ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ আষাঢ় ১৪৩১, ২৮ জুন ২০২৪, ২০ জিলহজ ১৪৪৫

মুক্তমত

রাসেলস ভাইপার আতঙ্ক: আমাদের বিনাশ ঠেকাবে কে?

জ্যোতির্ময় নন্দী | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩২ ঘণ্টা, জুন ২৪, ২০২৪
রাসেলস ভাইপার আতঙ্ক: আমাদের বিনাশ ঠেকাবে কে?

‘নরে নাগে বাস হয় না’। অর্থাৎ মানুষ আর সাপ একসাথে থাকতে পারে না।

সর্প-ব্যাঘ্র অধ্যুষিত বাংলার এটা একটা প্রাচীন প্রবাদ। বেদেদের জীবন নিয়ে লেখা তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘নাগিনী কন্যার কাহিনী’-তে এ প্রবাদ বার বার উল্লিখিত হয়েছে। এ প্রবাদের উদ্ভবের পেছনে রয়েছে সাধারণ মানুষের ব্যাপক সর্পভীতি আর তাকে কেন্দ্র করে পুরাণকথা।

পুরোনো এ প্রবাদ নতুন করে মনে পড়ছে রাসেলস ভাইপার নিয়ে সম্প্রতি জনমনে সৃষ্ট বিপুল আতঙ্কের কারণে। রাসেলস ভাইপারকে বাংলায় বলে ‘চন্দ্রবোড়া’ সাপ, যা আজকের বাঙালিদের অধিকাংশেরই জানা নেই বলে মনে হয়। কারণ তারা পরের মুখে ঝাল খায়। তাই সাদা চামড়ার সাহেবদের দেয়া নাম নিয়েই তারা মাতামাতি করছে। চন্দ্রবোড়াকে চট্টগ্রামে বলা হয় চ’লপোড়া। এ নামও আজকের বেশির ভাগ চাটগেঁয়ে জানে বলে মনে হয় না।

সাপের হাত থেকে রেহাই পাওয়ার জন্যে মানুষ সাপের পুজো করেছে। সর্পদেবী মনসার উদ্ভব হয়েছে এই সর্পভয়কে কেন্দ্র করেই। জন্মসূত্রে আমি চট্টগ্রামের ভূমিপুত্র। পাহাড়-অরণ্য অধ্যুষিত চট্টগ্রামে সাপের ভয় বাংলার অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে বেশি বই কম ছিল না। তাই চট্টগ্রামে মা মনসার পুজোও হয় অনেক বেশি ধুমধাম করে। পুরো শ্রাবণ মাসজুড়ে বাড়িতে বাড়িতে, মন্দিরে মন্দিরে মনসার ঘট বসে এবং তার পুজো হয়। নাগপঞ্চমী ছাড়াও শ্রাবণ মাসের শেষদিন মহাসমারোহে মনসা দেবী পূজিত হন। প্রচুর ছাগল, হাঁস, পায়রা প্রভৃতি বলি দেয়া হয় দেবীর উদ্দেশ্যে।

এ কারণে প্রচলিত রীতি অনুযায়ী পুরো শ্রাবণ মাস ধরে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সাপ হত্যা নিষিদ্ধ, সাপকে নিয়ে মানুষের মনে যত বেশি ভীতিই থাকুক না কেন। অথচ এ মাসেই বা বর্ষাকালেই সাপের উপদ্রব বাড়ে সবচেয়ে বেশি। কারণ বর্ষা সাপদের মিলনের ঋতু, জোড় লাগার কাল।

এখন আষাঢ মাস চলছে, শ্রাবণও প্রায় এসেই পড়লো। স্বভাবতই এ সময়ে সাপের উপদ্রব একটু বেশি হওয়ার কথা। কিন্তু এ বছর রাসেলস ভাইপার বা চন্দ্রবোড়া সাপ নিয়ে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে ব্যতিক্রমীভাবে অত্যধিক আলোড়ন দেখা যাচ্ছে। গণমাধ্যম আর সামজিক মাধ্যমগুলো এ সংক্রান্ত প্রতিবেদন, মন্তব্য, ছবি, ভিডিওতে সয়লাব। এ বিষয়ে রাতারাতি প্রচুর বিশেষজ্ঞের সৃষ্টি হয়েছে এবং তারা যার যেমন ইচ্ছে বলে-লিখে যাচ্ছে।

চন্দ্রবোড়া সাপ বাংলায় চিরদিন ছিল, এবং এবং এখনো আছে। এটা এদেশে নতুন বা বহিরাগত কোনো সাপ নয়। অতিবর্ষণ, বন্যা প্রভৃতির কারণে মাটি জলে ডুবে যাওয়ায় এরা জনবসতিতে বা নগরে আশ্রয় নিচ্ছে বলেই মনে হয়। প্রতিটি চন্দ্রবোড়া সাপ মারার জন্যে নাকি বিরাট অঙ্কের টাকা পুরস্কার ঘোষণা করা হয়েছে।

ভালোই হয়েছে। মেরে সব সাপের গুষ্টি নাশ করে ফেললেই মঙ্গল। কারণ এখন এদেশে প্রাচীন কালের মতো সাপ কিলবিল করে না। সর্বত্র গিজগিজ করে মানুষ। বাল্যশিক্ষায় বলা হয়েছে, ‘খল লোক সর্পের ন্যায়’। বাংলাদেশ এখন সাপের চেয়েও খল মানুষে ভরপুর। এখানে সাপদের ঠাঁই নেই। প্রকৃতি এখানে অপাংক্তেয়, উন্নয়নের অন্তরায়।

আমাদের পূর্বজরা এ ব্যাপারে আমাদের চেয়ে ঢের বেশি জ্ঞানী ছিলেন। তাঁরা জানতেন, কৃষিপ্রধান বাংলার বাস্তুসংস্থানে বা ইকো সিস্টেমে সাপের অপরিসীম গুরুত্বের কথা। এ থেকেই তাঁরা শ্রাবণ মাসে বা বর্ষাকালে, নাগ-নাগিনীর মিলন ঋতুতে সর্পহত্যা নিষিদ্ধ করেছিলেন সর্পদেবীর দোহাই দিয়ে। এখন আমরা আগের চেয়ে অনেক ‘উন্নত’ (?) হয়েছি। আমাদের অত্যুন্নত ইট-কংক্রিটের জগতে সাপ সম্পূর্ণ অবাঞ্ছিত। তা ছাড়া মাত্র দু-এক পুরুষে নিতান্ত গেঁয়ো থেকে শহুরে হয়ে ওঠা মানুষের সর্পভীতির অত্যাধিক্যও অবাক করে বৈকি।

প্রকৃতি আর তার সন্তানদের বিনাশ করে আমরা বহাল তবিয়তে টিকে থাকবো বলে যদি মনে করি, তা হলে বলবো, আমরা আহাম্মকের স্বর্গে বাস করছি। রাসেলস ভাইপারের আতঙ্ক থেকে হয়তো অচিরেই আমরা মুক্ত হবো। কিন্তু আমাদের করুণ শেষ পরিণতি, সমূহ বিনাশ ঠেকাবে কে?


জ্যোতির্ময় নন্দী: সিনিয়র সাংবাদিক ও লেখক

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩০ ঘণ্টা, জুন ২৪, ২০২৪
এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।