কলকাতার একটি টিভি অনুষ্ঠান মীরাক্কেলে শোনা একটি কৌতুক দিয়ে শুরু করতে চাই। এই কৌতুকে কেউ আহত বোধ করলে আগেভাগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
গৌর তখন বললেন, ‘’আমি ভেবেছি নিতাই বাঁচাবে, আর নিতাই বলেন, আমি ভেবেছি গৌর বাঁচাবে। ‘
আশা করি এই কৌতুকের সার বুঝতে পাঠকদের কোনো কষ্ট হয়নি। দ্বৈততার ফলাফল যে খুব একটা ভালো হয় না এটা তারই রূপক কাহিনী। দুই বিয়ে করে হুমায়ুন আহমেদের মৃত্যু পরবর্তী যে ঝামেলা সেটা নিশ্চই আমরা এখনো ভুলিনি। এসব কারণেই বোধ হয়, প্রাচীন বাংলার মানুষ দুই নৌকায় পা না দেয়ার পরামর্শ দিতেন। কিন্তু ইতিহাসের সবচেয়ে বড়শিক্ষা মানুষ ইতিহাস থেকে শিক্ষা নেয় না। অনেকেই বলেন, মহাজোট সরকারের বড় সমস্যাও এই দ্বৈততা। প্রশাসন চালানোর ক্ষেত্রে মন্ত্রীর পাশাপাশি উপদেষ্টা রাখাতেই নাকি যত ঝামেলা, বৃদ্ধ বুদ্ধিজীবীরা প্রায়শই এমন কথা বলেন। আওয়ামী লীগের সুবিধা বঞ্চিত নেতারাও এই অভিযোগ তুলে নিজেদের প্রভাব বাড়ানোর চেষ্টা করেন। চারদলীয় জোট সরকারের সময়েও এই ঘটনা ঘটেছিলো। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সমান্তরালে চলতো ‘হাওয়া ভবন’। সেই দ্বৈততা। ফলাফল গৌর-নিতাইর ভক্তের চেয়ে যে ভালো হয়নি, সেটা বলার কোন প্রয়োজন পড়ে না।
অতিসম্প্রতি, সোনালী ব্যাংক থেকে হলমার্ক গ্রুপের কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার ঘটনাতেও আরো একবার দ্বৈততার প্রমাণ মিললো। অর্থমন্ত্রী ও বাংলাদেশ ব্যাংক ভিন্ন অবস্থানে গিয়েছিলেন। ব্যাংক আইনে ব্যাংকের সবকিছু একচ্ছত্রভাবে দেখার অধিকার বাংলাদেশ ব্যাংকের। কিন্তু তার পরিচালক নিয়োগ দেয় অর্থমন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং বিভাগ। ব্যাংকের কাজটা আর্থিক। কিন্তু পরিচালক অর্থনীতিক নন, রাজনীতিক। নৌকা নিয়ে রাজনীতি করা দেশে দুই নৌকায় পা দেওয়া বোধ হয় সহজে থামানো যাবে না।
দ্বৈততার ফলাফল যে সচরাচর খারাপ হয়, সে বিষয়ে দ্বিরাচারী ব্যক্তিও আমার সাথে একমত হবেন, এমনটাই আমার আশা। তবে অনেকে যে দ্বৈততাকে প্রশ্রয় দিয়ে সুবিধা লুটতে চান, সেটা বোধহয় দ্বিরাচারীদের ভুলে যাওয়া ঠিক হবে না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সিরাজবধের পর রাজ্য চালানোর দায়িত্ব দিয়েছিলো মীরজাফরকে। আর রাজকোষ সামলানোর দায়িত্ব নিয়েছিলো নিজেরা। তারা ঘোষণা দিয়ে দ্বৈতশাসন পদ্ধতি চালু করেছিলো। ইংরেজরা বহুকাল থেকে ‘ডুয়েল’ লড়তে অভ্যস্থ জাতি। তারা দ্বিদলীয় ব্যবস্থা, দ্বিজাতি তত্ত্ব এসব সাফল্যের সাথেই তৈরী করতে পারে। কিন্তু বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাবের পক্ষে দ্বৈত শাসন হজম করা সহজ ছিলো না। ইংরেজের টাকার ক্ষুধা মেটাতে গিয়ে ১৭৭৬ সালে ঘটে যায় ভয়াবহ মন্বন্তর। মারা পড়ে হাজার হাজার মানুষ। স্বাধীনতার পরপরই ১৯৭৪ সালেও সোভিয়েত