জনপ্রশাসন রাষ্ট্রের তিনটি বিভাগের মধ্যে নির্বাহী বিভাগের আওতাধীন। জনপ্রশাসনের কাজের পরিধি ব্যাপক ও বিস্তৃত।
ক্রমবর্ধমান জলবায়ু সংকট, বৈশ্বিক অর্থনীতির শ্লথগতি এবং চাহিদা কমে যাওয়ায় অসমতা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জের প্রেক্ষিতে একটি দক্ষ ও দ্রুত কর্মসম্পাদনে সক্ষম তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহারে পারদর্শী, পেশাগত ও সাধারণ ব্যবস্থাপনার প্রশিক্ষিত সদস্য জনপ্রশাসনে প্রয়োজন। এরই পাশাপাশি জনপ্রশাসনের স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা জরুরি। জনপ্রশাসনের যে কোনো ধরনের সংস্কারের ক্ষেত্রে এই বিষয়গুলো অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনার দাবি রাখে। নিম্নে জনপ্রশাসন সংস্কারে কিছু প্রস্তাবনা উপস্থাপন করা হলো:
# প্রথমেই সিভিল সার্ভিসের সদস্যদের প্রশিক্ষণ ও মোটিভেশন প্রদান পদ্ধতি পুনর্বিবেচনা করতে হবে। এজন্য প্রয়োজন একবিংশ শতাব্দীতে সিভিল সার্ভিসের সদস্যদের কী ধরনের কম্পিটেন্সি দরকার তা নির্ধারণ করা। উইলসন কমিটির মতে, এই সমস্ত গুণাবলী হলো—কার্যকর যোগাযোগ দক্ষতা, দ্রুত সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা, জনগণকে সম্পৃক্ত করার ক্ষমতা, প্রযুক্তি ব্যবহারের সক্ষমতা, সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনে নেতৃত্ব প্রদানের ক্ষমতা। আবার, একবিংশ শতাব্দীর সিভিল সার্ভিস কেমন হবে এই বিষয়ে সিঙ্গাপুরের পাবলিক সার্ভিস ২১ (পিএস ২১) এর মতে, গুণগত জনসেবা প্রদানে সক্ষমতা, সেবার মানোন্নয়নে সচেষ্ট থাকা—এ ধরনের গুণাবলী সিভিল সার্ভেন্টদের থাকা উচিত। The Centre for Public Impact, Lankelly Chase, The RSA এর যৌথ নিবন্ধ “ System Convening: A crucial form of leadership for the twenty first century”-তে উল্লেখ আছে ১। বিনয়ী নেতৃত্ব; ২। সহযোগিতা; ৩। ক্ষমতা শেয়ার করা; ৪। স্বচ্ছতা, বিশ্বস্ততা ও যোগাযোগের মাধ্যমে লেজিটিমেসি অর্জন; ৫। অবিরত শিক্ষণ ইত্যাদি গুণ একবিংশ শতাব্দীর সিভিল সার্ভিসের সদস্যদের থাকা উচিত। এই সমস্ত বৈশ্বিক ও দেশীয় ধারণার আলোকে সিভিল সার্ভেন্টদের কম্পিটেন্সি ফ্রেমওয়ার্ক প্রস্তুত করতঃ তাদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
# যেসব বিষয়ে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় তা কর্মজীবনে অপ্রতুল হিসেবে দেখা দেয় । উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, চাকরি জীবনের প্রথম ১০ বছরে উপজেলা পর্যায়ে প্রত্যেক অফিস প্রধানকে প্রকল্প ব্যবস্থাপনা, সরকারি ক্রয়, আর্থিক ব্যবস্থাপনা, কর্মচারী ব্যবস্থাপনা এবং কমিউনিটির সংযুক্ততা নিয়ে কাজ করতে হয়। কিন্তু তাদের জন্য নির্ধারিত বিপিএটিসির বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ কোর্সে এসব বিষয়ে নামমাত্র বা কোনো প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয় না। জনপ্রশাসনে প্রযুক্তির ব্যবহার সম্পর্কিত প্রশিক্ষণের অবস্থাও তথৈবচ। এসব বিষয়ে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ প্রদানসহ কর্মকালে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে পরামর্শ গ্রহণের জন্য প্রশিক্ষণ কেন্দ্রসমূহে দক্ষতাসম্পন্ন জনবলকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে পরামর্শ সহায়তা দেওয়া যেতে পারে। সিভিল সার্ভিসের মাঝের দশ বছরে মনিটরিং ও মূল্যায়ন, অফিস ব্যবস্থাপনা, অধীনস্তদের হতে কর্ম আদায়ের কৌশল ইত্যাদি বিষয়কে গুরুত্ব প্রদান করা যায়। সিনিয়র সিভিল সার্ভেন্টদের ক্ষেত্রে নেতৃত্ব, উদ্ভাবন, দেশ-বিদেশের উত্তম চর্চা, যোগাযোগ দক্ষতা, মনিটরিং দক্ষতা, উন্নত প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে দক্ষতা বৃদ্ধি, বৈচিত্র্য, সমকালীন জনপ্রশাসন বিষয়ক চ্যালেঞ্জ প্রভৃতি বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান করা যেতে পারে।
# বিশ্বজুড়ে জনপ্রশাসনের নতুন ধারণা যেমন: নিউ পাবলিক ম্যানেজমেন্ট, ভ্যালু ফর মানি সিটিজেন চার্টার ইত্যাদি উদ্ভবের ও বিকাশের ফলে জনগণ সরকারি দপ্তর থেকে বেসরকারি সেক্টরের মত দ্রুত ও জটিলতাবিহীন সেবা প্রত্যাশা করে। এছাড়া ক্লায়েন্ট বা সেবাপ্রত্যাশীরা সরকারি সেক্টরের ব্যবস্থাপনায় ইতিবাচক পরিবর্তন দেখতে চায়। এমতাবস্থায় সরকারি দপ্তরের অফিস প্রধান ব্যক্তিদের বেসরকারি খাতের কর্মপন্থা সম্পর্কে ধারণা প্রদানের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে স্বনামধন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহে অ্যাটাচমেন্টের ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে। তদ্রুপ সরকারি ব্যবস্থা সম্পর্কে জানার জন্য বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহীদের মন্ত্রণালয়ের বা বিভাগের কার্যাবলী সম্পর্কে সম্যক ধারণা প্রদান করা যেতে পারে।
# সংবিধানে একাধিক সরকারি কর্ম-কমিশন গঠনের সুযোগ রাখা হয়েছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি, প্রকৌশল, মৎস্য প্রভৃতি কারিগরি ক্যাডারে বিপুল সংখ্যক জনবল নিয়োগের প্রয়োজন হয়। এজন্য অনেক সময় বিশেষ বিসিএসের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। পিএসসি সব সময় ২/৩টি বিসিএস পরীক্ষার কার্যক্রমের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকে। তাই ওই ক্যাডারসমূহে যথাযময়ে নিয়োগ সম্পন্ন করা চ্যালেঞ্জিং হয়ে দাঁড়ায়। এমতাবস্থায়, টেকনিক্যাল ক্যাডারের জন্য একটি টেকনিক্যাল পাবলিক সার্ভিস কমিশন এবং সাধারণ ক্যাডারের জন্য বিদ্যমান সরকারি কর্মকমিশন । বর্তমানে বলবৎ সংবিধানের আওতায় এ ধরনের একাধিক কর্ম কমিশন গঠন সম্ভব। এতে কারিগরি ক্যাডার এবং সাধারণ ক্যাডারসমূহে নিয়োগ প্রদান দ্রুততর করা যাবে।
# সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচিসহ বিভিন্ন কর্মসূচির উপকারভোগী নির্বাচনকালে নিরপেক্ষতা ও স্বচ্ছতা বজায় রাখার স্বার্থে কিছু পরিবর্তন আনয়ন করতে হবে। ওই কর্মসূচিসমূহের উপকারভোগী নির্বাচনে শুধুমাত্র স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের উপর নির্ভরশীল না থেকে তাদের কর্তৃক প্রদত্ত তথ্য এনজিও, স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন যেমন: রেড ক্রিসেন্ট ও বাংলাদেশ গৃহ ও অর্থনৈতিক শুমারিতে প্রাপ্ত তথ্যের সাথে ট্রায়াংগুলেশন করে সুবিধাভোগী নির্বাচন করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়। অর্থনৈতিক শুমারিতে প্রতিটি গৃহের সদস্যদের আয় ব্যয়ের যে তথ্য আছে সে তথ্যসমূহকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সাথে সামঞ্জস্য রেখে বিভিন্ন কারিগরি যেমন: দুঃস্থ, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, জেলে, দরিদ্র কৃষক, দরিদ্র শ্রমজীবী, ভূমিহীন বিভাজনপূর্বক প্রয়োজন অনুযায়ী ব্যবস্থা করা যেতে পারে। অধিকাংশ (৯০%-৯৫%) বেনিফিশিয়ারি বা সুবিধাভোগী এভাবে নির্বাচন করা যায়। ৫%- ১০% স্থানীয় ব্যবস্থাপনার আলোকে জিও-এনজিও এবং স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের যাচাই বাছাইয়ের ভিত্তিতে বরাদ্দের জন্য সংরক্ষণ করা যেতে পারে।
# প্রযুক্তির সহায়তা নিয়ে বিভিন্ন সেবা দ্রুত প্রদানের ক্ষেত্রে সেবাপ্রত্যাশীদের জন্য সেবা বাবদ পেইমেন্ট প্রদানের ক্ষেত্রে একাধিক বিকল্প (option) রাখতে হবে। এছাড়া সেবায় প্রবেশাধিকার (Access to service) সহজতর করতে হবে। অমর্ত্য সেনের সক্ষমতা (Capability) সম্পর্কিত তত্ত্বমতে, সহজ Access ও Option সৃষ্টি জনগণের ক্ষমতায়নে ভূমিকা রাখে। বাস্তবে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, ডিজিটাল সার্ভিস বাবদ প্রদত্ত বিল প্রদানে অনেক সময় দূরুহ হয়ে দাড়ায়। যেমন: জন্মনিবন্ধন সনদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ফি বা চালান শুধুমাত্র সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে প্রদেয়। সোনালী ব্যাংক অনেক সেবার সঙ্গে জড়িত। তাই অনেক সময় দ্রুত ফি প্রদান ব্যাহত হয়। এছাড়া এজন্য ব্যাংকে যাওয়ার প্রয়োজন হয়, যা সময় ও ব্যয় সাপেক্ষ। এজন্য একাধিক বিকল্প যেমন: বিকাশ, নগদ ইত্যাদির মাধ্যমে অনুরূপ সেবাসূহের জন্য ফি প্রদানের সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। যাতে মানুষের সেবা গ্রহণের জন্য Access সহজতর হয় এবং Option বৃদ্ধি পায়।
# বিভিন্ন ডিজিটালাইজড সেবার জন্য আবেদন করার ক্ষেত্রে গ্রাম পর্যায়ে নারীদের সহায়তা করার জন্য ‘তথ্য আপা’ নামক প্রকল্প রয়েছে। ডিজিটাল বৈষম্য (Digital Divide) দূরীকরণে নিরক্ষর পুরুষ, প্রতিবন্ধী এমন ধরনের জনগোষ্ঠীর জন্য ডিজিটাল সহায়তা প্রদানের জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। শহরাঞ্চলেও অনুরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এই বিষয়টি আলাদাভাবে অথবা বিদ্যমান স্ব স্ব অফিস মাধ্যমেই এই বাস্তবায়ন করা যেতে পারে।
