ঢাকা, শুক্রবার, ১৭ কার্তিক ১৪৩১, ০১ নভেম্বর ২০২৪, ২৮ রবিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনে বাংলাদেশের পথচলা

মো. জহিরুল ইসলাম | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০০৬ ঘণ্টা, মে ১৬, ২০২৪
সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনে বাংলাদেশের পথচলা ...

পৃথিবীর অন্তত ১৪০টি দেশ তাদের সংবিধানের মাধ্যমে স্বাস্থ্যকে মানবাধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এসব দেশের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম।

বাংলাদেশের সংবিধানের ১৫ অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রকে জনগণের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করার জন্য বলা হয়েছে এবং স্বাস্থ্যসেবাকে জীবনধারণের মৌলিক উপাদান হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।  

কিন্তু সংবিধান গৃহীত হওয়ার ৫২ বছর পরেও বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ সম্পূর্ণরূপে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবার আওতায় আসেনি। তাই সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা দেশের প্রতিটি নাগরিককে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবার আওতায় আনার একটি ভাল কৌশল হতে পারে।

সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা ১৯৪৮ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রণীত সংবিধানের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত, যা স্বাস্থ্যকে একটি মৌলিক মানবাধিকার হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে এবং সকল ব্যক্তির জন্য স্বাস্থ্যের সর্বোচ্চ মানের নিশ্চয়তা দেওয়ার অঙ্গীকার করে।  

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবাকে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের অন্যতম কৌশল হিসেবে তুলে এনেছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য ৩.৮ এ সকলের জন্য অসুস্থতাজনিত আর্থিক ঝুঁকিতে নিরাপত্তা, মানসম্মত অপরিহার্য স্বাস্থ্যসেবা এবং সাশ্রয়ী মূল্যে নিরাপদ, কার্যকর, মানসম্মত আবশ্যক ঔষধ ও টিকা সুবিধাপ্রাপ্তির পথ সুগম করাসহ সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের লক্ষ্য অর্জন করার কথা বলা হয়েছে। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার দুটি মূল উপাদান হলো: সকলের জন্য প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্য পরিষেবা নিশ্চিত করা এবং অসুস্থতাজনিত আর্থিক ঝুঁকি হতে সুরক্ষা দেওয়া।  

বাংলাদেশ ২০৩২ সালের মধ্যে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনের জন্য প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অন্তর্ভুক্তি সূচকে ২০২১ সালে বাংলাদেশ ১০০ তে পেয়েছিল ৫২। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এ সূচকে বাংলাদেশের নিচে অবস্থান শুধুমাত্র পাকিস্তান ও আফগানিস্তানের। যা আমাদেরকে বাংলাদেশে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবার অবস্থা নিয়ে ভাবতে বাধ্য করে।  

দক্ষিণ এশিয়ার যেকোন দেশের মধ্যে বাংলাদেশের নাগরিকরা স্বাস্থ্যসেবার জন্য নিজেদের পকেট থেকে সবচেয়ে বেশি টাকা খরচ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রাক্কলন অনুসারে দেশের জনসংখ্যার প্রায় ২৫ শতাংশ স্বাস্থ্যসেবা খরচের কারণে বিপর্যস্ত। প্রতি বছর উল্লেখযোগ্যসংখ্যক মানুষ স্বাস্থ্যসেবার খরচ মিটাতে গিয়ে নিঃস্ব হচ্ছে।  

২০২২ সালে বাংলাদেশের জিডিপির বার্ষিক বৃদ্ধির হার ছিল ৭.১ শতাংশ। বাংলাদেশের এমন চমকপ্রদ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি সত্ত্বেও দেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত দীর্ঘদিন ধরে তহবিলের অভাবে ভুগছে।  ২০২০ সালে বাংলাদেশ ন্যাশনাল হেলথ অ্যাকাউন্টস (বিএনএইচএ) ১৯৯৭ থেকে ২০২০ অবধি দেশের মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের অনুমান করেছে। তারা দেখেছে যে, ২০২০ সালে সরকার কর্তৃক স্বাস্থ্যসেবার জন্য ব্যয় ছিল মোট জিডিপির মাত্র ০.৬৬ শতাংশ। যেখানে সারা বিশ্বে জিডিপির প্রবৃদ্ধির সাথে আনুপাতিক হারে স্বাস্থ্যসেবায় ব্যয় বৃদ্ধি পাচ্ছে সেখানে বাংলাদেশ লক্ষ্যণীয় উন্নতি করতে পারেনি। বাংলাদেশ সরকারের ৮ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ২০২০-২০২৫ এ বর্ণিত লক্ষ্য অর্জনের জন্য স্বাস্থ্যখাতে সরকারি ব্যয় মোট জিডিপির ন্যূনতম ২ শতাংশে উন্নীত করা প্রয়োজন।

