ঢাকা, রবিবার, ২১ আশ্বিন ১৪৩১, ০৬ অক্টোবর ২০২৪, ০২ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

দেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় ও আমাদের লাভ-ক্ষতি

মাহরুফ চৌধুরী, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৪ ঘণ্টা, আগস্ট ১৩, ২০১২

সম্প্রতি সরকার বাংলাদেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা খোলার আনুমতি দিতে ‘বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা বিধিমালা প্রণয়ন কমিটি’ গঠন করেছে। বাংলাদেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার অনুমতি প্রদানের উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হচ্ছে যে, দেশে বিদ্যমান বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে প্রতিযোগিতা সৃষ্টি ও উচ্চশিক্ষার মানবৃদ্ধির জন্য নাকি এটা জরুরি।

এ লক্ষ্যে বাংলাদেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য একটি বিধিমালা প্রণয়ন করতে ইউনিভার্সিটি অব এশিয়া প্যাসিফিকের উপাচার্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে ১০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এ কমিটি ‘বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-২০১০’-এর আলোকে বিধিমালা তৈরি করবে বলে বলা হয়েছে।

যাই হোক, সরকার উচ্চশিক্ষার মানবৃদ্ধি ও প্রতিযোগিতা সৃষ্টির লক্ষ্যে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাংলাদেশে তাদের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ করে দিতে বিধিমালা প্রণয়ন করছে বলে শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে (যায়যায়দিন, ০৭.০৬.২০১২)।

খবরে প্রকাশ, গত ৬ জুন ২০১২ তারিখে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের সভাপতিত্বে শিক্ষা মন্ত্রণালয় সম্মেলনকক্ষে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বাংলাদেশে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাসংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের উদ্দেশ্যে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বাংলাদেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাসংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়ন বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়। স্বয়ংসম্পূর্ণ বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করাসহ আনুষঙ্গিক সব বিষয় বিবেচনায় রেখে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনাসংক্রান্ত বিধিমালা প্রণয়নের জন্য অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরীকে আহ্বায়ক করে ১০ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়।

কমিটির অন্যান্য সদস্যরা হলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটির পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আনোয়ার হোসেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য প্রাণ গোপাল দত্ত, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি মো. আব্দুল মান্নান আকন্দ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির সভাপতি সিএম শফি সামি, বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য আতফুল হাই শিবলী ও আইন মন্ত্রণালয়ের প্রতিনিধি। এছাড়া শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কাজী সালাউদ্দিন আকবর কমিটির সদস্য সচিব। কমিটিকে গত ৫ জুলাইয়ের মধ্যে খসড়া বিধিমালা উপস্থাপন করার জন্য বলা হয়েছিল। কমিটি হয়তো খসড়াও জমা দিয়েছে, কিন্তু এবিষয়ে জনসম্মুখে এখনো কিছুই প্রকাশ করা হয়নি।

যদিও আমরা এই বিধিমালা সম্পর্কে কিছুই জানি না, তবু প্রাথমিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে বলতে চায় যে, দেশের উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থাকে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর হাতে তুলে দেয়া হবে আমাদের দেশের মতো একটি স্বাধীন দেশের জন্য আত্মঘাতী।

সে যাই হোক, এখানে এবিষয়ে আমি আমার মতামত তুলে ধরতে চেষ্টা করছি। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এদেশে নির্ঘাত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রেণিভুক্ত হবে। তাই আমার প্রথম প্রশ্ন হলো, আমরা যেখানে আমাদের সদ্য প্রতিষ্ঠিত বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারছি না, আমরা কীভাব বাংলাদেশে পরিচালিত বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নিয়ন্ত্রণ করব? তাছাড়া আমার দ্বিতীয় প্রশ্ন হলো, উচ্চশিক্ষার মান উন্নয়নের ও প্রতিযোগিতা সৃষ্টির জন্য কেন আমাদের বিদেশি বিশ্ববিদ্যায়গুলোকে আমন্ত্রণ জানাতে হবে? আমাদের দেশের বেসরকারি ও সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যেই তো প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে সেটা করা সম্ভব। আর দৃষ্টিগোচর না হলেও প্রচ্ছন্নভাবে গত কয়েক বছরের মধ্যে আমাদের সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে যে প্রতিযোগিতা গড়ে উঠছে তাকে অস্বীকার করার কোনো অবকাশ নেই। তাছাড়া সদ্যপ্রতিষ্ঠিত ও ক্রমবিকাশমান আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বিকশিত হওয়ার সুযোগ দেওয়া জরুরি।

