ঢাকা: ক্রীড়াঙ্গনে সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। পরিবর্তন, পরিবর্ধন, পুরোপুরি বাতিল এবং নতুন উদ্ভাবন ক্রীড়াঙ্গনের কার্যক্রমের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত।
আর তা হলেই সংস্কার ‘টেকসই’ হবে। ক্রীড়াঙ্গনে সংস্কার একটি লম্বা প্রক্রিয়া, এখানে ধাপে ধাপে লক্ষ্য সাধনে উপনীত হওয়া সম্ভব। ফেডারেশন আর অ্যাসোসিয়েশনের সঙ্গে এক ঘণ্টার বৈঠক করে কতটুকু কী উপলব্ধি গেছে জানি না। আর কাদের সঙ্গে এই বৈঠক? সার্চ কমিটি নিশ্চয়ই এসব বিষয়ে সচেতন।
তাদের কার্যক্রম নিয়ে কথা উঠেছে। বলব এটি ভালো—এই আলোচনা ও সমালোচনা তাদের ঘাটতি এবং চিন্তার ক্ষেত্রে ভুলগুলো সংশোধনে সাহায্য করবে। মনে রাখতে হবে ক্রীড়াঙ্গনের সঙ্গে জড়িত আছে দেশের আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতি। দেশের ক্রীড়াঙ্গন পরিচালিত হয় অপেশাদার ব্যবস্থায়।
ক্রীড়াঙ্গনকে বদলাতে হলে, গতিশীল করতে হলে, ক্রীড়াঙ্গনকে তারুণ্যনির্ভর করতে প্রয়োজন সংশোধনের মাধ্যমে শুরু করা। সবাই একমত ক্রীড়াঙ্গনে বিরাজমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে সংস্কারের বিকল্প নেই। তবে এটি একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। বিষয়টি সময়সাপেক্ষ। একবারে একদম ‘ফান্ডামেন্টাল’ সংস্কার করা সম্ভব নয়, যা আর কেউ কখনো পাল্টাতে পারবে না।
অবশ্যই ক্রীড়াঙ্গনে একটি নতুন সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে এই সুযোগকে কাজে লাগাতে হবে। ’৯০-এ স্বৈরাচার পতনের পর একটি সুযোগ এসেছিল ক্রীড়াঙ্গন ‘মেরামত’ করার, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ‘যা বাহান্ন তাই তিপ্পান্ন’ দেখেছি। রাজনৈতিক পরিবর্তন হলেই সুবিধাবাদ জিনিসটা ভালোভাবেই সামনে আসে। এবারও এসেছে। ক্রীড়াঙ্গনে আদর্শহীনতার অভিযোগ আছে। কেউ কেউ নিজকে পাল্টে ফেলে ‘হালুয়া রুটি’ নিশ্চিত করার মিছিলে নেমে পড়েছেন। মনে রাখতে হবে ক্রীড়াঙ্গন পরিচালনার মালিক কিন্তু ক্রীড়া সংগঠকেরা। তাঁরাই তাদের প্রজ্ঞা, নিষ্ঠা, আন্তরিকতার মাধ্যমে ক্রীড়াঙ্গনে সেবা দিয়ে থাকেন। ক্রীড়াঙ্গনের সংস্কারের জন্য সংগঠকদের এই প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত করা, তাঁদের অঙ্গীকার এবং ঐকমত্য দরকার—ভালো উদ্যোগে সফল হওয়ার জন্য।
সংস্কারের পাশাপাশি ক্রীড়াঙ্গন সচল রাখা হোক ঘোড়ার আগে তো গাড়ি জুড়লে চলবে না। বিভাজন সৃষ্টি আর স্ববিরোধিতা কোনোমতেই কাম্য নয়। সবাই চাচ্ছেন জনকল্যাণমূলক সচল ক্রীড়াঙ্গন। অন্য সেক্টরের সঙ্গে ক্রীড়াঙ্গনকে মিল খাওয়ানো যাবে না। এই চত্বরের জীবনবোধ একদম আলাদা। এখানে যেমন প্রচুর সম্ভাবনা আছে তেমনি আছে ঘাটতি। আছে নীতিগত সমন্বয়হীনতা ও যোগ্য নেতৃত্বের অভাব। আছে সমষ্টি মানুষের সচেতনতার অভাব। ক্রীড়াঙ্গনে প্রয়োজন সামাজিক আন্দোলন।
