ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

পোশাকশিল্প: দুটো সত্যের মধ্যবর্তী সত্য কোনটা?

মাহবুব মিঠু, কন্ট্রিবিউটিং এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০২ ঘণ্টা, আগস্ট ৫, ২০১২
পোশাকশিল্প: দুটো সত্যের মধ্যবর্তী সত্য কোনটা?

অনেক ঘটনা এবং দুর্ঘটনার ভিড়ে বাংলাদেশের পোশাকশিল্পে সমস্যার সমাধান না হলেও আলোচনা থেমে আছে। কিন্তু যেহেতু সমস্যা সৃষ্টির কারণগুলো দূর হয়নি, তাই আশংকা করা যায়, যে কোনো মুহুর্তে সেটা আবার মাথাচাড়া দিতে পারে।

এর উপরে বাংলানিউজও বেশ কয়েকটা তথ্যমূলক প্রতিবেদন ছাপিয়েছে। সমস্যার সমাধান করতে না পারলেও পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠনের নেতারা বেশ কিছুদিন আগে একটা আপত্তিকর মন্তব্য করে কিছুটা সমালোচিত হয়েছিলেন। তারা বলেছিলেন, মাতৃত্বকালীন ছুটি বাড়ালে নাকি সেটা জনসংখ্যা বৃদ্ধির হুমকি বয়ে আনবে। এভাবেই তারা পোশাকশিল্পে বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধানের চেয়ে নতুন একটা প্রশ্ন সামনে নিয়ে এসেছেন। আর তাহলো নারীর প্রতি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গী।

বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের অভূতপূর্ব বিকাশ যেমন দেশের অর্থনীতিকে গতিশীল রাখতে প্রধান নিয়ামকের ভূমিকা পালন করছে, ঠিক তেমনি নারী-উন্নয়নেও বড় ভূমিকা রাখছে বলে অনেকের অভিমত। শেষোক্ত ধারণাকে কেউ কেউ প্রশ্নবিদ্ধ করছেন এভাবে: ‘‘আসলেই কি পোশাকশিল্পের উন্নয়ন নারী উন্নয়নে সহায়তা রাখছে, নাকি নারীর সস্তা শ্রমই নারীর প্রতি মুনাফালোভীদের আকৃষ্ট করেছে?’’

প্রথাগত অর্থনীতিতে মুনাফা সৃষ্টিই হচ্ছে একমাত্র লক্ষ্য। সেই ধারায় নারী তার যোগ্যতা প্রমাণ করে শ্রমবাজারে গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করতে পেরেছে। প্রথম অবস্থায় ধরে নেওয়া যায়, এটা তাদের অবস্থানের একটা উত্তরণ। কারণ গৃহস্থালীর কাজ থেকে সরে এসে নারী গৃহের বাইরে ম্যাক্রো ইকোনমিতে (সামষ্টিক অর্থনীতি) ভূমিকা রাখছে। সেই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কোন মুনাফালোভী মালিক, নারী কিংবা যে কারো শ্রম সস্তা দামে কিনে শোষণ করছে কিনা সেটা দেখার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। নাগরিককে সেই নিরাপত্তা দিতে বিভিন্ন রাষ্ট্র শ্রম সম্পর্কিত নানা নীতিমালা প্রণয়ন করে।

আলোচনার শুরুতে মেনে নিতে হবে, ব্যবসার সাথে মুনাফার অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ককে। মুনাফা ব্যতিরেকে কোন দেশেই, কোনো কালেই কেউ ব্যবসা করেছে কিনা সন্দেহ আছে। কিন্তু প্রশ্নটা হলো, সেই মুনাফা লাভ করতে গিয়ে উদ্যোক্তারা কতোটুকু ব্যক্তির শ্রম-শোষণ করছে তার উপরে। তারও আগের প্রশ্ন, শ্রম-শোষণ আমরা কখন বলব? এর ব্যবহারিক সংজ্ঞাটা কি? উদ্যোক্তারা মানুষের জন্য কর্ম সংস্থান সৃষ্টি করেন নিজের মুনাফার জন্য। মানুষ তার শ্রমের বিনিময়ে মজুরি পায়। এই পর্যন্ত কারো দ্বিমত থাকার কথা নয়। কিন্তু উদ্যোক্তারা কাজের বিনিময়ে একজন শ্রমিকের মজুরি কতো দেবেন, সেটা নির্ধারণ করবেন কিসের ভিত্তিতে এবং তার দায়িত্ব কার ও কতোটুকু?