# সেবা প্রদানের ক্ষেত্রে মানবিক মর্যাদা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে সেবাপ্রদানকারী প্রতিষ্ঠান কর্তৃক সেবা প্রার্থীদের সাথে পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধের ভিত্তিতে আচরণ করার সংস্কৃতি গড়ে তুলতে হবে। প্রশিক্ষণে এই বিষয়ে গুরুত্ব প্রদান করতে হবে।
# সিভিল সার্ভিসের উচ্চ পর্যায়ের পদে যেমন: সচিব, মহাপরিচালক, পরিচালক ইত্যাদি এবং সমমানের পদসমূহে কী ধরনের যোগ্যতাসম্পন্ন (Ability) জনবল প্রয়োজন তা দেশ-বিদেশের গবেষণা ও উত্তম চর্চার ভিত্তিতে নির্ধারণ করতে হবে। বিভিন্ন সংস্থার জন্য এই Abilities ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে। তবে বিশ্বজুড়ে এই ধরনের পদসমূহের জন্য সাধারণ কিছু নির্ধারিত Abilities রয়েছে। যেমন: সমন্বয় দক্ষতা, যোগাযোগ দক্ষতা, মানবসম্পদ ব্যবস্থাপনা, ক্রাইসিস ব্যবস্থাপনা দক্ষতা, সরকারি বেসরকারি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সাথে কাজ করার দক্ষতা, টিম বিল্ডিং দক্ষতা, বিভিন্ন পর্যায়ে ও ক্ষেত্রে কাজের অভিজ্ঞতা ইত্যাদি। এই দক্ষতাসমূহ এবং অন্যান্য দেশসমূহে অনুসৃত দক্ষতার ভিত্তিতে নেতৃত্বস্থানীয় পদ-পদবিতে নিয়োগদান করা যেতে পারে। মন্ত্রণালয়ে বা সংস্থার বিশেষায়িত জ্ঞানের সেবা পাওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের বিভিন্ন Modality যেমন: উচ্চ বেতনে চুক্তিভিত্তিক কমিটি সিস্টেমের মাধ্যমে, টেন্ডারের মাধ্যমে পরামর্শ সেবাক্রয় করা যেতে পারে। নির্দিষ্ট সংখ্যক বিশেষজ্ঞকে উচ্চ বেতন বা সুবিধা দিয়ে সিভিল সার্ভিস হতে পদায়নও করা যেতে পারে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় মার্কিন মহাকাশ বিষয়ক সংস্থা NASA (নাসা)-এর প্রধান প্রশাসক একজন আইন ও রাজনীতি বিজ্ঞানে শিক্ষিত ব্যক্তি। কিন্তু সেখানে তার চেয়েও উচ্চ বেতনধারী অনেক বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞ রয়েছেন।
# মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন সার্ভিস প্রদানের ক্ষেত্রে প্রাইভেট অ্যাকটর যেমন: কম্পিউটার দোকান ইত্যাদি জড়িত থাকে। এই সমস্ত প্রাইভেট অ্যাকটরদের স্বীকৃতি প্রদান ও নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে Certificate of Service Provider জাতীয় সনদ প্রদান করা যেতে পারে। সেবা প্রদান নির্ভুল করা জন্য প্রাইভেট অ্যাকটরদের জন্য ওরিয়েন্টেশন বা প্রশিক্ষণ আয়োজন এবং গাইডলাইন প্রদানের উদ্যোগ নেওয়া যায়।
