ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

খোলা কলাম

সংসদ ও বিচার বিভাগের সংঘাত কাম্য নয়

আবদুল গাফ্‌ফার চৌধুরী, সাংবাদিক ও কলামিস্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৮ ঘণ্টা, আগস্ট ৬, ২০১২
সংসদ ও বিচার বিভাগের সংঘাত কাম্য নয়

বাংলাদেশে সংসদ ও বিচার বিভাগের মধ্যে সংঘাত সৃষ্টির আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল। রাষ্ট্রের দুটি স্তম্ভের মুখোমুখি হওয়ার বিষয়টি শেষ পর্যন্ত এড়ানো গেছে।

এটাকে আমি একটি দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা হিসেবে দেখছি। এটার জন্য কাউকে দোষারোপ করি না, জাতীয় সংসদকেও না এবং বিচার বিভাগকেও না। এটা দুজন মানুষের স্পিকার এবং আকস্মিক ব্যাপার। বিষয়টা ইতোমধ্যে মিটমাট হয়ে গেছে। স্পিকার রুলিং দিয়েছেন। চমৎকার রুলিং দিয়ে বলেছেন, আদালত সংসদকে অবমাননা করেনি। একজন ব্যক্তি বিশেষ কিছু মন্তব্য করেছেন। সেটা আমরা আমলে নিচ্ছি না। অন্যদিকে ওই বিচারপতিও এ প্রসঙ্গে তার বক্তব্য রেখেছেন। তাতে হয়তো স্পিকার সম্বন্ধে কিছু কথা ছিল, যা উনি এড়াতে পারতেন, তবে উনি আর বাড়াবাড়ি করেননি। ফলে গণতন্ত্রের শত্রুরা যেটা চেয়েছিল সংসদ এবং বিচার বিভাগের ভেতর সংঘাত হোক, গণতন্ত্র দুর্বল হোক, সেই আশঙ্কাটা কেটে গেছে।

আমার ধারণা, বাংলাদেশে যারা গণতন্ত্রকে অস্থিতিশীল করতে চায়, যে শক্তি `৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে বানচাল করতে চায়, তারা বিভিন্ন ইস্যু তৈরি করছে। তারাই এ ইস্যুটা সামনে নিয়ে এসেছিল। দেখা যাবে ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদের মতো লোক বিচারপতি সামসুদ্দিন মানিককে নিন্দা করতে এগিয়ে আসেননি। যারাই করেছে তারা সবাই একটা দলের, একটা মতের ছাপ মারা।

