দিন আর রাত্রির মতো দু’টো অতি স্বাভাবিক অধ্যায় আছে আমাদের ছাত্র রাজনীতির জগতে। ক্ষমতাসীন দলের ‘লেজুড়’ হলে আশপাশের-জেলা-উপজেলার সব ঠিকেদারি, চাঁদাবাজির (প্রটেকশন মানি বলাটা বোধকরি ভদ্রোচিত হবে) ‘নায্য হিস্যার হকদার।
তাদের হকি স্টিক-ছুরি-ধামা-কাটা রাইফেল-পিস্তল ইত্যাকার ‘প্রয়োজনীয় উপকরণ’ আইন-শৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজর এড়িয়ে যায়। ক্ষেত্র বিশেষে আইন ও আইনের অন্য পারে থাকা ছাত্র নামধারীরা অলিখিত একাট্টায় থাকেন। কারণ তখন ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনের দিন। বুক ফুলিয়ে সব কিছু প্রকাশ্যে করাটাই ‘জায়েজ’।
বিপরীতে বিরোধীদের তখন অমাবস্যা। ঘোর অন্ধকার রাত্রি। ‘রাজনীতি’ নামের লাভজনক সড়কে হাঁটতে গিয়ে মাঝে-মধ্যে হোঁচট খেতে খেতে বিরোধী দলের প্রায় প্রৌঢ় ছাত্র নেতারা দিনের স্বপ্ন বুনেই চলছেন। দু’একটা ধাক্কা, লাঠি-পেটা, লাথি-ঘুষি এগুলো সব আগামীর ইনভেস্টমেন্ট। বিরোধী দলের বিবাহিত ছাত্র নেতাদের মাঝে যিনি বেশি মারধর খাবেন, নির্যাতিত হবেন; ওনার দলীয় পদোন্নতির সম্ভাবনা ততই উজ্জ্বল ও সম্ভাবনায় আশা জাগানিয়া। ওনার মধ্য থেকেই ‘জন্ম হবে’ আগামীর মাননীয় মন্ত্রী বাহাদুরেরা।
ক্ষমতাসীন দলের ‘লেজুড়’ ছাত্র নামধারীদের মধ্যে যারা যত বেশি প্রতিপক্ষের প্রতি নির্দয় ও মারমূখী মূল ও দলের অন্যান্য নেতৃত্ব পর্যায়ে তাদের বেশ কদর। সংশ্লিষ্ট শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ‘লেজুড়ে ও অমেরুদণ্ডী’ শিক্ষক নামীয় উচ্চ শিক্ষিত পদোন্নতি ও প্রভাবের মোহে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনগুলোর ‘মাশাল্লা’দের বেশ ইজ্জত দেন। আবাসিক হলের সিট ও ভর্তি বাণিজ্যে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠনগুলোর সংগে মিলে মিশে থাকেন এক শ্রেণির শিক্ষকরা। টেণ্ডার বাণিজ্য তো নৈমিত্তিক ঘটনা প্রবাহ মাত্র।
প্রায়শঃই সংবাদপত্র আর ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ক্ষমতাসীন দলের লেজুড়ে ছাত্র সংগঠনগুলোর সশস্ত্র ‘মাশাল্লা’দের ছবি প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়। নিয়মানুসারে অমানবিক এইসব ঘটনার বিরুদ্ধে মামলা হয় কিন্তু অভিযুক্তদের কোনো অবস্হায় আইন খুঁজে পেতে ব্যর্থ হয়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভিডিও ফুটেজ দেখেও প্রেসক্লাবের সামনে প্রকাশ্য মানববন্ধনে থাকা প্রকৃত ‘মাশাল্লা’দেরও খোঁজ মেলে না।
আমার বিনীত জিজ্ঞাসা ‘মাশাল্লা’দের অভিভাবক বা পিতা-মাতা-ভাই-বোনদের প্রতি। জানতে ইচ্ছে হয়, নিজের সন্তানের হাতে পিস্তল-রামদা-হকি স্টিক দেখে পিতা-মাতার গর্ব হয় কিনা? কিংবা অন্যদের ‘টেরর’ করা দেখে অভিভাবকরা উল্লসিত হন কিনা?
আজকাল মানুষের মধ্যে সামাজিক লজ্জ্বার লেশমাত্র দেখি না। কিন্তু বিবেক নামক সামান্য মানবিক গুণাবলী কি এতোই নিস্ক্রীয় যে অন্যের সন্তানের হাত-পা ভাঙ্গা, রামদা দিয়ে কোপানো কিংবা পিস্তল হাতে দৌঁড়ানোর দৃশ্য দেখে একবারো ভাবেন না, প্রাণ হাতে নিয়ে দৌঁড়ানো ছেলেটি ওনার নিজের হতে পারতো! সামাজিক লজ্জ্বার পুনঃজাগরণ হবে এমন অসম্ভব প্রত্যাশা করি না, কিন্তু মানুষ হিসেবে, অভিভাবক হিসেবে অন্য মানুষ আর অন্যের সন্তানকে নিজের ভাবার মানসিকতাও কি আমরা খুঁইয়ে ফেলেছি!
আমাদের নিস্পৃহতা আর নিস্ক্রীয়তা আমাদের সন্তানদের ‘অমানুষ’ হবার পথে ঠৈলে দিচ্ছে। অন্যের সন্তানের মৃত্যুতে আমাদের কিছুই আসে যায় না, কিন্তু নিজের সন্তানের মৃতদেহ দেখলে আহাজারিতে আকাশ-বাতাস কাঁদে। বড় অদ্ভুত বাঙালি অভিভাবকত্ব!
[email protected]
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৫ ঘণ্টা, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১২
সম্পাদনা: আহ্সান কবীর, আউটপুট এডিটর