ইদানিং শুভ্রর সাথে প্রায়ই লাগিয়া যাইতেছে। ছেলেটা এইচএসসি-তে এত ভাল
ফলাফল করিয়াছে অথচ এখন কেমন একটা অনিশ্চয়তা! ছেলের জীবনের লক্ষ হইল একজন কম্পিউটার বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলী হইবে।
বিভাগে ভর্তি হওয়াই তাহার ধ্যান-জ্ঞান। কিন্তু এখন যে অবস্থা চলিতেছে
তাহাতে কী যে হইবে আর হইলেও কখন যে হইবে কিছুই বুঝিতে পারতেছি না। এইতো
গতকল্য রাতে খাবার টেবিলে এক প্রস্থ হইয়া গেল।
-আচ্ছা, বাবা গদীতে বসলে কি তোমাদের শিক্ষকদেরও লজ্জা-শরম, নীতিবোধ সব হারিয়ে
যায়?
আমি মনে মনে প্রমাদ গুণিলাম। এই আবার শুরু হইল। নিশ্চয়ই বুয়েটের উপাচার্য
আর উপ-উপাচার্যের ব্যাপারেই আবার কথা শুরু হইতে যাইতেছে। কথাটা না
শুনিবার ভাণ করিয়া একটা গলা খাকারি দিলাম। আগে গলা খাকারিতে কাজ হইত। এখন
আর হয় না। ছেলে বড় (লায়েক পড়িতে হইবে) হইয়াছে। সে পুনরায় একই প্রশ্ন
করিল, এবং এইবারে সম্পূরক মন্তব্যসহ।
-আচ্ছা, বাবা মানুষজন গদীতে বসলে কি লজ্জা-শরম সব হারিয়ে যায়? নাহলে
বুয়েটের এই অবস্থা হয়?
আমি বাধ্য হইয়া সতর্ক মন্তব্য করিলাম:
-সবকিছুই এতো সহজে বলিয়া দেয়া যায় না রে বাবা।
সতর্ক হইয়াও লাভ হইল বলিয়া মনে হইল না।
-ফলাফল পরিবর্তনের মত কাজ করার পর আর কী বাকী থাকে বাবা? তুমি তো তুখোড়
ছাত্রনেতা ছিলে...এখন যদি তোমাকে বলি যে তোমার ফার্স্ট ক্লাস আসলে একটু
অন্যভাবে পাওয়া...
মনে মনে বলিলাম, “খামোশ!” বাস্তবে অবশ্য একটি দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়াই শান্ত
থাকিলাম। এই একই ধারার বাক্যালাপ বাবা-ছেলের মাঝে গত কয়েক দিনে বেশ
কয়েকবারই হইয়া গিয়াছে। ফলাফল পরিবর্তনের প্রমাণ, অভন্তরীণ তদন্ত
প্রতিবেদন এইসব লইয়া আগেই ছেলের সাথে বিতর্কে পরাজিত হইয়াছি। মনে মনে
একাধিকবার ‘ছি ছি’-ও বলিয়াছি। মুখে অবশ্য এখনও বলিয়া উঠিতে পারি নাই। পরে
বুয়েট প্রশাসন কর্তৃক প্রদত্ত কিছু সাক্ষ্য-প্রমাণ বুয়েটের ওয়েবসাইটে
দেবার পর কিছুটা সুবিধাজনক অবস্থাতে ছিলাম। কিন্তু ছেলে আমার চোখে আঙ্গুল
দিয়ে দেখাইয়া দিয়াছে সাক্ষ্য-প্রমাণে প্রদত্ত রেজিস্ট্রেশনের কাগজ-
পত্রগুলোর কপিতেও বুয়েট প্রশাসন কীভাবে প্রতারণার আশ্রয় লইয়াছে। বুয়েটের
উপাচার্য কেমন করিয়া যে এই কর্মগুলো করিলেন বুঝিয়া উঠিতে পারিতেছি না।
বরাবরের মতই ভাবিয়া কোনো কূল কিনারা পাইবার আগেই পুত্রের কথায় চিন্তায়
আবার ছেদ পড়িল।
-বাবা, তোমাকে না কতবার করে অনুরোধ করলাম, তোমার নেত্রীর সাথে দেখা কর।
এই ব্যাপারে কিছু একটা তোমাকে করতেই হবে।
মনে মনে আবার প্রমাদ গুণিলাম। নেত্রীর সাথে এইসব ব্যাপারে কথা বলা যে এখন
আর আগের মতো সহজ নয়, তা এই দুধের শিশু কেমন করিয়া বুঝিবে। নেত্রীর আশেপাশে
এখন এক দুর্ভেদ্য বলয়। বঙ্গবন্ধুর নিকট যখন তখন যাওয়া যাইতো। যে কেউ
যাইতে পারিত। তিনি যদি আজ বাঁচিয়া থাকিতেন তাহলে বুয়েটের এই অবস্থা হইতোই
না। বুয়েট আর আমাদের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি তাঁর গভীর একটা টান ছিল।
তাঁর গভীর প্রজ্ঞার কথা স্মরণ করিতে গিয়াও, চিন্তায় আবার ছেদ পড়িল। ছেলে
নাছোড়বান্দা।
-বাবা, তুমি কি প্রধানমন্ত্রীর অ্যাপয়েন্টমেন্ট চেয়েছ?
-আচ্ছা বাবা, আমি চেষ্টা করিব। তুমি ঠিকমত পড়িতে থাক।
দীর্ঘশ্বাসটা চাপিয়াই গেলাম। বুয়েটের জন্য কিছু করা যাইবে কিনা জানি না।
তবে ভারতের আইআইটি-তে কম্পিউটার বিজ্ঞান পড়িবার খরচের ব্যাপারে এক্ষুণি
খোঁজ লইতে হইবে।
...
[পাদটীকাঃ শুভ্রকে আইআইটি-তে যেতে হবে না। বুয়েটের যে সংগ্রাম চলছে তা
অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের সংগ্রাম। আর অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায়ের
সংগ্রামে ন্যায়ের বিজয় সুনিশ্চিত এবং সময়ের ব্যাপার মাত্র! ]
(একটি সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে লিখিত)
লেখক: শিক্ষক, বুয়েট, ই-মেইলঃ [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ২০৩০ ঘণ্টা, আগস্ট ১৩, ২০১২
সম্পাদনা: রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর