‚ তারপর বুঝব পারব কী পারব না| টাকা থাকলে এই দেশে খুন কোনো ব্যাপারই না| এক লাখ টাকা থাকলে দুটো খুন করা যায়| প্রতি খুনে খরচ হয় পঞ্চাশ হাজার| পলিটিক্যাল লোক হলে কিছু বেশি লাগে|
আমি মোবারক হোসেন সাহেবের ব্যাপারটা বললাম| মামা গালে হাত দিযে গভীর আগ্রহনিয়ে শুনলেন| সব শুনে দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললেন‚ পুলিশের সাজানো মামলা‚ পেছনে আছে বড় খুঁটি| কিছু করা যাবে না| ট্রাইব্যুনাল করলে কোনো আশা নাই‚ সিভিল কোর্ট হলে আশা আছে| জজ সাহেবদের টাকা খাওয়াতে হবে| আগে জজ সাহেবরা টাকা খেত না| এখন খায়| অনেক জজ দেখেছি কাতলা মাছের মতো হাঁ করে থাকে| কেইস সিভিল কোর্টে উঠলে আমারে খবর দিয়ে নিয়ে আসবি|
মামলা মোকদ্দমা বিষয়ে আমার কোনো অভিজ্ঞতা নেই| সব সময় শুনেছি মামলা লোয়ারকোর্ট থেকে হাইকোর্টে যায়‚ তারপর সুপ্রিম কোর্টে| আমার বেলায় সরাসরি হাইকোর্ট থেকে তলব|
শুধু আমি একা আসামি তা কিন্তু না| আমাকে নিয়ে বিচারকরা মামলা করেছেন এইবিষয়টি যেসব পত্রিকায় ছাপা হয়েছে তারাও আসামি| তাতে আমার সুবিধা হলো‚পত্রিকার সম্পাদকরা বড় বড় ব্যারিস্টার দিলেন| এই মুহূর্তে ড. কামাল হোসেন এবং ভাষাসৈনিক গাজিউল হকের নাম মনে পড়ছে|
পত্রিকার সম্পাদকরা উপস্থিত হয়ে ক্ষমা চাইলেন এবং পার পেয়ে গেলেন| অ্যাটর্নি জেনারেল তার অফিসে আমাকে ডেকে নিয়ে ক্ষমা প্রার্থনা করতে বললেন| তিনি আমাকে আশ্বাস দিলেন যে‚ ক্ষমা প্রার্থনা করলে এবং বিতর্কিত বইটি বাজার থেকে উঠিয়ে নিলে আমার আর কোনো ঝামেলা হবে না|
আমি বললাম‚ ভুল করলেই ক্ষমা প্রার্থনার প্রশ্ন আসে| আমি ভুল করিনি| উপন্যাসের একটি দুষ্ট চরিত্র কী বলছে তার দায়ভার লেখকের না| তারপরেও যদি দায়ভার আমার থাকে তাহলে আমি জজ সাহেবরা ঘুষ খান এই মন্তব্য থেকে সরে আসব না| সব জজ সাহেবের কথা এখানে বলা হয়নি| জজ সাহেবরা ভিনগ্রহ থেকে আসেননি| মানুষের সাধারণ ত্রুটি তাদের মধ্যেও থাকবে|
একজন লেখক হিসেবে আমি তা লিখব| আমাদের সংবিধান মত প্রকাশের অধিকার দিয়েছে| অ্যাটর্নি জেনারেল বললেন‚ আপনি কিন্তু বিপদে পড়বেন| আমি বললাম‚ কী আর করা| না হয় একটু বিপদে পড়লাম|
মামলা শুরু হলো| আমি হাইকোর্টে যাই| সঙ্গে আমার তিন কন্যা এবং তাদের মা| তারা ভয়ে অস্থির‚ এই বুঝি আমাকে জেলে ঢুকিয়ে দিচ্ছে| মামলার এক পর্যায়ে তিন বিচারক নিয়ে গঠিত বেঞ্চের একজন বললেন‚ তিনি বিব্রত| মামলায় থাকবেন না| কিছুদিন পর আরেকটি বেঞ্চ তৈরি হলো|