ব্লকের বাংলাদেশের ভিন্ন মেরুর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে খাবার কিনতে গিয়েও একই সংকটে পড়তে হয়েছিলো। দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ঘটনাচক্রে ঘটে যাওয়া দু:সহ সেই ঘটনা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে তা যে দুই নৌকায় পা দেওয়ারই ফল মানতে কষ্ট হয় না। অনেক সময় না বুঝেও মানুষ দ্বিরাচারী হয়। অনেক সময় বাধ্য হয়েই দ্বিরাচারী হতে হয়। কিন্তু দ্বৈততার ফলাফল সব সময়ই এক। কখনো কখনো খুব খারাপ না হলেও আহামরি ভালো কিছু নয় কখনোই।
ঔপনিবেশিক শক্তি দ্বিজাতি তত্ত্ব—বিভক্ত কর আর শাসন কর ( ডিভাইড অ্যান্ড রুল) এই জাতীয় তত্ত্ব প্রয়োগ করে এদেশে টিকতে পারেনি ঠিকই, কিন্তু যাওয়ার সময় এদেশের মানুষের মাথায় এসব বিদ্বেষী তত্ত্বের বিষ ভালোমতই ঢুকিয়ে দিয়ে গেছে ইংরেজ। তারই একটা ফল দ্বৈততা। তবে এটা ভাবারও কোনো কারণ নেই ইংরেজ আসার আগে বাঙালীর মাঝে দ্বৈততা ছিলো না।
সম্প্রতি রাত বারোটায় তেতো টাইপের বিষয় নিয়ে একটা টক শো করছিলাম। হঠাৎ চোখ চলে গেলো বাংলানিউজটোয়েন্টিফোরের ওয়েবপেজে। দ্বৈততার এক অনন্য খবর বেরিয়েছে। ছাত্রলীগের সাবেক ক্যাডার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শাখার ছাত্রদলের সভাপতি মনোনীত হয়েছেন। একসময় ঐ ছাত্রনেতা ছাত্রলীগের হয়ে ছাত্রদলকর্মীদের পিটিয়েছিলেন। হয়তো ভবিষ্যতে উল্টোটা করবেন। তার এ দ্বৈততার খবরের রেশ কাটতে না কাটতে দেখলাম আরেক খবর। সিলেটে শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রলীগ ক্যাডাররা ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান প্রকৌশলী পদে একজন আওয়ামীপন্থী প্রার্থীকে ঠেকাতে এবং জামাতপন্থী এক প্রার্থীকে নিয়োগ দিতে বাধ্য করতে প্রশাসনিক ভবনের তালা এঁটে দিয়েছেন। কি অসাধারণ খবর! এদেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দ্বিরাচার ঢুকে পড়ার চমৎকার সব উদাহরণ এসব ঘটনা। এ নিয়ে আমরা বোধহয় আজকাল খুব একটা আর ভাবি না। এদেশেরই কিছু কুলাঙ্গার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এদেশের জন্মের বিরোধিতা করেছিলো। সেটা স্ববিরোধিতাই বলা চলে। স্ববিরোধিতার সেই ছাপ মুছে ফেলার চেষ্টা যখন দৃশ্যমান তখন আমরা হয়তো জানি না, মনের অজান্তেই কত স্ববিরোধিতা আমাদের গ্রাস করছে। স্ববিরোধিতারই আরেক নাম অন্তত: দ্বৈততা। ক্ষেত্র বিশেষে তা বহুগামিতা হলেও তার যাত্রা শুরু দ্বৈততা দিয়েই। এদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজ-সংস্কৃতিতে দ্বৈততার যে ভন্ডামি লুকিয়ে আছে সেগুলোকে তো বটেই, নিজের মধ্যের দুই মানুষকেও বোধহয় রাশ টেনে ধরার একটা সময় এসেছে। তা না হলে কি হবে কে জানে!
লেখক: প্রধান বার্তা সম্পাদক, বৈশাখী টেলিভিশন
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর [email protected]