মানুষ তার প্রবণতা অনুযায়ী লভ্যাংশের যতোটা পারে নিজের ঘরে রাখার চেষ্টা করে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বিষয়টা আরো জটিল। কেননা এখানে প্রতিটা ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে দৃশ্যমান এবং অদৃশ্যমান খরচ আছে। দৃশ্যমান খরচটা অনেকেই কমবেশি জানেন, যেগুলো কারখানার রক্ষণাবেক্ষণ, কাঁচামাল সংগ্রহ, ট্যাক্স এবং অন্যান্য। অদৃশ্যমান খরচগুলো মানুষ আরো বেশি ভাল জানেন, বিশেষ করে উদ্যোক্তারা। কারখানা চালু করার আগে থেকেই, বিভিন্ন অফিসে ঘুষ। এরপরে চালু হয়ে গেলে পুলিশের চাঁদা, মাস্তানের চাঁদা আরো কতো কি! এই অদৃশ্য লেনদেনের একটা পরোক্ষ এবং প্রত্যক্ষ প্রভাব গিয়ে পড়ে শ্রমিকের ন্যায্য মজুরি র্নিধারণে। এই সুযোগে মুনাফাখোর ব্যবসায়ী বা শিল্প-মালিকেরা আরো বেশি অ-দৃশ্যমান খরচের ছুতো তুলে শ্রমিকের মজুরি নির্ধারণে বাধ সাধে।

সেক্ষেত্রে রাষ্ট্রের একটা কার্যকরি ভূমিকা থাকতে হয় উভয় পক্ষের স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য। আমাদের দেশে সরকারের এব্যাপারে ভূমিকা কতোটুকু? একটু ক্রিটিক্যালি দেখলে লক্ষ্য করা যাবে, সরকার কেন শ্রমিকের স্বার্থ দেখবে? সর্ষের ভিতরেই তো ভূত! পোশাকশিল্পের সংগে সরকার এবং বিরোধী দলের অনেক হোমড়া চোমড়া ব্যক্তি জড়িত। সেই সঙ্গে নির্বাচনের সময় ব্যবসায়ী এবং শিল্প-মালিকরা রাজনৈতিক দলগুলোকে একটা বিশাল অংকের চাঁদা দিয়ে থাকেন। দুশ্চিন্তার কারণ হচ্ছে, রাজনীতিতে রাজনীতিক কমে গিয়ে সেখানে মুনাফাখোর ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতিদের প্রাধান্য বাড়ছে। তারাই সংসদে গিয়ে আইন পাস করেন। সেই আইন কি তাদের স্বার্থের বাইরে যেতে পারে?

অন্যদিকে, শ্রমিকেরা পাঁচ বছর পরপর একটিমাত্র ভোট দিয়ে নেতাদের উপকৃত করে। সেই ভোটের ব্যবহারও একমুখি। অর্থাৎ যে কোনো একটি দলের একজনমাত্র প্রার্থীকে। কিন্তু কারখানার মালিক চাঁদা দেন উভয় দলকেই এবং এর বাইরে কখনো কখনো দলগুলোর প্রভাবশালী নেতাদেরও। এই বাস্তবতায় যে দলই ক্ষমতায় যাবে সে কার স্বার্থ দেখবে? আমাদের মানবাধিকারকর্মী বা এসবের নেতানেত্রীরাও সরকারের রোষানলে পড়ার ভয়ে সমস্যার মূল কারণগুলোকে এড়িয়ে গিয়ে এক তরফাভাবে মালিকপক্ষকে গালমন্দ করেন।

দেশের ভিতরে বিরাজমান সব ধরনের বৈষম্য কিংবা মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব সরকার এবং রাষ্ট্রের। নারী কিংবা যে কোনো নাগরিকের অধিকার কোনো ব্যক্তি কিংবা প্রতিষ্ঠানের করুণার উপরে নির্ভর করবে কেন? গ্রামীণফোনের প্রধান অংশীদার যে বিদেশি কোম্পানিটি নারীর গর্ভধারণের জন্য তাদের কর্মী ছাঁটাই প্রক্রিয়ায় গর্ভবতী নারীদেরও বেছে নেয়, নিজের দেশে সে এই কাজটি কখনোই করবে না। কারণ রাষ্ট্র তাকে রুখে দেবে। সেই একই কোম্পানি কেন আমাদের দেশে ঘৃণ্য কাজ করার সাহস পায়? কিংবা বিজিএমইর মতো একটা সংগঠনের নেতারা তেলতেলে স্বাস্থ্যের অধিকারী হয়েছেন যেসব মেয়ের শ্রমের বিনিময়ে, তারা কিভাবে পরিবার পরিকল্পনার দায়িত্ব নিজ হাতে নেবার স্পর্ধা দেখান? এইসব প্রশ্নের উত্তর একই, আর তা হলো নাগরিক অধিকার রক্ষায় রাষ্ট্রের নিথর অবস্থান।