বাংলাদেশের মতো ব্যাপক জনসংখ্যায় ভারাক্রান্ত একটা দেশের পক্ষে রাতারাতি কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন সম্ভব নয়। শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন উচ্চশিক্ষায় প্রতিভাবানদের জায়গা করে দেওয়া, উন্নত শিক্ষাক্রম ও উন্নত শিক্ষাপদ্ধতির প্রচলন এবং উন্নত শিক্ষাউপকরণ ব্যবহার করা। আর এটা সর্বজনবিদিত যে, আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে প্রতিভাবানদের স্থান করে দিতে সরকার ব্যর্থ হচ্ছে শিক্ষাব্যবস্থায় সরকারের নানারকম রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের কারণে।

যাই হোক, বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে বাংলাদেশে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেওয়ার আগে আমাদের লাভ-ক্ষতির অংকটা ভালোভাবেই কষে দেখা উচিত। নচেত একটি সুযোগ সন্ধানী ও সুবিধাভোগী গোষ্ঠীর প্ররোচনায় দেশের যে ক্ষতি হবে তার দায়ভার নিতে হবে বর্তমান সরকারকে। অতএব, সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার আগে আমরা সরকারকে নিচে আলোচিত বিষয়গুলো পর্যালোচনা করে দেখার অনুরোধ জানাচ্ছি।

প্রথমত, আমরা যদি এবিষয়টাকে অর্থনৈতিক মানদণ্ডে দেখি, তাহলেও বাংলাদেশকে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজার হিসেবে ছেড়ে দিলে আমাদের বিশাল ক্ষতি হয়ে যাবে। আর এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠা আমাদের মতো একটা স্বল্প আয়ের দেশের পক্ষে সম্ভব হবে না। আমাদের দেশে যখন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হতে শুরু করে তখন বিদেশগামী শিক্ষার্থীদের স্রোতে ব্যাপক ভাটা পড়ে। বাংলাদেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আগে মূলত শিক্ষার্থীরা পার্শ্ববতী রাষ্ট্র ভারতসহ যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ায় নিজস্ব অর্থায়নে উচ্চশিক্ষার জন্য যেত। এসব শিক্ষার্থীদের মাধ্যমে একটা বিরাট অংকের টাকা বিদেশে চলে যেত। দেশে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুবাধে দেশের বিপুল অংকের টাকা বিদেশে যাওয়ার হাত থেকে রেহায় পায়। কিন্তু এখন যদি বাংলাদেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়কে শাখা খোলার অনুমতি দেওয়া হয়, তবে অবাক হব না ভারতের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোসহ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক নামসর্বস্ব বিশ্ববিদ্যালয়গুলো এই সুযোগকে লুফে নিলে এবং এব্যবস্থা শিক্ষার বেসরকারিকরণের মাধ্যমে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাকে বাজার অর্থনীতির পণ্যে পরিণত করবে। বস্তুত, আমাদের দেশেরই এক শ্রেণির সুযোগ সন্ধানীরা সেই সুযোগকে কাজে লাগাবে এবং শিক্ষাবাণিজ্যের জন্য নব্য-উপনিবেশবাদীদের স্বাগত জানাবে।

আমরা যদি এবিষয়টিকে অর্থনৈতিক মানদণ্ডে বিবেচনা করে দেখি তবে সহজে বিষয়টি অনুধাবন করা সম্ভব। আমাদের দেশের প্রবাসীদের পাঠানো রেমিটেন্সই আমাদের দেশের বৈদেশিক আয়ের প্রধান উৎস হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেই ক্ষেত্রে আমরা যদি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে আমাদের দেশে অবাধে শিক্ষা-ব্যবসা পরিচালনার সুযোগ দেই তবে তারা শিক্ষা বাণিজ্যের মাধ্যমে আমাদের বিপুল অর্থ বিদেশে নিয়ে যাবে। তখন আমাদের অর্থনৈতিক অবস্থা কিরূপ দাঁড়াবে সেটা আমাদের অর্থনীতিবিদেরা ও প্রজাতন্ত্রের কর্ণধারেরা এখনই ভাবা উচিত।