ক্রীড়াঙ্গনে কেন সবাই সংস্কারের পক্ষে এর কারণ হলো নারী-পুরুষ বৈষম্যের অবসান (মাঠে ও মাঠের বাইরে ক্রীড়া প্রশাসনে) সমতা ও মানবিক ক্রীড়াঙ্গন, একত্ববাদিতা, স্বৈরাচার এবং একনায়কতন্ত্রের শাসনের অবসান সবাই চান। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার পাঁয়তারা বন্ধ করা দরকার। ক্রীড়াঙ্গন মুক্ত হোক দুর্নীতি এবং অনৈতিক কার্যকলাপ থেকে। একদম তৃণমূল থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত ক্রীড়াঙ্গন পরিচালিত হোক গণতান্ত্রিক চর্চার মাধ্যমে। অব্যবস্থার খপ্পর থেকে ক্রীড়াঙ্গন মুক্তি পাক। মানুষের চেয়ে প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব বড় হোক। আদর্শিক অবস্থান গুরুত্ব পাক। ব্যক্তি নয়, সমষ্টির স্বার্থ জয়যুক্ত হোক। এ ছাড়া ক্রীড়া মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কিছু আইনের সংশোধন একান্ত প্রয়োজন। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কার্যক্রমে নতুন কিছু আইন প্রণয়ন করা হোক পুরোনো আইন বাতিল করে। এর মধ্যে একটি হলো প্রতিটি ফেডারেশন অ্যাসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট হবেন কাউন্সিলারদের দ্বারা নির্বাচিত। জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ এবং মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও কর্মকর্তাদের খাতিরে মনোনীত নয়। এই আইনটি পাস করা হলে ক্ষমতাসীন দলের রাজনীতির প্রভাব ক্রীড়াঙ্গনে অনেকটা কমবে। রাজনীতিবিদ এবং বড় আমলাদের পুরস্কার দেওয়ার বিষয়টি ভীষণ দৃষ্টিকটু। মুক্তবিশ্বের ক্রীড়াঙ্গন এ ধরনের নিয়োগের কথা ভাবতে পারে না। এই যে ২০১৮ সালের আইনের ২২ ধারায় একসঙ্গে ৪০ জনেরও বেশি সভাপতিকে ‘গুডবাই’ বলা হয়েছে, এটি আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আইনের পরিপন্থী। আরেকটি বিষয় হলো, ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি সরিয়ে দেওয়ায় কেন সব ফেডারেশনের খেলাধুলা বন্ধ হয়ে গেল? আসল কারণ কী? ফেডারেশন ও অ্যাসোসিয়েশনের গঠনতন্ত্রে কী আছে? সভাপতির অনুপস্থিতিতে কে দায়িত্ব পালন করবেন সেটি নিশ্চয় প্রত্যেক ফেডারেশনের গঠনতন্ত্রে উল্লেখ আছে। ক্রীড়াঙ্গনে বিরাজ করছে অস্থিরতা, উৎকণ্ঠা, অনিশ্চয়তা এবং এক ধরনের আতঙ্ক। এটি ঠিক, বিভিন্ন খেলার ফেডারেশনের বেশ কিছু কর্মকর্তা আড়ালে আছেন, কেউ কেউ দেশান্তর হয়েছেন, কেউ জেলে, কাউকে কাউকে খুঁজে বেড়াচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনী। ক্রীড়াঙ্গনের জন্য তাঁদের এই অবস্থা হয়নি, হয়েছে ব্যক্তিগত দুর্নীতি আর বিগত সরকারের পদলেহন এবং চাটুকারিতার কারণে। তাঁরা কখনো ভাবেননি এর খেসারত তাঁদের একদিন দিতে হবে।
