দক্ষ ম্যানেজমেন্ট একজন ব্যবস্হাপকের যোগ্যতার মানদণ্ড। রাষ্ট্রের বিষয়কভিত্তিক ব্যবস্হাপনায় দায়িত্ব বন্টনের পালায় বিকেন্দ্রীকরণকৃত বিভাগগুলোকে নামকরণ করা হয়েছে মন্ত্রণালয়।
কিন্তু ম্যানেজমেন্ট বাড়ানোর বদলে মন্ত্রীরা নিজেদের অযোগ্যতা ঢাকেন বিভিন্ন ‘স্ট্যান্টবাজিতে’। পুলিশ প্রহরায় ভেঁপু বাজিয়ে দলীয় ক্যাডরদের আগাম খবর দিয়ে মন্ত্রীরা বিভিন্ন দফতর-অধিদফতরে ‘আকস্মিক’ সফরে গিয়ে হাতে নাতে দালাল ধরেন। মন্ত্রীদের আকস্মিক সফরের আগে যথারীতি স্পটে উপস্হিত থাকেন বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা আর রিপোর্টার। এতো বিশাল আয়োজন দেখেও দালালেরা নির্বোধের মতো মন্ত্রীদের পাতা ফাঁদে ধরা দেয়! মন্ত্রীদের অনেকেরই রয়েছে হাতে নাতে ঘুষের লেন দেন ধরার ‘বাস্তব’ থ্রিলিং অভিজ্ঞতা।
আদৌ মন্ত্রীদের কী কোনো দাফতরিক কাজ নেই? পরিকল্পনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণের কোনো ব্যাপার-স্যাপার নেই? সচিব বন্ধুদের অফিসে মুখোমুখি বসে কাটতে হয় তিন-চার ঘন্টা; কারণ টেবিলে ফাইলের স্তুপ। সেই সংগে থাকে বিভিন্ন জরুরি ফোন কল ও ইস্যু সমাধানের ঝামেলা। মন্ত্রীদের অনেকে যেভাবে ঝাড়া হাত-পা ঘুরে বেড়ান তাতে মালুম হতে ইচ্ছে হয় মন্ত্রীদের বোধহয় কোনো ফাইল ওয়ার্ক নেই। অধিকাংশ মন্ত্রীর জবানিতে কেবল উন্নয়নের আর নতুন প্রকল্পের গাল-গল্প। সচিবালয়ে গুঞ্জন আছে, যত বেশি নতুন প্রকল্প ততবেশি ‘বাণিজ্য’। জনস্বার্থে নয়, প্রকল্প পরিকল্পনা আর নয়া-নয়া কেনাকাটায় মন্ত্রীদের নিজেদের আখের গোছানোর ‘নিয়তই’ মুখ্য। মধ্যিখানে সামান্য ফায়দা হয় ‘আমজনতার’।
আকস্মিক সফরের সেরা ও তুলনাহীন উপমা এরশাদ। গোয়েন্দা বিভাগ আর রাষ্ট্রপতির গার্ড রেজিমেন্ট সপ্তাহখানেক ধরে তত্ত্ব-তল্লাশি চালিয়ে রাষ্ট্রপতির নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পর এরশাদ জুম্মার আগের রাতে ‘স্বপ্নে আদেশপ্রাপ্ত’ হয়ে হঠাৎ নির্দিষ্ট মসজিদে জুম্মার নামাজ আদায়ে যেতেন। এরশাদ জমানার পর দীর্ঘদিন ধরে ‘আকস্মিক ও ঝটিকা’ সফরের ’ছিলছিলা’টা বন্ধ ছিলো। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের তূখোড় নেতা ওবায়দুল কাদেরকে ধন্যবাদ। তিনি সার্থকভাবে এরশাদের রেখে যাওয়া ‘ঐতিহ্যটুক’ ধরে রেখেছেন! মধ্যরাতে ফেণী রেল স্টেশনের অনিয়ম ধরতে গিয়ে ছিলেন তিনি। তবে কাকতলীয়ভাবে অনেক আগেই সেখানে ছাত্র-যুবলীগ আর স্হানীয় মিডিয়া উপস্হিত ছিল।