পোশাকশিল্প নিয়ে অনেক নেতিবাচক খবরের বাইরে আরেকটি খবর হলো, এই শিল্প নাকি নারীশিক্ষার বিস্তারে অবদান রাখছে। কয়েক সপ্তাহ আগে একটা জাতীয় ইংরেজি দৈনিক পত্রিকায় এ সম্পর্কিত গবেষণার খবর ছাপায়। যেসময় এই রিপোর্টটি ছাপা হয় তখন সারাদেশে শ্রমিকদের আন্দোলন চলছিল। সেই পরিস্থিতিতে এই রিপোর্ট পরিবেশন করা কোনো উদ্দেশ্যপ্রণোদিত কিনা সেটাও ভাবার বিষয়। গবেষণা-পদ্ধতি এবং রিপোর্টের পুরোটা না পড়ে গভীর কোনো মন্তব্যে যাওয়া যাবে না। তবে এটুকু বলা যায়, সরকার মেয়েদের শিক্ষাকে উৎসাহিত করতে উপবৃত্তি দিচ্ছে। তাছাড়া ‘সময়’ মানুষের শিক্ষা সম্পর্কে ধারণা পাল্টে দিয়েছে। আধুনিক যোগাযোগ-ব্যবস্থা যেমন শহরের সাথে গ্রামের দূরত্ব কমিয়েছে, ঠিক তেমনি প্রযুক্তির আরো সব উন্নয়নের একটা প্রভাব আছে মানুষের জীবনে। শুধু পোশাকশিল্পের বিকাশ এর মাঝে নারীশিক্ষায় আসলেই কতোটুকু ভূমিকা রাখছে এই জটিল সামাজিক গণিতের সমাধান দেয়া দুষ্কর। তারপরেও তর্কের খাতিরে মেনে নিলেও পরের প্রশ্ন: এর পরে কি? অর্ধশিক্ষিত, অকারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত বেকার প্রজন্ম সৃষ্টি নাকি অন্য কিছু?

এমনিতে আমাদের দেশে স্কুল-কলেজে একবার পা দিলে পারতপক্ষে কেউ কায়িক শ্রম করতে চায় না। পোশাকশিল্পে কাজ করা অভিভাবকরা তাদের সন্তানদের যে মানের স্কুলে পাঠান সেখানে পড়ে তাদের পরবর্তী লক্ষ্য কি হবে? নিজের বাবা-মায়ের পেশাকে ঘৃণা করা? কাজের প্রতি শিক্ষিত-অশিক্ষিত নির্বিশেষে সামাজিকভাবে একটা উঁচু-নীচু ধারণা আছে। এমনকি আমাদের দেশের তথাকথিত কিছু শিক্ষিত ‘সাহেব’ কিংবা ‘বাবুকে’ প্রায়ই বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবাসে কর্মরত (বিশেষ করে স্থায়ীভাবে অভিবাসিত) মানুষের কায়িক পরিশ্রমকে কেন্দ্র করে তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করতে শোনা যায়। একে অবশ্য ‘আঙুর ফল টকের’ মতো পরশ্রীকাতরতা বলা যেতে পারে। কারণ অনেক মারকুটে, দাপুটে সরকারী উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ে চটকদার বক্তৃতা দেয়া প্রফেসরকে (অধিকাংশ লেকচারার। পরিচয়েও কেউ কেউ কপট) বৃত্তি নিয়ে এসে এখানে তাদের বিবেচনায় ‘ছোটকাজ’ করতে হয়। এইসব কর্মকর্তা কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টাররা রাস্তায় দাঁড়িয়ে গাড়ি মোছা থেকে শুরু করে মানুষের হাড়ি ধোয়ার কাজও করেন।

উপরের উদাহরণের মাধ্যমে মূল জায়গাটায় আসা যাবে। বিদেশে কেন মানুষ তথাকথিত ‘নিচু’ কাজ করতে পরোয়া করে না? এর দুটো কারণ থাকতে পারে। প্রথমত: কাজ সম্পর্কে আশরাফ-আতরাফ বিভাজনটা সেভাবে নেই। দ্বিতীয়ত: কাজের মাধ্যমে যে মজুরিটা মেলে তা দিয়ে ‘ভাল থাকা’ যায়। এই ‘ভাল থাকার’ উপরে নির্ভর করে সেই কাজ সম্পর্কে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গীটা কি রকম হবে। অর্থাৎ আখেরে সেই শ্রম-শোষণটাই চলে আসছে। আমাদের দেশে তথাকথিত ‘নিচু কাজগুলোতে’ই মূলত শ্রম-শোষণটা বেশি করা হয় বিধায় যে মজুরি মেলে তা দিয়ে ‘ভাল থাকা’ যায় না। তাই এ সমস্ত কাজ সম্পর্কে সৃষ্টি হয়েছে ‘ছোট কাজের’ ধারণা। সব নষ্টের গোড়া এই শ্রম-শোষণকে দূর করতে পারলে শ্রমিকদের রাস্তার আন্দোলন যেমন থেমে যাবে, ঠিক তেমনি একটু লেখাপড়া শিখে বাবা-মায়ের পেশাকে ঘৃণা না করে প্রয়োজন হলে সন্তানেরা সেই পেশায় ফিরে যেতে লজ্জাবোধ করবে না। শ্রম-শোষণ বন্ধ করে সমতাভিত্তিক সমাজের যাত্রাটা শুরু হবে কবে?

[email protected]
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।