এটা বুঝতে অসুবিধা হয় না কারা এটাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে তুলছিল। তবে আমি বলব, আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন। মন্ত্রীদের তিনি এই বিতর্কে জড়িত হতে দেননি। স্পিকার নিজেও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। বিচারপতি সামসুদ্দিন চৌধুরীও বিচক্ষণতা দেখিয়েছেন। মতলববাজরা ইস্যুটাকে জাতীয় সংসদ এবং বিচার বিভাগের ভেতরে অধিকার এবং দায়িত্বের যে একটা পরিধি সেটার একাডেমিক বিতর্কের বাইরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছিল। এর ভেতরে একটা ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ আছে। এই ব্যক্তিগত প্রসঙ্গকে জাতীয় সংসদ এবং বিচার বিভাগের ক্ষমতা বিচারের মানদণ্ড না করে একটা ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে গণতন্ত্রকে আঘাত করার ষড়যন্ত্র হয়েছিল। তার প্রমাণ স্পিকার রুলিং দেওয়ার পরও বিষয়টিকে শেষ না করে এই বিলেতে এবং বাংলাদেশে সামসুদ্দিন চৌধুরীকে টার্গেট করে অপপ্রচার চালানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, তার বিলেতে অনেক বাড়ি আছে। তিনি জাতীয় সংসদ সদস্যদের দাঁড় করিয়ে রাখেন। এরকম বহু কথা আছে। আমি ব্যক্তিগতভাবে বিচারপতি সামসুদ্দিন চৌধুরীকে অনেক আগে থেকে চিনি। যখন তিনি এখানে ছাত্র তখন থেকেই চিনি। আমি বলব না যে তিনি দোষ-গুণের ঊর্ধ্বে। নিশ্চয়ই মানবিক দোষ তারও আছে। কিন্তু তার যে সাহস, ছাত্রাবস্থা থেকেই বাংলাদেশের সেক্যুলারিজম, জনগণের অধিকার রক্ষায় তার মধ্যে যে নিষ্ঠা আমি দেখেছি এবং বিচারপতি হিসেবে তিনি এ পর্যন্ত যা করেছেন তা বাংলাদেশের বিচার বিভাগের ইতিহাসে বিরল। আমি জানি না আর কোনো বিচারপতি জিয়াউর রহমানকে ঠাণ্ডা মাথার খুনি হিসেবে অভিহিত করতে পারতেন। আমি জানি না আর কেউ সপ্তম সংশোধনী বাতিল করতে পারতেন। জিয়াউর রহমান ও এরশাদের আমলের সব অবৈধ কাজগুলোকে অবমাননা করতে পারতেন। দেশে ফতোয়ার রাজনীতি শুরু হয়েছিল, ধরে নিয়ে ফতোয়া দিয়ে মেরে ফেলা হতো। সাতক্ষীরায় তো আবুল মনসুর আহমদ সাহেবের লেখা বই নিয়ে তাণ্ডব শুরু হয়েছিল। এগুলো ঠেকাতে বিচারপতি মানিক অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে এগিয়ে এসেছেন। তার জীবন হুমকির মুখে যেতে পারত, কিন্তু তিনি সাহস দেখিয়েছেন। সবাই জানেন পাকিস্তানে কী হয়েছে। কয়েকজন বিচারপতিকে মারা হয়েছে, এখানেও তাকে মরতে হতো যদি তারা সুযোগ পেত; কিন্তু সে সুযোগ তারা পায়নি। ব্যক্তি হিসেবে মানিকের ভুল-ত্রুটি থাকতেই পারে। তবে আমি বলব, তার বিরুদ্ধে এখানে একটা প্রোপাগান্ডা শুরু হয়েছে। স্পিকারের রুলিং দেওয়ার পরও যারা বিতর্ক জিইয়ে রেখেছে, বুঝতে হবে তারা স্বাধীন দেশের বিচার বিভাগ অথবা পার্লামেন্টের মর্যাদা সম্পর্কে উদাসীন। সবচেয়ে দুঃখের কথা যে, একজন বামপন্থি নেতা তিনি প্রথম বাংলাদেশের জাতীয় সংসদে বিচারপতি চৌধুরীর মন্তব্য সম্পর্কে প্রস্তাব আনেন।

আমি কয়েকদিন আগে শুনলাম তিনিও বিএনপি আমলে অবৈধভাবে বিতরণ করা হাতিরঝিল আর বেগুনবাড়ীর জমির একজন বেনিফিশিয়ারি। তিনি রাতে গিয়েছিলেন বিচারপতি চৌধুরীর কাছে। যাতে তাকে আদালতে কল করা না হয়। জাস্টিস চৌধুরী তাকে বলেছেন, আপনি কি অবৈধভাবে জমি নিয়েছেন? তিনি বললেন না, বৈধভাবে নিয়েছি। তাহলে আদালতে আসতে অসুবিধাটা কী? আওয়ামী লীগের যে প্রবীণ নেতা বিচারপতি চৌধুরীকে স্যাডিস্ট আখ্যা দিয়েছেন তার দুই ভাগ্নেকে বিচারপতি চৌধুরী দুর্নীতির মামলায় শাস্তি দিয়েছেন। কোনো অনুরোধ শুনেননি। তিনিও পার্লামেন্টের সুযোগ নিয়ে তাকে গালি দিয়েছেন। এরকম দেখলে দেখা যাবে ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম বলেছেন, এই একমাত্র বিচারপতি যিনি বাংলাদেশের আইনতন্ত্রকে আঘাত করেছেন এবং তারা অত্যন্ত পাওয়ারফুল। সেই পাওয়ারফুল অভিজাততন্ত্রে আঘাত দেওয়ার জন্যই বিচারপতি চৌধুরীর বিরুদ্ধে সব ভিমরুল একত্র হয়েছে। এটাই আমার মূল্যায়ন।

সংসদ এককভাবে তো সার্বভৌম হতে পারে না। গণতন্ত্রের ভিত্তি হচ্ছে বিচার বিভাগ, পার্লামেন্ট, সংবাদ মাধ্যম এবং নির্বাহী বিভাগ। এটা মিলে গণতন্ত্রের যে চারটি পা, কোনো একটি যদি ভেঙে যায় তাহলে আর তিনটি কিন্তু চেয়ারটাকে ধরে রাখতে পারে না। সুতরাং সংসদ যেমন সার্বভৌম তেমনি বিচার বিভাগও একদিক থেকে সার্বভৌম। বিচার বিভাগ ইচ্ছা করলে প্রধানমন্ত্রী বা রাষ্ট্রপতিকেও ফাঁসিয়ে দিতে পারেন। সেটা কিন্তু পার্লামেন্টও পারে; কিন্তু বিচার বিভাগ বা আদালতের মতো পারে না। যেমন- আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে করেছে আদালত। সম্প্রতি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীকে পদত্যাগে বাধ্য করেছে আদালত।

