একটা বয়স থাকে যখন ভালোবাসার জন্যে, ভালোবাসার মানুষের টানে জগৎ সংসার এক ফুৎকারে উড়িয়ে দেওয়া যায়। নির্দ্বিধায় স্কন্ধে তুলে নেওয়া যায় স্বেচ্ছা বনবাসের নির্বাসন।
আদৌ কি ‘অ্যাবসলিউট ট্রুথ’ বলে কিছু আছে? নাকি সবই শেক্সপিয়রের ‘টু বি অর নট টু বি’!
আমার কৈশোরের এক বন্ধু বাল্যপ্রেমের টানে কেবল পরিবারই ছাড়েন নি, জলাঞ্জলি দিয়েছেন নিজের সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার, উচ্চ মধ্যবিত্তের আয়েসী জীবন-যাপন। স্কুল ফাইনালে তিন সাবজেকটে লেটারসহ স্টার মার্কস ‘৭৩ সালে বেশ কঠিন এক অর্জন। নামিদামি কলেজের ফার্স্ট ইয়ারেই লেখাপড়া ক্ষ্যান্ত দিয়ে ঢাকার একটা ঠিকেদারি কোম্পানির নিম্ন পদস্হ কর্মচারি বনেছিলেন স্বেচ্ছায়। কারণ ক্লাস টেন-এ পড়ুয়া নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের সুন্দরী প্রেমিকার জন্যে লোভনীয় এক বিয়ের প্রস্তাব এসেছিলো। প্রেমিকার পরিবার কোনো ভাবেই না-করতে পারছিলেন না। বন্ধুটির বিশ্বাস, কবি হেলাল হাফিজের বিপরীত--- ভালোবাসা মিলনে উজ্জ্বল হয়; সার্থক হয়। ফলে দু’জন রাতের অন্ধকারে ঘর ছেড়ে চাটগাঁ ছেড়ে ঢাকা মেইলে চড়লেন। এক আত্মীয়ের নিবিড় সহায়তায় বন্ধুটির কাজ জুটলো। তার আগে রেজিস্ট্রি অফিসে বয়স বাড়িয়ে দু’জনে বৈধ স্বামী-স্ত্রী।
ওদের অভাব-অনটনের সংসারে যথারীতি কালের নিয়মে দু’জন অতিথি এলো। বন্ধু-পত্নীটি ভালো সেলাই-ফোঁড় জানতেন। মহল্লার মহিলাদের শাড়ির লেইস আর সালোয়ার কামিজের সেলাইয়ে কিছুটা সচ্ছলতা এলো। এরই মধ্যে বন্ধুটি প্রাইভেটে ইন্টারমিডিয়েট পাশ দিয়ে বসলেন। আশ্চর্য, বিনা তদবীবে একটা রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকে টোকেন ক্লার্কের চাকুরিও জুটে গেলো। ‘৭৯-এ আমার সঙ্গে যখন মতিঝিলে হঠাৎ দেখা, তখন তার জীবন খানিকটা গোছানো ও আর্থিক অস্বচ্ছলতামুক্ত। লিটল ম্যাগাজিনের বিজ্ঞাপন সংগ্রহে আর নিজের কবিতা ছাপার অপ্রতিরোধ্য টানে নিত্যই পত্রিকাপাড়ায়, মানে মতিঝিল এলাকায়, যেতাম। সময় পেলে বন্ধুটির সঙ্গে দেখার নামে ফাও চা-ডালপুরি মেরে আসতাম।
তখনো সংসারের মানসাংক বুঝি না। আমাকে এক কাপ চা আর ডালপুরি খাওয়ানোর খেসারতে বন্ধুটির বাজারের তালিকা খানিকটা সংক্ষিপ্ত হতো সে সত্য বোঝার বাস্তব জ্ঞান তখনো অর্জন হয় নি। বন্ধুটির দৃষ্টি ও বিবেচনায় আমিই একমাত্র অতীতের জ্বলজ্যান্ত বর্তমান। আমাকে দেখার মধ্যেই সে হয়তো খুঁজে নিতো নিজের ফেলে আসা স্বজন ও পরিবারকে।
ছুটির এক দুপুরে বাসায় দাওয়াতও মিলেছিলো। দুই রুমের ভাঙা টিনের ঘরের মধ্যেই রসুইঘর। চারিদিকে অভাবের সর্বগ্রাসী আগ্রাসন । তবুও ভাবীর মুখে সেকি তৃপ্তির আভা! নিদারুণ অভাব-অনটনে থেকেও কীভাবে এতো সুখে-শান্তিতে নিশ্চিন্ত থাকা যায়! এরই নাম কী ভালোবাসা? পারস্পরিক নির্ভরতা? দুনিয়ার সব স্বাচ্ছন্দ্যকে পিছে ফেলে অভাবের কাঁদাজল ভাঙা!
