ঢাকা, রবিবার, ৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মুক্তমত

জ্বলছে রাখাইন, নির্বিকার বিশ্ববিবেক

ফারুক যোশী, অতিথি লেখক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৭ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০১২
জ্বলছে রাখাইন, নির্বিকার বিশ্ববিবেক

শিশুটির কী দোষ,  ক’জন মানুষরূপী পশু শিশুটাকে বেঁধে ফেলে, তারপর কোপ মারে। শিশুটি নিস্তেজ হয়ে যায়।

এই মানুষরূপী জানোয়াররাই আবার ধর্ষণে মেতে ওঠে। রোহিঙ্গা কিশোরী-তরুণীদের ধরে ধরে এনে ধর্ষণ করে, তারপর একসময় তাদের হত্যা করে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিচ্ছে দুর্বত্তরা, মেতে উঠছে হত্যাসহ সব নির্মম পাশবিকতায়। জ্বলছে মিয়ানমারের রাখাইন, উগ্র গৌতম বুদ্ধের অনুসারীদের লেলিয়ে দিয়েছে সরকার। ধর্মের উন্মাদনায় এরা হত্যা করছে মুসলিম শিশু, ধর্ষণ করছে নারী, জ্বালাচ্ছে মুসলিম রোহিঙ্গাদের গ্রাম একের পর এক। এই হলো এখন মিয়ানমার কিংবা বার্মা।

নোবেল পাওয়া অং সান সু চি ব্রিটেন ঘুরে গেলেন মাত্র মাস দুয়েক আগে। অবিশ্বাস্য সম্মান পেয়েছেন তিনি ব্রিটেনের পক্ষ থেকে। চলতি বছর সেপ্টেম্বরে তিনি গ্রহণ করবেন যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদক। কিন্তু থেকে থেকে জ্বলে ওঠা রাখাইন কিংবা রোহিঙ্গা নিয়ে কোনো কথা নেই তার।

শান্তিতে নোবেল পাওয়া অং সান সু চির দেশ রক্তপাত আর হত্যায় উত্তাল অথচ তার নেই কোনো উদ্যোগ। গত তিন মাস ধরে প্রতিদিন মানুষ খুন হচ্ছে, সরকারের ছত্রছায়ায়। এদের প্রায় সবাই-ই মুসলমান। লাখো মানুষ এখন বাড়িছাড়া। খাদ্য নেই পানীয় নেই, নেই ওষুধ। এরা এখন উদ্বাস্তু। অথচ ইতিহাস সাক্ষী, প্রায় ১২শত বছর ধরে রোহিঙ্গারা বাস করছে আজকের মিয়ানমারে।

সবকিছুই ছিল ঠিকঠাক। ১৯৬২ সালে মিয়ানমারে সামরিক জান্তা আসার পর থেকে রোহিঙ্গাদের ওপর নেমে আসে খড়গ। পাল্টে যায় সবকিছু। তারা হয়ে যায় উদ্বাস্তু। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এখানে বেড়ে উঠছে। অথচ এখনও আট লাখ রোহিঙ্গার নেই রাষ্ট্রীয় পরিচয়। এরা এই রাষ্ট্রের নাগরিক নয়। এই অ-নাগরিকের ধুয়া তুলেই সময়ে সময়ে রাখাইন রাজ্য জ্বলে উঠছে। ধর্মীয় আবেগকে ব্যবহার করছে রাষ্ট্র। রাজনীতির গুটি চালাচালিতে দিনের পর দিন নিঃস্ব হচ্ছে মানুষ।