ইন্দিরা গান্ধীকে একবার শাস্তি দিয়েছিলেন আদালত। আদালতের একটা আলাদা জুডিশিয়াল ক্ষমতা আছে। পার্লামেন্টেরও আছে। এর ভেতরে সংঘাত বাঞ্ছনীয় নয়। তবুও মাঝে মাঝে সংঘাত হয়। যেমন আমাদের এখানে হয়েছে। এটা ঠিক, বিচারপতি চৌধুরী ও স্পিকারের মধ্যকার সংঘাত এড়ানো যেত। লক্ষ্য করলেই দেখবেন_ বিচারপতি মানিকের মন্তব্যের পর স্পিকার এটা নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলতে পারতেন। এটাকে সংসদে টেনে এনে মোশন করা, তারপর তাকে বরখাস্ত করার দাবি তোলা হয়েছে। বিচারপতির কাছে সুবিধা আদায় করতে গিয়ে যেসব এমপি ব্যর্থ হয়েছিলেন তারাই এসব দাবি তুলেছেন। তারা আওয়ামী লীগের এবং মহাজোটের সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও যে ভূমিকা নিয়েছেন তার সুবিধা নিয়েছে গণতন্ত্রের শত্রুরা। এ শত্রুরা মহাশক্তিশালী। এরা মসজিদ-মাদ্রাসা দখল করে সেখানে বসে আছে। বিরাট আইনজীবীও আছে তাদের সঙ্গে। এখন দেখা যাচ্ছে, তারা একাডেমিক বিতর্কে না গিয়ে, পার্লামেন্টের মর্যাদাহানি হয়েছে কি না সে বিবেচনায় না গিয়ে বিচারপতির লন্ডনে অনেক বাড়ি, অনেক টাকা করেছেন এসব নিয়ে নানা কথা বলছেন। আমি যখন `৭৪ সালে বিলেতে আসি তখন থেকে তাকে চিনি।

বিচারপতি সামসুদ্দিন চৌধুরী যখন বিলেতে ছাত্র তখন তার স্ত্রী জনমত পত্রিকায় টাইপ করে টাকা আয় করতেন। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর আমি যখন `বাংলার ডাক` বের করতাম তখন তিনি এসে দাঁড়িয়ে থাকতেন। আমাদের খবরের কাগজের কপি দিতাম। কপি নিয়ে তিনি স্ত্রীকে দিতেন এবং পত্রিকা বের করতেন। বাংলাদেশের জাতির পিতার আদর্শের প্রতি উনি কমিটেড লোক। তারপর তিনি ব্যারিস্টার হিসেবে নাম করেছেন। উনি ১৯৮২ সালে যোগদান করেন ইউকে এয়ারসে এবং কিছুদিনের মধ্যেই উনি ডেপুটি ডাইরেক্টর হন। মাইকেল বান্স অবসরগ্রহণ করার পরে ইউকে এসএর এক্টিং ডাইরেক্টর হয়েছিলেন। ১৯৮৮ সালের মধ্যেই উনি এখানে তিনটি বাড়িও করেছিলেন। উনার স্ত্রীর ক্যান্সার ছিল। তার তিনটি বাড়িই আমি দেখেছি। উনার স্ত্রী যে বাড়িতে মারা যান সেটি আহামরি কোনো বাড়ি ছিল না। যারা এগুলো প্রচার করছে এরকম বাড়ি তাদের সবার আছে। এই বাড়িগুলোর একটিও তিনি বিচারপতি হওয়ার পরে কেনেননি। লন্ডনে থাকার সময় তিনি হাজার হাজার টাকা কামিয়েছেন, জনমত পত্রিকার মালিকও হয়েছিলেন এবং আমি যখন কাগজ বের করি, তখন ওয়ান অব দ্য পার্টনার উনি ছিলেন। তিনি বাড়ি-গাড়ি আগেই করেছেন। বিচারপতি হওয়ার পরে করেছেন তা কিন্তু নয়। এগুলো নিয়ে যারা মিথ্যা প্রোপাগান্ডা করছে তারা ঠিক কথা বলছে না। উনি যদি পার্লামেন্টের মর্যাদাহানি করে থাকেন তাহলে কথা বলুন আপত্তি নেই। তা না করে তার ব্যক্তিগত চরিত্র নিয়ে পর্যালোচনা শুরু হয়েছে। এটা যারা করছে তারা সবাই এই অভিজাততন্ত্রের লোক। তারা মৌলবাদীদের লোক, তারা গণতন্ত্রের শত্রুদের লোক। তারা যদি আজ বিচারপতি চৌধুরীকে ঘায়েল করতে পারে কালকে আরেকজনকে করবে।