# কোনো দপ্তরের অবহেলার কারণে কোনো সেবাপ্রার্থীর অপূরণীয় ক্ষতি (Irreparable Loss) হলে সে ব্যক্তির ওই দপ্তর, সংশ্লিষ্ট কর্মচারী বা সরকারের নিকট ক্ষতিপূরণ দাবি করার বিধান অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
# কোনো কোনো সময় রাজনৈতিক বা ঊর্ধ্বতন কর্তপক্ষের চাপের কারণে সরকারি কর্মচারি কর্তৃক সঠিক ও আইনানুগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ ব্যাহত হয়। এই সমস্ত ক্ষেত্রে ওই কর্মচারী যদি টেলিফোনে বা লিখিতভাবে বা মেসেজ আকারে সংশ্লিষ্ট কাউকে Note of Dissent প্রদান করে তাহলে তাকে সুরক্ষা প্রদান করতে হবে। শুধু দায় এড়ানোর জন্য এ ব্যবস্থার অপপ্রয়োগ না হয় সে বিষয়েও সতর্ক থাকতে হবে। প্রয়োজনে সিভিল সার্ভিস কমিশন গঠন করে হলে ও সিভিল সার্ভিসের সদস্যরা যেন রাজনৈতিক বা অনৈতিক চাপমুক্ত থেকে কাজ করতে পারে সে বিষয়টি করতে হবে।
# কোনো বিষয়ে অধিক মাত্রায় আইন/বিধি প্রণয়ন বন্ধ করতে হবে। যেমন: নিরাপদ খাদ্য বিষয়ক সংশ্লিষ্ট প্রায় দু্ই ডজন আইন ও ততোধিক বিধি রয়েছে। ১৮টি সংস্থা এক্ষেত্রে কাজ করে। এই ধরনের Multiplicity of Laws and Institution সরকারের অদক্ষতার পরিচায়ক। তাই এসব বিষয়ে মূল আইনের বাইরে ১/২টি বিশেষ আইন ছাড়া অধিক আইন প্রণয়ন বন্ধ করতে হবে। প্রয়োজনে সব আইন একত্র করে Code বা ম্যানুয়াল আকারে প্রকাশ করা যেতে পারে।
# যেসব আইনে জটিল কারিগরি বিষয় আছে সেসব আইন বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট অংশীজনের মাঝারি মেয়াদে প্রশিক্ষণ, মোটিভেশন প্রদান করতে হবে এবং আইন বাস্তবায়নে তাদের সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। প্রয়োজনে পিরামিড সিস্টেম অর্থাৎ প্রচার প্রচারণা, প্রশিক্ষণ, মোটিভেশন, শোকজ, দেওয়ানি দায়, ফৌজদারি দায়, লাইসেন্স প্রত্যাহার এভাবে ধাপে দাপে অগ্রসর হতে হবে।
# প্রশাসনিক দক্ষতা বৃদ্ধি, সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে দ্রুততা আনয়নের লক্ষ্যে প্রশাসনিক ও নির্বাহী প্রকৃতির কার্যাবলীসমূহ যেমন: কোনো লাইসেন্স প্রদান, লাইসেন্স প্রত্যাহার, বদলি, মূল্য নির্ধারণ ইত্যাদি বিষয়ে Prima facie কোনো মানুষের অধিকার লঙ্ঘিত না হলে মামলা-মোকদ্দমা দায়েরের চর্চা বন্ধ করতে হবে।
# সিঙ্গাপুরের ন্যায় মন্ত্রণালয়ভিত্তিক Arbitration Council গঠন করতে হবে। প্রাথমিকভাবে সেসব মন্ত্রণালয়ের কাজ নিয়ে বেশি মামলা মোকাদ্দমা হয় সেসব মন্ত্রণালয়ে (যেমন: গৃহায়ন, জনপ্রশাসন, অর্থ, ভূমি ও আইন) Arbitration পদ্ধতি চালু করতে হবে। Arbitration-এ যে সিদ্ধান্ত আসবে তার আইনগত মূল্য থাকবে। Arbitration ব্যর্থ হলে তখন আদালতে বিষয়টি উত্থাপনের সুযোগ থাকবে। এতে প্রশাসনিক মন্ত্রণালয়গুলো বিরোধ নিষ্পত্তির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারবে এবং বিচার বিভাগের চাপ কমবে।
# দ্বৈততা পরিহার, শুদ্ধতা আনয়ন ও সঠিক রেকর্ড সংরক্ষণের স্বার্থে সরকারি- আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠান কর্তৃক প্রদত্ত লাইসেন্স ও সনদসমূহে কিউআর (QR) কোড ব্যবহার চালু করতে হবে।