সেই বেঞ্চের এক বিচারকও বললেন, তিনি বিব্রত| পনেরো ষোল বছর তো হয়েই গেল‚বিচারকরা আমার বিষয়ে বিব্রত রয়েই গেলেন| আমার খুব ইচ্ছা করে মামলাটা শেষপর্যন্ত দেখতে| মামলায় আমি যদি জিতে যাই তাহলে প্রমাণ হবে জজ সাহেবরা সাধারণ লোভ লালসার ঊর্ধ্বে না| আর যদি হেরে জেলে যাই তাতেও ক্ষতি নেই|
অতীতে এই পৃথিবীতে লেখার মাধ্যমে মত প্রকাশের কারণে মৃত্যুদণ্ড দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটেছে| আমি মনে হয় কিছুদিন জেলে থাকলাম| আমাকে জেলখানার মেঝেতে শুয়ে থাকতে হবে না| একুশে পদক পাওয়ার কারণে ডিভিশন দেওয়া হবে| বিছানায় ঘুমাব|ভাগ্য ভালো হলে মাথার উপর ফ্যান ঘুরবে| ফ্যান না ঘুরলেও ক্ষতি নেই, চোখ বন্ধ করে ময়ূরাক্ষী নদীকে জেলের ভেতর নিয়ে আসা কঠিন কোনো কাজ না|”
সেই দিন গেছে। যেখানে কিছু জজ সাহেব কাতলা মাছের মত হাঁ করে থাকেন—এই সত্য ভাষণের জন্য দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় লেখককে এ ধরনের জিল্লতি ভোগ করতে হয়েছে, সেখানে পরবর্তী বাস্তবতাটা কোন পর্যায়ে গেছে তা কারও অজানা নয়। জাল শিক্ষাগত সনদ তথা ঘষামাজা নম্বরপত্র দেখিয়ে হাইকোর্টের বিচারপতি বনে যাওয়া ‘বিচারপতি’ ফয়সল মাহমুদ ফয়জীর বহুল আলোচিত জালিয়াতির বিষয়টি এখানে স্মরণ করা যেতে পারে। তার জালিয়াতি জানাজানি হওয়ার পরও তিনি কঠিনভাবে বেঁকে বসেছিলেন। শেষ পর্যন্ত তাকে সরাতে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল গঠন করতে হয়েছিল। এ ঘটনায় ফয়সাল মাহমুদ ফয়জীর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাওয়া এলএলবি সনদ বাতিল করা হয়।
উল্লেখ্য, হাইকোর্টে বিচারপতি ফয়সাল মাহমুদ ফয়েজির সনদ নিয়ে আগেও একবার বিতর্ক উঠেছিল। তার সনদে স্পষ্টত ঘষামাজা পরিলক্ষিত হওয়ায় তা বাতিলের সুপারিশ করা হয়।
এদিকে, গত ৩০ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের জাজেস লাউঞ্জে জেলা জজদের এক সমাবেশে প্রধান বিচারপতি মোজাম্মেল হোসেন বিচারকদের ‘দুর্নীতি’র বিষয় উল্লেখ করে এর বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।