আগেই বলেছি বিচারপতি সামসুদ্দিন চৌধুরী ও স্পিকারের বিষয়টি ছিল আকস্মিক ব্যাপার। এটা দুজনের মধ্যেই মিটমাট করে দেওয়া দরকার ছিল। একাডেমিক আলোচনা মারফত পার্লামেন্টের কোথায় মর্যাদা, আদালতের কোথায় সীমাবদ্ধতা, সেটা দিয়ে আমাদের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা দরকার ছিল। তা না করে ডাইভার্ট করে ব্যাপারটাকে তারা নিয়ে যেতে চেয়েছে ব্যক্তিগত কোন্দলে, গণতন্ত্রবিরোধী ষড়যন্ত্রে, এমন অনেক সময় হয়েছে। বিচারপতি চৌধুরী লন্ডনে আসার পর তার ওপর হামলার চেষ্টা হয়েছিল। তিনি বেঁচে গেছেন। কারা হামলা করেছে, এটা বুঝতে আমার কোনো দেরি হয়নি। আমি কঠোরভাবে এই হামলার নিন্দা করি। আমার মনে হয়, আমাদের মিডিয়াগুলো যদি সতর্ক হয়, তাহলে তারা মিডিয়ার দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে প্রোপাগান্ডা চালাতে পারবে না। বুঝতে হবে আঘাতটা শুধু বিচারপতি চৌধুরীর বিরুদ্ধে নয়_ গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকতার বিরুদ্ধে। মানুষের দুটো হাতই সমান। যদি ডান হাত বাম হাতের চেয়ে বড় হয় তাহলে তো সমস্যা। আদালতের হাতও লম্বা, পার্লামেন্টের হাতও লম্বা এবং তাদের একটা পরিপূরক সম্পর্ক আছে। বাঁ হাত যেমন ডান হাতকে আঘাত করতে পারে না, তেমন ডান হাত বাম হাতকে আঘাত করতে পারে না। বিচারপতি চৌধুরীর বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে, বলা হয়েছে তিনি নিরপেক্ষ নন। অথচ তিনি যাদের আদালতে দাঁড় করিয়েছেন তাদের মধ্যে আওয়ামী লীগের মন্ত্রী, এমপি, সাবেক মন্ত্রী, এমপিও আছেন। সিটিং এমপিকেও দাঁড় করিয়েছেন। যারা জনগণের সম্পত্তি দখল করেছিল তিনি তাদের প্রশ্রয় দেননি। আগেকার বিচারপতিরা এটুকু করতে পারেননি। এ ব্যাপারে তিনি যদি একটা উদাহরণ সৃষ্টি করেন তাহলে অন্যায় কোথায়? সবচেয়ে বড় কথা জামায়াতের মীর কাসেমের মতো লোকের গায়ে কেউ হাত দিতে পারেনি। তাকে প্রথম আদালতে এনে দাঁড় করিয়েছেন সামসুদ্দিন চৌধুরী। তার কৃতিত্ব হচ্ছে তিনি ইচ্ছা করলেই অন্যদের মতো একটা অলস জীবনযাপন করতে পারতেন। তা না করে তিনি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এমন সব কাজ করছেন যেগুলো বিচার বিভাগের এখতিয়ারের ভেতর আছে; কিন্তু তারা কখনো প্রয়োগ করেননি। সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করেছে, বিচার বিভাগের কেউ কেউ তার সঙ্গে সহযোগিতা করেছেন। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হয়েছেন বিচারপতি সায়েম, বিচারপতি আহসান উল্লাহ চৌধুরী। বিচারপতি সামসুদ্দিন চৌধুরী তা করেননি। তিনি বরং জনগণের জন্য বিচার ব্যবস্থাকে সামনে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি কায়েমি স্বার্থের বিরুদ্ধে আঘাত করেছেন। মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক, ফতোয়াবাজ এবং ভূমিদস্যুরা সংঘবদ্ধ হয়েছেন এবং এদের শক্তিকে মূলধন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ঠেকাতে জামায়াতিরা দেশে-বিদেশে একত্রিত হয়েছে। বিচারপতি চৌধুরী হয়তো কোথাও কোথাও ২/১টা ভুল করে থাকতে পারেন, সেটাকে বড় করে তুলে, আমাদের ভেতরে যারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের লোক তারা শত্রু হিসেবে অবস্থান নিয়েছেন। এটা থেকে তাদের নিষ্ক্রান্ত হওয়া উচিত। আমি বিচারপতি সাহাবুদ্দিনকে আমার এক লেখায় লিখেছি, আপনি সাহসকে সতর্কতার সঙ্গে ব্যবহার করবেন। এত কষ্টে দেশটাকে স্বাধীন করে বঙ্গবন্ধুও ঘাতকদের হাত থেকে বাঁচতে পারেননি। আমার একান্ত আবেদন মিডিয়ার কাছে, আপনারা শত্রুপক্ষের এই বিশাল প্রোপাগান্ডা মেশিনের কবল থেকে মুক্ত হোন, তারপর একটা সিদ্ধান্ত নিন।