# আর্থ-সামাজিক বিশ্লেষণের পর জনপ্রশাসনের কিছু কিছু চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের আনুষঙ্গিক প্রযুক্ত যেমন: এআই রোবোটিকস্ চালু করা যেতে পারে। নীতি পর্যালোচনার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় ডাটা এআই’র ব্যবহারের মাধ্যমে সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। জটিল ও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কাজ যেমন: বহুতল বিল্ডিং বানানো ইত্যাদি কাজে এআই’র ব্যবহার আরম্ভ করতে নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে।
# সিভিল সার্ভিসে শুদ্ধাচার চর্চা বৃদ্ধি করতে বিদ্যমান পদক্ষেপের পাশাপাশি সেক্টর ভিত্তিক ‘স্বার্থের দ্বন্দ্ব’ (Conflict of Interest) বিষয়ক নীতি/গাইডলাইন তৈরি ও বাস্তবায়ন করতে হবে। বর্তমানে শুধুমাত্র ক্রয় সংক্রান্ত বিষয়ে ‘স্বার্থের দ্বন্দ্ব’ সম্পর্কিত নীতি (Policy) রয়েছে, যা The Code of Ethics for Public Procurement নামে PPR- এর তফসিল ১৩-তে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। এই Code লঙ্ঘন করলে অসদাচরণ বলে গণ্য হবে। এই কোড অনুসারে (১০ নং অনুচ্ছেদ) ক্রয় সংক্রান্ত বিষয়ে কোনো সরকারি কর্মচারীর ব্যক্তিগত স্বার্থ থাকলে তা ঘোষণা করতে হবে এবং ওই ক্রয় কাজের সঙ্গে তিনি সম্পৃক্ত থাকবেন না। অনেক সময় দেখা যায় ভবিষ্যতে লাভবান হবার আশায় অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধান কিছু ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে প্রাধান্য দেয় এবং পরে ওইসব সংস্থায় চাকরি নেয় অথবা পরামর্শক হিসেবে কাজ করে, যা স্বার্থের দ্বন্দ্ব তৈরি করে। এসব ক্ষেত্র চিহ্নিত করে স্বার্থের দ্বন্দ্ব সংক্রান্ত নীতি/কোড প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে
# পদোন্নতির ক্ষেত্রে কর্মদক্ষতা, মূল্যায়ন পদ্ধতি অনুসরণ: গতানুগতিক এসিআর এবং গোয়েন্দা প্রতিবেদন পদ্ধতির পরিবর্তে দক্ষতা ও কর্মমূল্যায়নের ভিত্তিতে পদোন্নতি প্রদান করার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য সেক্টর ভিত্তিক Key Performance Indicator (KPI) নির্ধারণ করতে হবে। কেপিআইতে কর্মদক্ষতা, প্রকল্প/কর্মসূচি ইত্যাদি বাস্তবায়নে সফলতা, সরকারি তহবিলের স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা, সেবা প্রদানে কার্যকারিতা এবং বিভিন্ন কর্মস্থলে তার সুনাম ও দক্ষতা অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে।
সর্বোপরি সিভিল সার্ভিসের সব পর্যায়ের সদস্যদের মাঝে ন্যায়পরায়ণতা, সমতা, দায়বদ্ধতা, এমপ্যাথি বা সমানুভূতি ইত্যাদি গুণাবলী ধারণ ও চর্চা নিশ্চিতকরণে প্রশিক্ষণ প্রদানসহ বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক
উপ-পরিচালক (উপসচিব), স্থানীয় সরকারের কার্যালয়, খুলনা
বাংলাদেশ সময়: ১৯১৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ০৬, ২০২৪