শনিবার রাতে টেলিভিশনে দেখলাম ঝটিকা সফরে যোগাযোগ ও রেলমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের চাটগাঁ রেল স্টেশনে গিয়ে টিকেট কালোবাজারি ’নিশ্চিহ্ন’ করলেন। বদলি করা হলো কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীকে। আগে বেশ কয়েকবার একই ধরনের অ্যাকশন দেখেছি কমলাপুরসহ বিভিন্ন রেল স্টেশনে। কিন্তু গলদভরা সিস্টেমে মানুষ বদল করে কী কোনো কাঙ্ক্ষিত ফলাফল আসে? রেলের টিকেট কালোবাজারির মুনাফার একাংশতো ‘উঁচুতলায়’ যায়। টিকেট কালোবাজারির প্রশ্রয়দাতা ‘রাণী মৌমাছিরা’তো থাকেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। দু’একটা মৌমাছি মেরে কী মধু আহরণ বন্ধ করা যায়? সংবাদপত্রের পাতায় দেখা যায়, আধা কেজি গাঁজাসহ মাদক সম্রাজ্ঞী বা সম্রাট গ্রেফতার। যাদের পৃষ্ঠপোষকতায় টন টন গাঁজা আর হাজার কেজি হিরোইন দেশের বিভিন্ন অলি-গলিতে ঢোকে, তাদের কি নামে ডাকা হবে?
বেহাল সড়ক দেখে মন্ত্রী প্রায়শঃই দায়িত্বে অবহেলার জন্যে দায়ীদের সাময়িক ‘বরখাস্তের’ আদেশ দেন। ধন্যবাদ। কিন্তু যখন দেখি সাড়ে তিন শ’ কোটি টাকার টেন্ডারবাজির গোলাগুলির জন্যে মন্ত্রীর নির্দেশে গঠিত তদন্ত কমিটি দ্বিতীয় ও তৃতীয় শ্রেণীর কর্মচারীদের কয়েকজনকে দায়ী করে রিপোর্ট দাখিল করলে মন্ত্রী তৃপ্তির ঢেঁকুর তোলেন তখন মন্ত্রীর সদিচ্ছা নিয়ে প্রশ্ন জাগে।
যোগাযোগমন্ত্রীর ‘বাতচিতে’ প্রাণটা জুড়িয়ে যায় কিন্তু তিনি কি একবারো খোঁজ নিয়ে দেখেছেন বিআরটিসি’র কোটি টাকা দামের আমদানিকৃত ভলভো বাসগুলো কেন উধাও? অথচ বেসরকারি কোম্পানি ও ব্যবস্হাপনার আরো পুরোনো ভলভো বাসগুলো এখনো দিব্যি তরতাজা- নতুন। শোনা যায় বিআরটিসি’র ভলভো বাসের খুচরো যন্ত্রাংশগুলো ‘অলৌকিকভাবে’ বেসরকারি ভলভো বাসগুলোতে স্পেয়ার পার্টস হিসেবে ব্যবহূত হয়।
সিস্টেম ঠিক না করে অহেতুক দৌড়-ঝাঁপে টিভিতে চেহারা দেখানো যায়, সংবাদপত্রের হেডিং হওয়া সম্ভব কিন্তু আমজনতার কোনো লাভ হয় না। সিস্টেম ঠিক করার জন্যে কাউকে রকেট সায়েন্টিস্ট হতে হয় না। চাই নিখাদ আন্তরিকতা।
পাদটীকা : থানায় এসে কোনো কোনো নতুন ওসি হুংকার ছাড়েন, ‘আমার এলাকাকে এক সপ্তাহের মধ্যে ক্রাইম মুক্ত করতে চাই’। এরপর চলে ব্যাপক ধরপাকড় আর অভিযান। সেকেন্ড অফিসার আর সিপাইরা জানেন, নতুন ওসি’র খাই খাই বেশি। সঙ্গে রেটটাও।
ই-মেলঃ [email protected]
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর [email protected]