বঙ্গবন্ধু ঘাতকদের বিচারের ব্যাপারে বিচারপতি সামসুদ্দিন যখন বিচারক ছিলেন না তখন বিভিন্ন জায়গায় দৌড়ে গেছেন। এমন একজন বাঙালি নেই তাকে উনি ইমিগ্রেশনে সাহায্য করেননি। জেনারেল শওকত থেকে শুরু করে অনেককেই এখানে থাকার জন্য সাহায্য করেছেন। যে ব্যক্তির আজ প্রশংসিত হওয়ার কথা সেখানে তিনি নিন্দিত হচ্ছেন। নিন্দাকারীরা সঙ্গবদ্ধ হয়েছে। যারা বিচার বিভাগে বসে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের বিচার করার সময় বিব্রতবোধ করেছে তাদের বিরুদ্ধে তখন কোনো নিন্দা হয়নি। যে ভদ্রলোক সেই ঘাতকদের বিরুদ্ধে ভূমিকা নিয়েছেন এবং আজ একাত্তরের ঘাতকদের বিচারের ব্যাপারে যার নেপথ্য ভূমিকা রয়েছে তার সামান্য ভুল-ত্রুটিকে উপলক্ষ করে আমরা নাচানাচি করছি। কি লজ্জার কথা। আমি বিচারপতি সামসুদ্দিন চৌধুরীকে অবশ্যই বলব, আপনি সতর্ক হউন, আপনার ভুল-ত্রুটি থাকলে সেগুলো বিচারপতিসুলভ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পরিহার করুন এবং আরও সাহসের সঙ্গে আপনার দায়িত্ব পালন করুন। আমি তাকে অভিনন্দন জানাই। রাষ্ট্র তো একটা স্বয়ং ব্যাপার না, রাষ্ট্র অনেক কিছুর সমষ্টি। এ সমষ্টিগত ব্যাপারে পার্লামেন্ট এবং বিচার বিভাগকে সংঘর্ষে লিপ্ত হতে দেওয়া উচিত নয় এবং আমি শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানাব কারণ তার মন্ত্রীদের ভেতরে অনেক বেকুব মন্ত্রীও আছেন। যারা নানা রকম কথা বলে অহেতুক সমস্যা সৃষ্টি করেন। তার প্রবীণ সদস্যদের মধ্যেও এমন লোক আছেন যারা বিচারপতিকে সামান্য কারণে ইমপিচ করার জন্য রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত গড়িয়েছেন। রাষ্ট্রপতি সেখানে প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী এবং স্পিকারও প্রজ্ঞার পরিচয় দিয়েছেন। তারা ষড়যন্ত্রের ফাঁদে পা দেননি। আমরা যারা আমজনতা আছি আমাদেরও ওই ব্যাপারে সতর্ক থাকা এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তার ব্যাপারে সচেতন হওয়া উচিত।

আমার ধারণা যে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটা ব্যক্তিত্ব আছে। বিচারপতি সামসুদ্দিনও তার কাছের লোক, স্পিকার আবদুল হামিদও। আমার ধারণা, উনি নেপথ্য থেকে সংঘাতের দিকে যেতে দেননি। তার দলের ভেতরে যারা অন্তর্ঘাত সৃষ্টি করছে তিনি তাদের সাবধান করে দেন। অন্যদিকে আমাদের বিচার ব্যবস্থায় প্রধান বিচারপতি থেকে শুরু করে অন্য বিচারপতিরা সে সচেতনতা দেখিয়েছেন। তার জন্য তাদের অভিনন্দন জানাই।

* লন্ডনের বাংলা টিভিতে প্রচারিত খ্যাতনামা প্রবাসী সাংবাদিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সাক্ষাৎকার থেকে নেওয়া। , সৌজন্যে বাংলাদেশ প্রতিদিন

লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।