লাখো রোহিঙ্গার জায়গা হবে কোথায়? বাংলাদেশ সঙ্গত কারণেই চাপ বাড়াতে চায় না, নতুন রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে। এমনিতেই এর আগের কয়েক লাখ রোহিঙ্গা নিয়ে বাংলাদেশ চাপের মুখে। তার ওপর আরও রোহিঙ্গার দায় নিতে চাইছে না বাংলাদেশ সরকার। কিন্তু মানবতার প্রশ্ন উঠেছে। পশ্চিমা বিশ্ব আঙ্গুল তুলছে বাংলাদেশের দিকে। পশ্চিমাদের কথা-বার্তায় মনে হ,য় এ যেন বাংলাদেশের সৃষ্ট সমস্যা। সমাধান করতে হবে বাংলাদেশকেই। কী আশ্চর্য, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ব্রিটেন সফরে শতাধিক রোহিঙ্গা প্রধানমন্ত্রীর আবাসস্থলের বাইরে বিক্ষোভ করেছে। অথচ জাতিসংঘ আছে। বিশ্বশান্তির মিশন আছে। না, সব দায় যেন বাংলাদেশের। অথচ কি অদ্ভুত! আমরা প্রতিদিন খবর দেখি সিরিয়ার বিদ্রোহীদের কয়জন মারা যাচ্ছে, মানবতা কীভাবে বিঘ্নিত হচ্ছে সেখানে। তা-ই আমাদের দেখতে হয় প্রতিদিন ব্রিটেনে বসে। সিরিয়ার রাষ্ট্রীয় সমস্যায় ঠিকই মিলিয়ন মিলিয়ন পাউন্ড ঘোষিত হচ্ছে। আমাদের অভিযোগ নেই, বিশ্ব রাজনীতিতে ক্ষমতায় টিকে থাকার এ চেষ্টা হয়ত চলতেই থাকবে। কিন্তু মানবতার নাম নেওয়া পশ্চিমা দেশগুলোর গণমাধ্যম অন্ধ হয়ে গেছে। মিয়ানমারের হাজার মানুষের প্রাণহানি কোনো দাগ কাটছে না পশ্চিমা মিডিয়ায়। টিভিতে নেই মিয়ানমার, পত্রিকায় নেই মিয়ানমার। আলোচনায়ও নেই রোহিঙ্গা মুসলিম!

মুসলিম দেশগুলো কিছুটা হলেও মাথা চাড়া দিয়ে উঠেছে। সৌদি আরব প্রতিবাদ জানাচ্ছে। বাদশাহ আব্দুল্লাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভা থেকে প্রতিবাদ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে আন্তর্জাতিক মোড়লদের এ ব্যাপারে উদ্যোগী হয়ে মুসলিম রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা দাবী করা হয়েছে। রাখাইন আর মিয়ানমারের এই হত্যাযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করতে সৌদিভিত্তিক মুসলিম বৃহত্তম সংগঠন ওআইসি প্রতিনিধিদল পাঠাতে প্রস্তাব করেছে। তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইতিমধ্যে মিয়ানমার ঘুরে এসেছেন। তার রিপোর্টের পর মিয়ানমার প্রেসিডেন্ট থেইন সেইন ওআইসির সেক্রেটারিকে খুব শিগগিরই তার দেশে আমন্ত্রণ জানাতে পারেন। কিন্তু ততদিনে যা হবার হয়ে গেছে। লাখ লাখ মানুষ গৃহহারা। বহু মানুষ নিহত হয়েছে। অসহায় পড়ে আছে শত শত মা-বাপহীন এতিম শিশু-কিশোর আর কিশোরী। কোথায় মানবতা? কোথায় আন্তর্জাতিক সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলো? কোথায় বিশ্বশান্তির ডামাডোল?

এখন সময় এসেছে পশ্চিমের মিডিয়াকে চাপ প্রয়োগের। মিডিয়া ঘুরিয়ে দিতে পারে সব। এই মিডিয়াই পারবে লাখো-কোটি মানুষের চোখ ফেরাতে মিয়ানমারের দিকে। একযুগের বেশি পশ্চিমের এই দেশে (ইংল্যান্ড) অবস্থানের পর এ এক বিশ্বাস আমার হয়েছে: পশ্চিমের দেশের সাধারণ মানুষ মানবতার প্রয়োজনে শোক-যন্ত্রণায় কাতর হয়, যে কোনো চ্যারিটিতে মিলিওন মিলিয়ন পাউন্ড একদিনে তারা তুলে দিতে পারে। যার প্রমাণ প্রতিবছরের একটি দিনে ‘চিলড্রেন অ্যান্ড নিড প্রোগ্রামে’ মানুষের অনুদান। সুতরাং আজ সময় এসেছে মানবতার কথা বলার। শুধু মুসলমান নয়, পৃথিবীর অগণিত মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। পশ্চিমের গনমাধ্যমগুলোকে চাপ সৃষ্টি করতে হবে। মানবতাকামী সব মানুষকে আজ বলতে হবে জাতি আর সম্প্রদায় নয়, মানবিক বোধ থেকেই উচ্চারণ করতে হবে মিয়ানমারে শান্তির কথা, হত্যাযজ্ঞ বন্ধের কথা। একই সাথে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকেই আট লাখ রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব নিশ্চিত করার বিষয়টি নিয়েও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে হবে। এ দাবি শুধু মুসলমানদের নয়, এ এক আবেদন মানবতার। সারা পৃথিবীর।

ফারুক যোশী: যুক্তরাজ্যপ্রবাসী সাংবাদিক ও কলামিস্ট
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১২৩৫ ঘণ্টা, আগস্ট ১৫, ২০১২
সম্পাদনা: রানা রায়হান, অ্যাসিসট্যান্ট আউটপুট এডিটর; জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর  [email protected]

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।