দুঃসংবাদটা নিয়ে প্রেসক্লাবে এক সন্ধ্যায় এলেন বন্ধুটির অফিসের এক পিয়ন। কী অদ্ভুত, অফিসে নাকি ইমার্জেন্সি যোগাযোগ হিসেবে আমার নাম-ঠিকানা ও বিস্তারিত দেওয়া ছিলো। তখন আমি পরিপূর্ণ বেকার। সবে দৈনিক দেশ থেকে ইস্তফা দিয়ে আরেকটি চাকরির খোঁজে মুরুব্বী সাংবাদিকদের কাছে ঢুঁ মারি। পিয়নের কাছে জানলাম, বন্ধুটি বেশ কিছুদিন ধরে গুরুতর অসুস্হ থেকে বাদ আসর ইন্তেকাল করেছেন। বন্ধুর স্হায়ী ঠিকানা বা বাবা-মাকে (যদি বেঁচে থাকেন) খবর পাঠানো হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, রাতের ট্রেনে পরিবারের কেউ না কেউ আসবেন। তখন দাফনের বিস্তারিত চূড়ান্ত হবে।
আমাকে দেখা মাত্রই ভাবী সাহেব অনেকক্ষণ থেকে আটকে রাখা কান্নাটুকু আর ধরে রাখতে পারলেন না। নাবালক সন্তান দু’টোকে নিয়ে আমাকে প্রায় জড়িয়ে ধরে অদম্য কান্নায় ঘর ভাসালেন। কাঁদবেনই না বা কেন, ওনার দুনিয়ায় এখন ঘোর অমাবস্যা। ভবিষ্যৎ বলে আছে কেবল অনির্বাণ অনিশ্চয়তা। কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি নির্বাক হলেও চোখের কার্নিশ বেয়ে অঝোরে নামছে অশ্রু। কান্না বড়ই ছোঁয়াচে। লাশ ধোয়া মোছা করে এক কামরায় রেখে অফিসের সহকর্মীরা কাল সকালে আসবেন প্রতিশ্রুতি দিয়ে বাড়ি ফিরে গেছেন। ঘড়ির কাঁটা প্রায় মধ্যরাত ছুঁই ছুঁই। আমি হলে ফেরত যাবার কথা জানাতেই ভাবী প্রায় মূর্চ্ছা যায়।
ভাবী কিছুতেই স্বামীর লাশের সাথে এক ছাদের নীচে এক রাত একাকী কাটতে রাজী নন। মৃত মানুষ বা লাশে ভাবীর দারুণ ভয়। যে জীবিত মানুষটির হাত ধরে নির্দ্বিধায় ভাবী সমাজ সংসার পরিবার পরিজন ছেড়েছিলেন, তার মৃতদেহের সাথে প্রায় অর্ধেক রাত কাটানোর কোনো ইচ্ছে বা সাহস নেই ভাবীর।
ভালোবাসা বড়ই অদ্ভূত এক সমীকরণ। জীবনতো আরো জটিল সব জ্যামিতি।
পাদটীকাঃ বন্ধুটির বাবা পুত্রবধূ ও নাতিদের নিজ ঘরে ফিরিয়ে নিয়েছিলেন।
ই-মেলঃ [email protected]
সম্পাদনা: জুয়েল মাজহার, কনসালট্যান্ট এডিটর [email protected]