দ্বিতীয়ত, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে যে সব বিদেশি শিক্ষক কাজ করবেন তারা সেই সব বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বনামধন্য শিক্ষকেরা নন যাদের জন্য সেই সব বিশ্ববিদ্যালয় আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়োগ দেওয়া হবে তাদেরই যাদের সেইসব বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ নিজেদের ক্যাম্পাসে জায়গা দিতে চাইবে না কোনো মতে। অর্থের প্রয়োজনেই তারা নিয়োগ দেবে সেই সব বিদেশিদের তাদের বাংলাদেশি ক্যাম্পাসে। শুধু ইংরেজি ভাষা জানা ও বিদেশি হওয়ার কল্যাণেই তারা পার পেয়ে যাব এবং শিক্ষা কার্যক্রমে সম্পৃক্ত হবে। তাই এসব শাখায় ‘বিদেশি ডিগ্রি’র নামে যেসব মাকাল ফল বিক্রয় হবে তা আমাদের দেশ ও সংস্কৃতির জন্য কি পরিণাম বয়ে আনবে তা আমাদের সমাজবিজ্ঞানী ও রাজনীতিবিদেরা এখনই বিশ্লেষণ করে দেখা উচিত।

তৃতীয়ত, আমাদের দেশে যেসব বিদেশি কাজ করেন, আমরা কি তাদের কাছ থেকে কোনো আয়কর পায়? এবিষয়ে আমরা কোনো জ্ঞান নেই। যদি পেয়ে থাকি, কতটুকু পাই? আমাদের আয়কর কর্মকর্তারা কি বিষয়টা খতিয়ে দেখবেন? আর আমরা যারা বিদেশে চাকরি করি তাদের আয়করের টাকা কেটেই বেতন প্রদান করা হয়ে থাকে। তাছাড়া এসব শিক্ষক-কর্মচারীরা যদি সেসব দেশের হন, যেসব দেশের সাথে আমাদের দেশের আয়কর বিষয়ক চুক্তি আছে, তাহলে তো তারা তাদের দেশে আয়কর প্রদান করবে এবং আমাদের দেশে তাদের কোনো কর প্রদান করতে হবে না। ফলে আমরা হারাব তাদের আয়করের সম্পূর্ণটাই যারা এদেশে বসবাসের কল্যাণে তুলনামূলক স্বল্প জীবনযাত্রার ব্যয় বহন করবে। তাহলে এক্ষেত্রে বিষয়টা দাঁড়াচ্ছে ইউরোপসহ পাশ্চাত্যের যেসব দেশে বাংলাদেশিরা কাজ করছে তাদের সেসব দেশেই আয়কর প্রদান করতে হচ্ছে। আর ইউরোপসহ পাশ্চাত্যের দেশসমূহের যেসব নাগরিকেরা বাংলাদেশে কাজ করছেন তারা তাদের নিজ নিজ দেশই আয়কর প্রদান করছেন। এভাবে আমাদের দেশ যে বিরাট অংকের আয়কর হতে বঞ্চিত হচ্ছে এবিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনার মধ্যে দিয়ে দেশ থেকে চলে যাবে বিরাট অংকের বৈদেশিক মুদ্রা। আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্র পরিচালনাকারী সরকার কি বিষয়টা বিবেচনায় নিয়েই এ আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছে?

চতুর্থত, আমাদের সংস্কৃতির একটি আত্মঘাতী উপাদান হলো- আমরা আমাদের কোনো কিছুকেই ভালো মনে করি না। আমাদের ঔপনিবেশিক মানসিকতার উত্তরাধিকার হলো হীনম্মন্যতা, যা আমাদের রক্তমাংসে মিশে আছে। আমরা বিশ্বাস করতে শিখেছি যে বিদেশি সব কিছুই ভালো, বিদেশি জিনিসই শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার। বিভিন্ন পালা পার্বণে আমরা বাঙালি সংস্কৃতির কথা বলতে পাগলপ্রায় এবং দিগ্বিক জ্ঞানশূন্য। অথচ বাঙালি সংস্কৃতির উত্তরাধিকার সংরক্ষণে আমাদের কোনো প্রচেষ্টাই নেই। যখনই আমাদের পকেটে বিদেশি টাকা পড়ে তখনই আমরা বিদেশিদের জয়গানে মুখর হয়ে উঠি। তাইতো নীরদচন্দ্র চৌধুরী আমাদের বলেছেন ‘আত্মঘাতী বাঙালি’। আমাদের মনোজাগতিক দৈন্যদশা থেকে বের হয়ে আসা উচিত। বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের কাছ জনগণের প্রত্যাশা অনেক এবং দেশবাসী আশা করে দেশের সিংহভাগ মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার যেন প্রতিফলন ঘটে সরকারের প্রতিটি সিদ্ধান্তে।