বাংলাদেশে একটি অনুক্রমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থা রয়েছে যেখানে ছোটখাটো চিকিৎসার জন্যে রোগীরা প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে যায়; যেমন: কমিউনিটি ক্লিনিক, ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র, উপজেলা স্বাস্থ্যকেন্দ্র, ইত্যাদি। অন্যদিকে গুরুতর অবস্থার রোগীরা রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার জন্য তৃতীয় পর্যায়ের এবং বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানে যায়; যেমন: মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালগুলো।  

অনুক্রমিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে স্বাস্থ্য ব্যবস্থার একটি আদর্শ মডেল হিসাবে বিবেচনা করা হয়। তবে এই ক্ষুদ্র দেশের বিপুল জনসংখ্যার বিবেচনায় হাসপাতালের সংখ্যা পর্যাপ্ত নয়। মূলত জনশক্তি, অবকাঠামো, প্রযুক্তি এবং অর্থায়নের অভাবে বাংলাদেশ এই ব্যবস্থাকে পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারছে না। এ স্বাস্থ্য ব্যবস্থার পুনঃসংস্কার সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হতে পারে।

অন্যদিকে, বাংলাদেশে বহুত্ববাদী স্বাস্থ্য ব্যবস্থা বিদ্যমান। এ দেশের স্বাস্থ্যখাতে সরকারি, বেসরকারি, এনজিও এবং আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থাগুলোর অবদান রয়েছে। স্বাধীনতা-পরবর্তীকাল থেকে অনেক এনজিও বাংলাদেশের স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়নে দক্ষতার সাথে অবদান রাখছে। কিন্তু বাংলাদেশে বেসরকারি স্বাস্থ্যখাত অত্যন্ত ব্যয়বহুল। সরকার কর্তৃক প্রদেয় স্বাস্থ্যসেবা অপর্যাপ্ত হওয়ায় অনেকেই বেসরকারি স্বাস্থ্যখাত থেকে সেবা নিচ্ছেন যা তদের জন্য স্বাস্থ্য ব্যয়ের বোঝা বাড়িয়ে দিচ্ছে। বেসরকারি খাত নিয়ন্ত্রণ করা এবং এনজিওগুলোকে সহায়তা করার পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি খাতের মধ্যে সহযোগিতা বৃদ্ধি সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনে ইতিবাচক ফলাফল আনতে পারে।

অন্যান্য কর্মকাণ্ডের মধ্যে পলিসি সংস্কার, স্বাস্থ্যসেবার অবকাঠামোতে বিনিয়োগ বৃদ্ধি, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানোর জন্য বিশেষ কার্যক্রম, বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের বিকেন্দ্রীকরণ, প্রয়োজনীয় ওষুধের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করা, জনগণকে তাদের স্বাস্থ্য সম্পর্কে শিক্ষিত করা এবং মানসম্মত প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যসেবা জনগণের কাছে পৌঁছে দেয়া সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। বিশ্ব স্বাস্থ্য দিবস-২০২৪ এর মূল বিষয়বস্তু ধারণ করে বাংলাদেশকে নিশ্চিত করতে হবে যেন দেশের প্রতিটি নাগরিক তাদের স্বাস্থ্য অধিকার পায় এবং তা সম্পর্কে সচেতন হয়।

লেখক: প্রাবন্ধিক

বাংলাদেশ সময়: ১০০০ ঘণ্টা, মে ১৬, ২০২৪ 
এসি/টিসি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।