এ সময় প্রধান বিচারপতি আরও বলেন, আইন মন্ত্রণালয়ের কমিটি ৬১ জন অতিরিক্ত জেলা জজের মধ্যে ১৩ জনের নাম দুর্নীতি ও অন্যান্য অভিযোগে পদোন্নতির প্যানেলে দেয়নি। আরও পাঁচজনের বিরুদ্ধে অভিযোগ অপেক্ষাকৃত কম নেতিবাচক হওয়ায় তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্তের ভার সুপ্রিম কোর্টের কাছে ন্যস্ত করা হয়। পরে দেখা যায়, সুপ্রিম কোর্ট ওই ১৩ জনের মধ্য থেকে চারজনকে পদোন্নতি দিয়েছেন। এর মধ্যে এমন একজন আছেন যার সম্পর্কে সরকার বলেছে, তার ২০০৬ ও ২০০৭ সালের ডোসিয়ারে দুর্নীতিসংক্রান্ত ‘বিরূপ মন্তব্য’ থাকায় তাকে পদোন্নতির প্যানেলে অন্তর্ভুক্ত না করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ”
বিচারকদের ব্যাপারে প্রধান বিচারপতির বক্তব্যের কিছু অংশ মাত্র এখানে উপস্থাপন করা হলো। প্রাসঙ্গিক বিবেচনায় হুমায়ূনের বক্তব্যের কিছু অংশ এখানে ফের আনছি। তিনি বলেছিলেন, “আমি বললাম‚ ভুল করলেই ক্ষমা প্রার্থনার প্রশ্ন আসে| আমি ভুল করিনি| উপন্যাসের একটি দুষ্ট চরিত্র কী বলছে তার দায়ভার লেখকের না। তারপরেও যদি দায়ভার আমার থাকে তাহলে আমি জজ সাহেবরা ঘুষ খান এই মন্তব্য থেকে সরে আসব না| সব জজ সাহেবের কথা এখানে বলা হয়নি| জজ সাহেবরা ভিনগ্রহ থেকে আসেননি| মানুষের সাধারণ ত্রুটি তাদের মধ্যেও থাকবে|”
এখন কিন্তু দেখা যাচ্ছে প্রধান বিচারপতি শ্রদ্ধেয় বিচারকদের শাসন বা গাইড করার তরিকায় ওই বক্তব্যে প্রকারান্তরে হুমায়ূনের কথার প্রতিধ্বনিই করেছেন। একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন লেখক যে মেসেজ সমাজকে, জাতিকে দেওয়ার ছিল তা সময়ে তিনি ঠিকই দিয়েছে। আমরাই বুঝতে পারিনি, বা বুঝতে চাইনি বোঝার পরও।
এইসব অবিবেচনাপ্রসূত ‘অন্যায়ের’ জন্য, জাতির শ্রেষ্ঠ একজন সন্তানের নৈতিক দায়ত্ব পালনের কারণে উল্টো তাকে হয়রান-পেরেশান করার কারণে তার কাছে হয়তো ক্ষমা চাওয়ার প্রয়োজন হবে না, কিন্তু কিছুটা অনুশোচনা নিশ্চয়ই আমরা করতে পারি, অন্তত মনে মনে!
কারণ, সংখ্যাগরিষ্ঠের অন্যায় গোষ্ঠীগত চাপে আমাদের সব ভালোগুলোই দিন দিন গৃহত্যাগী সন্ন্যাসীর মত মুঠো ফসকে বেড়িয়ে যাচ্ছে। শূণ্যস্থান পূরণ করছে ব্ল্যাকহোল তুল্য নেতিবাচক সব আচার-সংস্কৃতি।
আশা করছি, প্রসঙ্গটি এখানে উল্লেখ করায় এই না-চিজের ওপর কেউ ক্ষুব্ধ হবেন না! কারণ অসাধারণ একজন মানুষ, আমাদের অহংকারের ধন, মাত্র গত রাতেই তার রচিত কাব্যগ্রন্থ ‘গৃহত্যাগী জ্যোৎস্না’র মত আমাদের বিদায় জানিয়ে চলে গেছেন।
আমরা বিষয়গুলো না বুঝলে এরকম আরও অনেক কিছুই চলে যাবে আমাদের ছেড়ে, বুকে গোপন অভিমান নিয়ে।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪১ ঘণ্টা, ২০ জুলাই, ২০১২