সে যাই হোক, সরকারের মনে রাখা উচিত যে দেশের জনতার আদালতে একদিন তাদের গৃহীত পদক্ষেপগুলো পর্যালোচিত হবে। বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আমাদের দেশে আসবে অর্থের জন্য আমাদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সংস্কৃতিক মুক্তির জন্য নয়; প্রকারান্তে বিজাতীয় চিন্তাধারা ও মূল্যবোধের সংক্রমণে। আমাদের সমাজ বিজ্ঞানীরা বিষয়গুলো এখনই ভেবে দেখবেন, নচেত জাতিকে চরম মূল্য দিতে হবে।

পরিশেষে বলতে চাই, আমাদের দেশে বেড়ে উঠা নতুন প্রজন্মের নাগরিকেরা, যারা এসব বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পড়বে দেশের ইতিহাস-ঐতিহ্য-সংস্কৃতির সাথে ক্রমাগত তাদের দূরত্ব বেড়ে যাবে। যেটা এখনই দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশে পরিচালিত ইংরেজি মাধ্যমের বিদ্যালয়গুলোর শিক্ষার্থীদের মধ্যে। তাছাড়া শিক্ষাক্ষেত্রে আমরা যে অহরহ বৈষম্য তৈরি করে চলেছি, বাংলাদেশে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম পরিচালনার সুযোগ সৃষ্টি সেটাকে আরো একধাপ এগিয়ে নেবে এবং নিম্নবিত্ত পরিবারের সন্তানদের জন্য সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিকভাবে বঞ্চনার সৃষ্টি করবে।

অপর দিকে, আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর রাজনৈতিক হাঙ্গামা আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর বেড়ে উঠার সংগ্রামের ফাঁকে এসব বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয় লুফে নেবে উচ্চশিক্ষার বিশাল বাংলাদেশি বাজার। তখন এসব সরকারি আর বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যরা আর অধ্যাপকেরা ঘুরে বেড়াবেন শিক্ষার সওদা নিয়ে কিংবা উপদেষ্টা আর পরামর্শক হওয়ার ধান্দায়- সেদিন হয়ত বেশি দূরে নেই। অবাক করা বিষয় হলো, কমিটিতে সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েক জন উপাচার্য রয়েছেন। তাঁরা কীভাবে এমন একটি কমিটিতে কাজ করেন যেটা সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য হবে চরম ক্ষতিকর পদক্ষেপ!

তাছাড়া আমাদের বর্তমান শিক্ষামন্ত্রী একজন সমাজবাদী রাজনৈতিক মতবাদে বিশ্বাসী, যিনি বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থাকে গণমুখী করার অঙ্গীকারাবদ্ধ। তিনি কীভাবে শিক্ষার এমন ব্যাপক বাণিজ্যিকিকরণের সনদ দানে ব্যস্ত হয়ে পড়েছেন অনেকের মতই আমার বোধগম্য নয়। আমরা আশা করব, এবিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে সরকার জাতীয় শিক্ষানীতির মতোই এ বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে আলোচনা-পর্যালোচনার ব্যবস্থা করবে, খতিয়ে দেখবে এর উপযোগিতা। জাতীয় স্বার্থকে উপেক্ষা করে কোনো বিচার বিবেচনা ছাড়াই হুট করে বিশেষ একশ্রেণির মানুষের প্ররোচনায় দেশের সর্বনাশ করতে এবং বিশেষ একশ্রেণির মানুষের জন্য সুযোগ সৃষ্টি করতে সরকারের এধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা উচিত।

আমরা আশা করব, বর্তমান সরকার সুবিবেচনার পরিচয় দিয়ে বিষয়টি জনসমক্ষে তুলে ধরবে যাতে করে গণতান্ত্রিক পন্থায় আলোচনা-সমালোচনা আর পর্যালোচনা মধ্যে দিয়ে এবিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করার পথ অবারিত হয়।

লেখক: গবেষক, ওপেন ইউনিভার্সিটি, যুক্তরাজ্য।
Email: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৪০৬ ঘণ্টা, আগস্ট ১৩, ২০১২
সম্পাদনা: রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।