বিগত চার মাস যাবৎ দেশের ক্রীড়াঙ্গনে স্থবিরতা বিরাজ করছে। ব্যতিক্রম শুধু ক্রিকেট এবং কিছু ক্ষেত্রে ফুটবল। এদিকে অনেক আগে কর্মসূচি ঘোষণা দিয়েও আসন্ন ফুটবল মৌসুম (২০২৪-২৫) শুরু হওয়ার বিষয়টি পেশাদার লিগ কমিটি বাধ্য হয়েছে পিছিয়ে দিতে। মাঠের মালিক হলো জাতীয় ক্রীড়া পরিষদ তারা সময়মতো মাঠ প্রস্তুত করে দিতে পারেনি। এই যে বিভিন্ন খেলার চর্চাও বন্ধ আছে, এর নেতিবাচক প্রভাব সমাজে এবং ক্রীড়াঙ্গনে পড়তে বাধ্য। কোনো অবস্থায়ই খেলাধুলার চর্চা বন্ধ রাখা উচিত হচ্ছে না—সংস্কার কাজের পাশাপাশি ক্রীড়া চর্চাও চলমান থাকা উচিত। সংস্কারকাজের দোহাই দিয়ে খেলাধুলা বন্ধ রাখা মেনে নেওয়া উচিত নয়।
সংস্কার একসঙ্গে কখনো করার কথা নয়—করা যাবেও না। এটি ধাপে ধাপে করতে হবে। লক্ষ্য রাখতে হবে সংস্কারের চিন্তা যাতে কোনো অবস্থায়ই অতীতের মতো ব্যর্থ হয়ে না যায়। আগেও উল্লেখ করেছি, আবারও বলছি দেশের ক্রীড়াঙ্গনে সংস্কার সাধনের ক্ষেত্রে প্রথম হাত দেওয়া উচিত প্রতিটি ফেডারেশন/অ্যাসোসিয়েশনের গঠনতন্ত্রে। এই ক্ষেত্রে দ্রুত কাজ করা এবং নিজ নিজ ফেডারেশনের কর্মকর্তা ও অন্যরা একসঙ্গে বসে যদি ঐকমত্যের মাধ্যমে গঠনতন্ত্রে পরিবর্তন-পরিবর্ধন এবং নতুন করে কয়েকটি ধারা সংযোজন করেন এটা অনেক বড় কাজ হবে। এতে অনেক সমস্যার সমাধান খুব তাড়াতাড়ি সম্ভব।
কোনো কিছু চাপিয়ে দেওয়ার বিষয়ও এ ক্ষেত্রে উঠবে না। বরং অনেকগুলো ‘বার্নিং ইস্যুর’ সমাধান সংগঠকেরা স্বতঃস্ফূর্ত হয়ে নিজেরাই করবেন। আমাদের প্রত্যাশা ক্রীড়াঙ্গন যাতে সত্বর আবার প্রাণ ফিরে পায় সেই উদ্যোগ অন্তর্বর্তী সরকার নেবে। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শুধু নিজে ক্রীড়ানুরাগী নন, তিনি অলিম্পিক আন্দোলনের সঙ্গেও জড়িত। সদ্যসমাপ্ত প্যারিস অলিম্পিকেও তিনি কাজ করেছেন। তিনি জানেন জাতির জীবনে খেলাধুলার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা কী!
লেখক: কলামিস্ট ও বিশ্লেষক। সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি, এআইপিএস এশিয়া। আজীবন সদস্য, বাংলাদেশ স্পোর্টস প্রেস অ্যাসোসিয়েশন। প্যানেল রাইটার, ফুটবল এশিয়া
বাংলাদেশ সময়: ১৩১২ ঘণ্টা,অক্টোবর ১৬,২০২৪
এসআইএস